Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Top Ad

Breaking News:

latest

ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকার গুলি কি কি

ভারতীয় সংবিধান

ভারতের সংবিধানে উল্লেখিত মৌলিক অধিকার গুলি কি কি?

ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কর্তব্য গুলি কি কি আলোচনা করো।

ロ সূচনা : মানুষের জীবন ও ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য কিছু সুযোগসুবিধা বা অধিকার থাকা আবশ্যিক। মৌলিক অধিকারগুলি সংবিধানের (১২-৩৫ নং ধারা) দ্বারা সংরক্ষিত ও স্বীকৃত। মূল সংবিধানে সাতটি মৌলিক অধিকারের উল্লেখ ছিল। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৪৪তম সংশোধনের মাধ্যমে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সংবিধানে ছয়টি মৌলিক অধিকার সন্নিবিষ্ট আছে। এগুলি হল—
(i) সাম্যের অধিকার
(ii) স্বাধীনতার অধিকার
(iii) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার
(iv) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার
(v) সংস্কৃতি ও শিক্ষা-বিষয়ক অধিকার এবং
(vi) সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার।


ロ ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন মৌলিক অধিকার :
(i) সাম্যের অধিকার : সংবিধানের ১৪ থেকে ১৮ নং ধারায় সাম্যের অধিকার-সংক্রান্ত ব্যবস্থা লিপিবদ্ধ আছে। সাম্যের অধিকার বলতে বোঝায় আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সব রকম বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান ও প্রত্যেক নাগরিকের সম-অধিকারের প্রতিষ্ঠা। বলা হয় আইনের চোখে সকলেই সমান এবং সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুসারে সকলের সমান অধিকার থাকবে। তবে অনুন্নত শ্রেণি, তপশিলিভুক্ত জাতি-উপজাতি ও শিশুদের জন্য রাষ্ট্র বিশেষ ব্যবস্থা নিতে পারবে।

(ii) স্বাধীনতার অধিকার : ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বাধীনতার অধিকার লিপিবদ্ধ আছে সংবিধানের ১৯ থেকে ২২ নং ধারায়। মূল সংবিধানে সাতটি স্বাধীনতার উল্লেখ ছিল। ৪৪তম সংবিধান সংশোধন দ্বারা সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ছয় প্রকার স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত। এগুলি হল—(1) বাক্‌স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, (2) শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা, (3) সমিতি বা সংঘ গঠনের স্বাধীনতা (4) ভারতের সর্বত্র চলাফেরার স্বাধীনতা, (5) ভারতীয় ভূখণ্ডের যে-কোনো অংশে বসবাসের স্বাধীনতা এবং (6) যে-কোনো বৃত্তি, পেশা বা ব্যাবসাবাণিজ্য করার স্বাধীনতা।

(iii) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার : সংবিধানের ২৩ এবং ২৪ নং ধারায় শোষণের বিরুদ্ধে অধিকারের উল্লেখ আছে। এই বিধান দ্বারা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শোষণ থেকে সাধারণ নাগরিকদের মুক্ত রাখার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। যথা—(1) মানুষ ক্রয়বিক্রয়, দাসপ্রথা, বেগার খাটানো ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। (2) সংবিধানের ২৪নং ধারা অনুসারে ১৪ বছরের কম বয়সের শিশুদের খনি, কারখানা বা অন্য কোনো বিপজ্জনক কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

(iv) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার : ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (২৫-২৮ নং ধারা) দ্বারা ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ গৃহীত হয়েছে। এই অধিকার দ্বারা — (1) প্রতিটি মানুষ বিবেকের স্বাধীনতা অনুসারে ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করার অধিকারী। (2) সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া যাবে না। (3) কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রসার বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কর প্রদানে বাধ্য করা যাবে না।

(v) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার : সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার (২৯ ও ৩০ নং ধারা) দ্বারা 
(1) প্রত্যেক নাগরিক তার নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও লিপি ব্যবহারের অধিকার লাভ করেছে। (2) ধর্ম, জাতি বা ভাষার অজুহাতে কাউকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এই ধারা বলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের পছন্দমতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার অধিকার পেয়েছে।

মৌলিক অধিকার (১২-৩৫ নং ধারা)
1. সাম্যের অধিকার — ১৪-১৮ নং ধারা
2. স্বাধীনতার অধিকার — ১৯-২২ নং ধারা
3. শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার — ২৩-২৪ নং ধারা
4. ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার — ২৫-২৮ নং ধারা
5. সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার — ২৯-৩০ নং ধারা
6. সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার — ৩২ ও ২২৫ নং ধারা


