Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Top Ad

Breaking News:

latest

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ ভার্সাই সন্ধি | Treaty of Versailles History Notes

Q1. ১৯১৯ খ্রিঃ ভার্সাই সন্ধির মূল শতাবলি আলোচনা করো বা সিদ্ধান্ত কি ছিল? অথবা, ভার্সাই সন্ধি কী একটি চাপিয়ে দেওয়া শান্তি বলা চলে। অথবা, ভ...



Q1. ১৯১৯ খ্রিঃ ভার্সাই সন্ধির মূল শতাবলি আলোচনা করো বা সিদ্ধান্ত কি ছিল? অথবা, ভার্সাই সন্ধি কী একটি চাপিয়ে দেওয়া শান্তি বলা চলে। অথবা,ভাসাই সন্ধি-কী একটি জবরদস্তিমূলক সন্ধি? ভাসাই সন্ধি- অনুসারে জার্মানিকে কী হারাতে হয়েছিল?

◻︎ সূচনা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী মিত্রপক্ষ ও তার প্রধান প্রতিপক্ষ জার্মানির মধ্যে প্যারিসের ভার্সাই নগরীতে অবস্থিত ভার্সাই রাজপ্রাসাদে এক সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় (১৯১৯ খ্রিঃ ২৮ জুন), যা ভার্সাই সন্ধি নামে পরিচিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে (১৯১৯ খ্রিঃ) যেসব (৫টি) সন্ধিগুলি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার মধ্যে সবথেকে দীর্ঘ (৩৩৯টি ধারা) ছিল এই ভার্সাই সন্ধি। ২৩০ পৃষ্ঠাসমন্বিত ও ১৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত ভার্সাই সন্ধির মূল ধারাগুলি ছিল—

(১) আঞ্চলিক পুনর্গঠনের শর্তাবলি : জার্মানি বিভিন্ন দেশকে বিভিন্ন অঞ্চল ছেড়ে দেবে। যেমন—(ক) ফ্রান্সকে তার হারানো কয়লাখনি আলসাস ও লৌহখনি লোরেন ফিরিয়ে দেবে। (খ) বেলজায়াম মনসেরেট মেলমেডি, ইউপেন পাবে। (গ) ডেনমার্ক স্লেজউইগ অঞ্চল লাভ করবে। (ঘ) লিথুয়ানিয়া পাবে মেমেল বন্দর। (ঙ) পোল্ডার লাভ করবে পোজেন্দ ও পশ্চিম প্রাশিয়া অঞ্চল দুটি। (চ) জার্মানির পূর্ব সীমান্তে পোল্যান্ডকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে গঠন করা হবে। (ছ) পোল্যাণ্ডের সমুদ্রপথে যোগাযোগের সুবিধার জন্য জার্মানির মধ্যে দিয়ে পোলিশ করিডর নামক রাস্তা তৈরী হবে। (জ) এশিয়া ও আফ্রিকায় অবস্থিত জার্মানির বিভিন্ন উপনিবেশগুলি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। (ঝ) জার্মানির ডানজিগ বন্দরকে সকলের জন্য খোলা হবে এবং (ঞ) রাইন, দানিয়ুব ওডার নিয়েমেন নদীগুলির ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে।

(২) অর্থনৈতিক শর্তাবলি : জার্মানির ওপর মিত্রপক্ষ যেসব কঠোর অর্থনৈতিক শর্ত চাপিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল (ক) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে দায়ী করে ৬৬০ কোটি পাউণ্ড ক্ষতিপুরণের দায় জার্মানির ওপর ন্যস্ত করা। (খ) জার্মানি কী পদ্ধতিতে ক্ষতিপুরণ পরিশোধ করবে তা নির্ধারণের জন্য একটি ‘ক্ষতিপূরণ কমিশন' গঠিত হবে। (গ) জার্মানি তার অধিকাংশ বাণিজ্যপোত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডকে সমর্পণ করবে। (ঘ) জার্মানির সমৃদ্ধ কয়লাখনি অঞ্চল ফ্রান্সের অধীনে এবং আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে। (ঙ) ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ইত্যাদি দেশকে জার্মানি বাধ্যতামূলক কয়লা, লোহা, কাঠ, রবার ইত্যাদির জোগান দেবে।