(vi) সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার : সংবিধানের ৩২ এবং ২২৬ নং ধারায় মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। ৩২ নং ধারা অনুসারে নাগরিকরা মৌলিক অধিকার বলবৎ করার জন্য সুপ্রিমকোর্টের কাছে আবেদন করতে পারেন। এই অধিকারগুলি বলবৎ করার জন্য সুপ্রিমকোর্ট বন্দি প্রত্যক্ষীকরণ, পরমাদেশ, প্রতিষেধ, অধিকার-পৃচ্ছা এবং উৎপ্রেষণ প্রভৃতি লেখ (writ) জারি করতে পারে। একইভাবে হাইকোর্ট আদেশ বা নির্দেশ জারি করে অধিকারগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে (২২৬ নং ধারা অনুসারে)।

উপসংহার: ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলির ওপর অত্যাধিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য অনেকে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এইসব সমালোচকরা মনে করেন ভারতীয় সংবিধান এক হাতে মৌলিক অধিকারগুলি প্রদান করলেও অপর হাতে সেগুলি হরণ করেছে। তবে মৌলিক অধিকারগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলিও মূল্যহীন হয়ে পড়েছে বলা চলে।

    ❐ আরো পড়ুনঃ

প্রশ্নঃ১। স্বাধীন ভারতে কত খ্রিস্টাব্দে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়? ভারতীয় সংবিধান রচনার প্রধান রূপকার কে ছিলেন?
উত্তরঃ স্বাধীন ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। ভারতীয় সংবিধানের প্রধান রূপকার হলেন ড. বি. আর. আম্বেদকর।

প্রশ্নঃ২। ভারতীয় সংবিধানের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
উত্তরঃ ভারতীয় সংবিধানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য— (১)ভারতীয় সংবিধান হল বিশ্বের বৃহত্তম ও জটিলতম সংবিধান। (২) ভারতীয় সংবিধানে একটি ‘প্রস্তাবনা’ আছে।

প্রশ্নঃ৩। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে কী বলা হয়েছে?
উত্তরঃ সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলা হয়েছে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪২তম সংবিধান সংশোধনে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি যুক্ত হয়েছে।

প্রশ্নঃ৪। ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ কথাটির তাৎপর্য কী?
উত্তরঃ যে রাষ্ট্রে ধর্মীয় ক্ষেত্রে সরকার কোনো রকম হস্তক্ষেপ করে না, যে যার নিজ নিজ ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে বাস করতে পরে, সেই রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা যায়।

প্রশ্নঃ৫। ভারতীয় সংবিধানের ২টি মৌলিক অধিকার উল্লেখ করো।
অথবা, ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত যে-কোনো দুটি,মৌলিক অধিকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

উত্তরঃ ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত দুটি মৌলিক অধিকার— (১) সাম্যের অধিকার : এর দ্বারা ভারতের প্রতিটি নাগরিক আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমমর্যাদা ও সম-অধিকার পান। (২) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার : এর দ্বারা প্রতিটি নাগরিক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মাচরণ করতে পারেন।

প্রশ্নঃ৬। ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতি বলতে কী বোঝায়?
উত্তরঃ ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অংশের ৩৬ থেকে ৫১ নং ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনার কিছু নীতি বর্ণিত হয়েছে। সেগুলি ‘নির্দেশমূলক নীতি’ নামে পরিচিত। এই নীতিগুলি (প্রথমে ছিল ১৩টি পরে বেড়ে হয় ১৭টি) হল— (১) কাজের অধিকার, (২) বার্ধক্য ভাতা, বেকারদের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার, (৩) ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রবর্তন, অনগ্রসর সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ প্রভৃতি।

প্রশ্নঃ৭। ভারতীয় সংবিধানে নির্দেশাত্মক নীতির উদ্দেশ্য কী?
উত্তরঃ ভারতীয় সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতির প্রধান উদ্দেশ্য হল ভারতবর্ষকে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করা। আবার অনেকে বলেন, সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ গঠনের পথে অগ্রসর হওয়া নির্দেশমূলক নীতির উদ্দেশ্য।

প্রশ্নঃ৮। ইমপিচমেন্ট কী?
উত্তরঃ ভারতীয় সংবিধান লঙ্ঘনের অপরাধে রাষ্ট্রপতিকে তার মেয়াদ (৫ বছর) শেষ হওয়ার আগেই অপসারণ করা হয় যে পদ্ধতিতে তাকে ইমপিচমেন্ট বলে। এক্ষেত্রে সংসদের উভয় কক্ষের মোট সদস্য সংখ্যার কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের লিখিত সম্মতি ও অনুমোদন দরকার।

প্রশ্নঃ৯। কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি জরুরি ক্ষমতা ঘোষণা করতে পারেন?
অথবা, ভারতের রাষ্ট্রপতির জরুরি ক্ষমতা কী?
উত্তরঃ রাষ্ট্রপতি বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যে ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন তা হল তাঁর জরুরি ক্ষমতা। এই ক্ষেত্রগুলি হল— (১) যুদ্ধ বা বহিঃআক্রমণ, (২) রাজ্যগুলিতে সাংবিধানিক অচলাবস্থা সৃষ্টি, (৩) আর্থিক স্থায়িত্ব বা সুনাম বিপন্ন হওয়া ইত্যাদি।

প্রশ্নঃ১০। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা বলতে কী বোঝ?
উত্তরঃ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর পাগরিষদে সংবিধানের লক্ষ্য সম্বন্ধে যে প্রস্তাব রাখেন সেই প্রস্তাবেরই পরিবর্তিত রূপ হল প্রস্তাবনা।

প্রশ্নঃ১১। ভারতকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত বলা হয় কেন?
উত্তরঃ ভারতের জনগণ প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে যেসব প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেন, তাদের দ্বারাই দেশের আইনসভা গঠিত হয় বলে ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। ভারতে কোনো বংশানুক্রমিক রাজা বা রানির স্থান নেই, তার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীপরিষদ পরিচালিত শাসনব্যবস্থার জন্যই ভারতকে একটি প্রজাতান্ত্রিক দেশ বলা হয়।

প্রশ্নঃ১২। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নিয়োজিত হন?
উত্তরঃ ভারতীয় সংবিধানের ৭৫ (১নং) ধারা অনুযায়ী লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা মোর্চার নেতা বা নেত্রীকেই রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু লোকসভায় কোনো দল বা মোর্চা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে রাষ্ট্রপতি নিজ মনোনীত ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করতে পারেন। তবে ওই ব্যক্তির পক্ষে লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন থাকতে হবে।


টীকা লেখো: ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা।
সংবিধানের ক্ষুদ্র সংস্করণ: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি থেকে ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয়। ভারতীয় সংবিধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুকরণে একটি প্রস্তাবনার অংশ যুক্ত হয়েছে। এই প্রস্তাবনাকে সংবিধানের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা হয়।

প্রস্তাবনার বিষয়: প্রস্তাবনাটি হল—“আমরা ভারতের জনগণ সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে সংকল্প করে ভারতবর্ষকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে এবং এর সব নাগরিক যাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা; মর্যাদা ও সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে সাম্য ভোগ করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তির মর্যাদা ও জাতির ঐক্য ও সংহতির নিশ্চয়তা সাধন করার উদ্দেশ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের প্রসারকল্পে আজ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর আমাদের গণপরিষদে এই সংবিধান গ্রহণ ও বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের মধ্যে অর্পণ করছি।”

সংযোজন: সংবিধান প্রণয়নের সময় প্রস্তাবনায় ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দুটি ছিল না। ১৯৭৬ সালের ৪২তম সংবিধান সংশোধনে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথা দুটি সংযোজিত হয়েছে। 

প্রস্তাবনার ব্যাখ্যা: [1] সার্বভৌম: সার্বভৌম বলতে বোঝায় ভারতরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে বিদেশি নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। [2] সমাজতান্ত্রিক : প্রস্তাবনায় ভারত রাষ্ট্রকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা হলেও প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ভারতের সংবিধান এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখানে মিশ্র অর্থব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। [3] ধর্মনিরপেক্ষ : ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসারে ভারতরাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা বা বিরোধিতা করে না। সর্বধর্ম এখানে সমান স্বীকৃতি পায়। [4] গণতান্ত্রিক : গণতান্ত্রিক বলতে বোঝায় ভারতের শাসনব্যবস্থা জনগণের সম্মতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। [5] প্রজাতন্ত্র : সাধারণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র বলতে বোঝায় ভারতে রাষ্ট্রপ্রধান উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতা লাভ করবেন না, তিনি জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।
____________


প্রশ্নঃ ভারতকে ‘গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' বলা হয় কেন?
উত্তরঃ ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলা হয়েছে। ভারতীয় রাষ্ট্রজীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য হল, ভারতবর্ষ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী দেশ।

ভারতবর্ষকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলার কারণ :
[1] গণতন্ত্র : ভারতবর্ষ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। (i) ভারতীয় সমাজে সব মানুষ সমান মর্যাদা, অধিকার ও সুযোগসুবিধা ভোগের অধিকারী। এখানে ধনগত বা জন্মগত বৈষম্য স্বীকার করা হয় না। ভারতের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ভোটদানের অধিকারী। (ii) প্রত্যেকেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে শাসনকার্যে অংশ নিতে পারেন।

[2] প্রজাতন্ত্র :ভারতবর্ষ একটি প্রজাতান্ত্রিক দেশ। প্রজাতন্ত্র বা সাধারণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী — (i) রাষ্ট্রপ্রধান উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতা লাভ করেন না। তাঁকে জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে হয়। (ii) এখানে রাজা বা রাজতন্ত্রের কোনো স্থান নেই।

উপসংহার: সমালোচকদের মতে গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র শব্দ দুটি প্রায় একই অর্থ বহন করে। তাই তাঁদের মতে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটির প্রয়োগ সংবিধান প্রণেতাদের ভাবাবেগের ফসল। সংবিধান প্রণেতারা আসলে চেয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের মতো ভারতে যেন বংশানুক্রমিকভাবে রাজা বা রানিরা না থাকেন। এখানে যেন জনগণই প্রজারূপে ভোট দিয়ে রাজারূপ গণতান্ত্রিক সরকারকে নির্বাচিত করে। তাই সংবিধান প্রণেতারা ভারতকে ‘গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন।

----------------------

প্রশ্নঃ ভারতীয় সংবিধানকে আধা যুক্তরাষ্ট্রীয় বলার কারণ সম্পর্কে লেখো।

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি নির্ণয়ের প্রশ্নে সংবিধান বিশারদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রপ্রবণতার জন্য ড. বি. আর. আম্বেদকর, অধ্যাপক কে. সি. হোয়ার প্রমুখ ভারতীয় শাসনব্যবস্থাকে আধা যুক্তরাষ্ট্রীয় বলে উল্লেখ করেছেন। এর কারণগুলি হল—

[1] গঠন পদ্ধতির দিক থেকে: গঠনগত দিক থেকে ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা হলেও দেখা যায় স্বাধীনতার পূর্বে ভারত দুভাগে বিভক্ত ছিল—(1) ব্রিটিশ অধীনস্ত রাজ্যসমূহ, 2) স্বাধীন দেশীয় রাজ্যসমূহ। স্বাধীনতার পর এই সকল দেশীয় রাজ্যগুলি ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আজ আর সেগুলির কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই।

[2] তিন ধরনের সরকারের অবস্থিতির জন্য: যুক্তরাষ্ট্রে দুই ধরনের সরকার থাকে, কিন্তু ভারতে রয়েছে তিন ধরনের সরকার যথা—কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির সরকার। তাই ভারতকে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র বলা চলে না।

[3] শাসন পরিচালনায় কেন্দ্রের প্রাধান্যের দরুন: শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রেও ভারতে কেন্দ্রের সার্বিক প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। প্রতিটি রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রণীত আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই শাসন কাজ পরিচালনা করতে হয়। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ কিছু কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব অর্পণের অধিকারী।

[4] আর্থিক বিষয়ে কেন্দ্রের প্রাধান্য রয়েছে বলে: ভারতে আর্থিক ক্ষেত্রগুলিতেও কেন্দ্রের প্রাধান্য বর্তমান। গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করগুলি কেন্দ্রের অধীন। অঙ্গরাজ্যগুলিকে আর্থিক সাহায্য দানের মাধ্যমে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সর্বোপরি রাষ্ট্রপতি নিজেই আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে রাজ্যসরকারগুলিকে আর্থিক নীতি অনুসরণের নির্দেশ দিতে পারেন।
-------------------

ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?

অথবা, ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ভূমিকাঃ  ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা করার জন্য ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর একটি গণপরিষদ গঠিত হয়। প্রায় তিন বছর আলাপ-আলোচনার পর খসড়া সংবিধান ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি থেকে নতুন সংবিধান কার্যকারী হয়।

ভারতীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
[1] বিশ্বের বৃহত্তম ও জটিলতম সংবিধান : বিশ্বের বৃহত্তম ও জটিলতম সংবিধান হল ভারতের সংবিধান। মূল সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা, ৩৯৫টি ধারা, বহু উপধারা এবং ৮টি তপশিল (Schedule) ছিল। বারবার সংবিধান সংশোধনের ফলে বর্তমানে প্রায় ৪৫০টি ধারা, অনেক উপধারা এবং ১২টি তপশিল (Schedule) আছে। বিশ্বের কোনো সংবিধানেই এত ধারা-উপধারা নেই। এই সংবিধান আকৃতিতে বিশ্বের বৃহত্তম হওয়ার ফলে জটিলতমও হয়েছে। সংবিধানে মৌলিক অধিকার, নির্দেশমূলক নীতি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ থাকায় জটিলতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

[2] যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান : ভারতের সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল— (i) লিখিত সংবিধান, (ii)কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতাবণ্টন, (iii) নিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের অস্তিত্ব। তবে সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ ক্ষমতার উল্লেখ থাকার ফলে ভারতীয় সংবিধানকে এককেন্দ্রিক সংবিধানও বলা হয়। কে. সি. হোয়ার তাই ভারতীয় সংবিধানকে যুক্তরাষ্ট্রপ্রতিম বলে অভিহিত করেছেন।

[3] প্রস্তাবনার সংযুক্তি : মার্কিন সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানেও একটি প্রস্তাবনা সংযুক্ত হয়েছে। সংবিধানের অস্পষ্টতা দূরীকরণে প্রস্তাবনার বিশেষ গুরুত্ব আছে। ভারত সংবিধান রচয়িতাগণ প্রস্তাবনার মাধ্যমে সংবিধানের উদ্দেশ্য ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বর্ণনা দিয়েছেন। বর্তমানে প্রস্তাবনায় ভারতবর্ষকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

[4] নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি : মূল সংবিধানে সাত প্রকার মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। যথা— (i) সাম্যের অধিকার,(ii) স্বাধীনতার অধিকার (iii) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (iv) ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, (v) সংস্কৃতি ও শিক্ষা-বিষয়ক অধিকার, (vi) সম্পত্তির অধিকার, (vii) শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৪৪তম সংবিধান সংশোধনে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

[5] নির্দেশমূলক নীতির সংযুক্তি: আয়ার্ল্যান্ডের সংবিধানের মতো ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অংশে (part IV) রাষ্ট্র পরিচালনার কতকগুলি নির্দেশমূলক নীতি সংযুক্ত হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৬-৫১নং ধারাগুলিতে এর উল্লেখ আছে। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে নীতিগুলি অপরিহার্য। নীতিগুলি হল— (i) কাজের অধিকার, (ii) বার্ধক্য ভাতা, বেকারদের সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার, (iii) ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রবর্তন, (iv) অনগ্রসর সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ প্রভৃতি।

[6] নাগরিকদের কর্তব্য : ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের কর্তব্যের উল্লেখ আছে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২তম সংবিধান সংশোধনে দশটি মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন— (i) সংবিধান মান্য করা, (ii) দেশের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা, (iii) জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, (iv) জাতির মিশ্র সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্য রক্ষা করা ইত্যাদি।

[7] সুপ্রিমকোর্টের প্রাধান্য : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ব্যাখ্যা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি প্রভৃতি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

[8] এক-নাগরিকত্ব : সংবিধানে ভারতীয় নাগরিকদের এক-নাগরিকত্ব স্বীকৃত হয়েছে। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্ত হওয়ায় নাগরিকদের কোনো অঙ্গরাজ্যের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। অর্থাৎ ভারতে দ্বি-নাগরিকত্ব বা প্রাদেশিক নাগরিকত্বের অস্তিত্ব নেই।

[9] সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার : মূল ভারতীয় সংবিধানের ৩২৫-৩২৬নং ধারায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী-গরিব, স্ত্রী- পুরুষনির্বিশেষে ২১ বছর বয়সি প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিককে ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৬১তম সংবিধান সংশোধনে ভোটাধিকারের বয়স কমিয়ে ১৮ বছর করা হয়েছে।

[10] ধর্মনিরপেক্ষতা: সংবিধানে ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের কোনো রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই। সেই সঙ্গে ভারতরাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে না। সাধারণভাবে প্রত্যেক নাগরিক তার ধর্মাচরণ ও ধর্মপ্রচার করতে পারে। ড. বি. আর. আম্বেদকরের মতে— “সংসদ নাগরিকের ওপর কোনো ধর্মকে জোর করে চাপিয়ে দেবে না।”

উপসংহার:  ভারতীয় সংবিধান একাধারে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও এককেন্দ্রিক, সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয়, রাষ্ট্রপতি শাসিত ও মন্ত্রীপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থার নিদর্শন। ভারতীয় সংবিধানের সকল বৈশিষ্ট্য নিজস্ব নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে প্রস্তাবনা ও মৌলিক অধিকারগুলি, কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শ, আয়ার্ল্যান্ড ও বার্মা থেকে নির্দেশমূলক নীতিগুলি এবং ইংল্যান্ডের সংবিধান থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার আদর্শ সংযুক্ত হয়েছে।
_____________

স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র কীভাবে বিকশিত হয়েছে?

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট থেকে স্বাধীন ভারতের পথ চলা শুরু হয়। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বলেন, আমাদের প্রধান কাজ কেবল ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, আরও বড়ো কাজ হল ভারতবাসীর আবেগ ও মননশীলতার সংহতি বিধান করা। তাই ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গৃহীত হয়।

ロ  ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ :
[1] জাতীয় সংহতি সুদৃঢ়করণ: জাতি, ভাষা, ধর্ম ও আচার-আচরণগত বৈচিত্র্যকে বিবেচনার মধ্যে রেখেই নেহরু ভারতের জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় করার কথা বলেন। তিনি লেখেন, বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা ভারতের জাতীয় সংহতির পরিপন্থী নয়, উপরন্তু এই বৈচিত্র্যই ভারতের প্রাণশক্তির ভিত্তি। তাই সব ভাষা, ধর্ম বা জাতির স্বাতন্ত্র্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেই তিনি জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করার কর্মসূচি গ্রহণের ওপর জোর দেন।

[2] যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠন: ভারতে জাতীয় সংহতি বিধানের ক্ষেত্রে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে যে সংবিধান গৃহীত হয়, তা ভারতের চিরাচরিত বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের পথ দেখায়। এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনকাঠামো গ্রহণ করা হয়। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পাশাপাশি অঙ্গরাজ্যগুলির স্বশাসনের অধিকার সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা হয়।

[3] সংসদীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন: দেশের মৌলিক ও চূড়ান্ত ক্ষমতা (basic and ultimate power) পার্লামেন্ট বা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে এবং একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে অশোক মেহ্তা বলেছেন যে, “ভারতের পার্লামেন্ট জাতীয় ঐক্য রক্ষাকারীর ভূমিকা পালন করেছে”।

[4] বহুদলীয় ব্যবস্থা : রাজনৈতিক দলসমূহ এবং তাদের কর্মসূচি ভারতে সংসদীয় শাসনধারার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সোশ্যালিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, জনসংঘ, স্বতন্ত্র দল এবং সর্বোপরি জাতীয় কংগ্রেস সবগুলিই ছিল সর্বভারতীয় দল এবং প্রত্যেকের দর্শন ও আদর্শ ছিল ভারতের ঐক্য, সংহতি ও প্রগতি। নীতির ভিত্তিতে গঠিত বহুদলীয় ব্যবস্থা ভারতে গণতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় করেছে।

[5] সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা: স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের অন্যতম জাতীয় বৈশিষ্ট্য হল সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণ। ভারতের সংবিধানে জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গের বৈষম্য অস্বীকার করা হয়েছে। সমাজের অবহেলিত, পশ্চাৎপদ ও শোষিত মানুষের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করার অঙ্গীকার সংবিধানে উল্লেখ করা হয়। এই লক্ষ্যে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতিদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চাকুরি, নির্বাচন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ‘সংরক্ষণ নীতি' (Reservation) চালু করা হয়।

[6] সামাজিক সংস্কার সাধন: সমাজের উন্নতিকল্পে সংস্কারমূলক ও কল্যাণমূলক আইন জারি করা হয়। জমিদারি প্রথার অবসান ঘটানো হয় এবং উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন মানুষদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। অস্পৃশ্যতাকে একটি সামাজিক অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয় আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে কার্যকর ও সক্রিয় রাখার ব্যবস্থা গৃহীত হয়।

[7] দেশীয় রাজ্যসমূহের অন্তর্ভূক্তি: স্বাধীনতা লাভের মুহূর্তে ভারত সরকারের সামনে একটি বড়ো কাজ ছিল স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা। এই কাজের জন্য ‘রাজ্য মন্ত্রীদপ্তর’ (States Ministry) গঠন করা হয় এবং এই দপ্তরের দায়িত্ব পান সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। সর্দার প্যাটেলের দৃঢ়তা এবং নেহরুর নেতৃত্বে ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের মধ্যে জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর ছাড়া সমস্ত রাজ্য ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জুনাগড়, নভেম্বর মাসে হায়দ্রাবাদ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি ঘটে।

[8] ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠন: স্বাধীন ভারতে রাজ্যগুলির পুনর্গঠনের প্রশ্নটি বিবেচনার জন্য ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে একটি কমিশন নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি ফজল আলি, কে. এম. পানিক্কর এবং হৃদয়নাথ কুঞ্ঝরু এই কমিশনের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৫৫-এর অক্টোবরে কমিশনের রিপোর্ট পেশ করা হয়। ১৯৫৬-তে রাজ্য পুনর্গঠন আইন জারি হয়। এই আইন অনুযায়ী— (1) হায়দ্রাবাদের তেলেঙ্গানা যুক্ত হয় অন্ধ্রের সঙ্গে। (2) মালাবার জেলা ও ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন যুক্ত করে কেরালা রাজ্য সৃষ্টি করা হয়। (3) ১৯৬০ সালে বোম্বাইকে বিভক্ত করে গুজরাত রাজ্য সৃষ্টি করা হয়। (4) ১৯৬৬ সালে পাঞ্জাবকে বিভক্ত করে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা নামক দুটি রাজ্য গড়া হয়। রজনী কোঠারি, বিপান চন্দ্র প্রমুখের মতে, ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের ফলে ভারতের জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় হয়।

[9] সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা : স্বাধীন ভারত সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য হল ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজব্যবস্থা’ প্রবর্তন করা। এই প্রস্তাব ভারতে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা ব্যক্ত করে। এই লক্ষ্যে পৌঁছোনোর জন্য নানা জনমুখী পরিকল্পনা রূপায়ণে জোর দেওয়া হয়।

[10] পরিকল্পনা কমিশন: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে এই কমিশন গঠিত হয়। এর কাজ হল জাতীয় সম্পদ পরিমাপ করা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রচনা করা, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ও সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে ওই সম্পদ ব্যবহার করা ইত্যাদি। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পরিকল্পনা কমিশনের পুনর্গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী এই কমিশনের নেতৃত্ব দেন। রাজ্যগুলিতে পরিকল্পনা-বিষয়ক পরামর্শদাতারা এঁদের কাছে স্থানীয় উন্নয়নের সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে সুপারিশ পাঠান। রাজ্য ও জেলাস্তরেও পরিকল্পনা সংস্থা গঠন করা হয়।

[11] জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ: ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ গঠিত হয়। এর সভাপতি হন প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীগণ ও পরিকল্পনা কমিশনের সব সদস্য এর অন্তর্ভুক্ত। এর কাজ হল জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিচার বিবেচনা করা। এর পদমর্যাদা প্রায় ‘সুপার ক্যাবিনেট’ পর্যায়ের। এটি ভারত সরকার ও সব রাজ্য সরকারের পক্ষে কার্য পরিচালনা করে।

[12 সাধারণ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন: ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন ভারতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস বিপুল ভোটে বিজয়ী হয় ও সরকার গঠন করে। ১৯৫৭ ও ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ও তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনেও কংগ্রেস জয়লাভ করে। তবে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে প্রদেশে সর্বপ্রথম অকংগ্রেসি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ই. এম. এস. নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বে কেরলে প্রথম কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়।

উপসংহার: সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশকে চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য শুধুমাত্র সাংবিধানিক সুরক্ষাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য দারিদ্য মোচন, নির্বাচনে দুর্নীতি রোধ, আর্থিক বৈষম্য হ্রাস, উগ্র প্রাদেশিকতা ও আঞ্চলিকতাবাদের অবসান ঘটানো প্রয়োজন। এ ব্যাপারে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিকে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।

No comments

Hi Welcome ....