(৩) সামরিক শর্তাবলি : ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির ওপর আরোপিত সামরিক শর্তগুলি হল— (ক) জার্মানির সৈন্য সংখ্যা এক লক্ষতে নিয়ে আনা হবে এবং ওই সেনারা শুধুমাত্র জার্মানির অভ্যন্তরীণ শান্তি ও সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। (খ) জার্মানিতে প্রচলিত সামরিক শিক্ষা নিষিদ্ধ হবে থাকবে। (গ) জার্মানি তার সমস্ত যুদ্ধ জাহাজ গুলি ইংল্যান্ড কে দিতে বাধ্য থাকবে। (ঘ) জার্মানিতে ট্যাংক, বোমারুবিমান, কামান প্রভৃতি নিষিদ্ধ হবে। (ঙ) জার্মানির নৌবাহিনীতে ৬টি করে যুদ্ধজাহাজ ও ক্রুজার, ১২টি করে টর্পেডো ডেস্ট্রয়ার এবং ২৫ হাজার নৌ-কর্মচারী থাকবে। (চ) ২২৮ ০ ২৩১ নং ধারা অনুযায়ী সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম ও জার্মান সেনাপতিদের বরখাস্ত করা হবে। (ছ) রাইন নদীর পূর্বতীর বরাবর ত্রিশ মাইল ইত্যাদি-র সব জার্মান সামরিক ঘাঁটি ও দুর্গগুলি ভেঙে ফেলা হবে। (জ) এই সন্ধির সব শর্তগুলি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখার জন্য জার্মানির খরচেই জার্মানিতে মিত্রপক্ষের একটি সেনাদল মোতায়েন থাকবে।

সমালোচনা : ঐতিহাসিক, গবেষক ও সমালোচকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভার্সাই সন্ধিকে সমালোচনা করেছেন। এই বিতর্কিত সন্ধিকে কেউ মৃত্যুপরিকল্পনা ও দাসত্বের শৃঙ্খল, কেউ একতরফা ও জবরদস্তি মূলক সন্ধি, কেউ ম্যাকিয়াভেলির সন্ধি, কেউ অনুদার সন্ধি, কেউবা নীতি ও আদর্শবর্জিত সন্ধি বলে উল্লেখ করেছেন।

(১) জবরদাস্তমূলক সন্ধি : ভাসাহ সান্ধর মাধ্যমে জামাানর ওপর যেভাবে জোরজবরদাস্ত করে ক্ষতিপুরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ও ভৌমিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, বিশ্বইতিহাসে এরুপ নমুনা আর কোনো সন্ধিতে নেই। তাই ঐতিহাসিক ই. এইচ. কার বলেছেন, “The signature extorted from Germany in these conditions was not morally binding of her."

(২) অমানবিক সন্ধি : ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি এতটাই কঠোর ছিল যে এই সন্ধি জার্মানদের মনে এক সুদূরপ্রসারী মানসিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। ঐতিহাসিক ল্যাসিং এর মতে— জার্মানির ওপর প্রতিশোধের লক্ষ্যে মিত্রশক্তি এই অমানবিক সন্ধির শর্তগুলি চাপিয়ে দিয়েছিল। এই চুক্তিকে অমানবিক আখ্যা দিয়ে ঐতিহাসিক এইচ.এ.এল. ফিশার বলেছেন—“They had made a peace which was no peace. Human nature it was widely felt had failed".

(৩) অনুদার সন্ধি : যুদ্ধসৃষ্টির অপরাধে ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে মিত্রপক্ষ জার্মানির প্রতি যে চরম অনুদারতা দেখিয়েছিল, তা ছিল অবশ্যই নিন্দনীয়। এই চরম অনুদারতার বিরুদ্ধে সমগ্র জার্মানি জুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। জার্মানরা অপেক্ষা করে এর যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য। জার্মানদের এই প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে ফরাসি সেনাধ্যক্ষ বলেছেন— ভার্সাই সন্ধি আসলে জার্মানিকে রণসাজে সজ্জিত হয়ে উঠতে কুড়ি বছরের যুদ্ধবিরতি ছিল মাত্র।

(৪) জাতীয়তাবাদ বিরোধী সন্ধি : আমেরিকার রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন-এর ঘোষিত চোদ্দো দফা শর্তে যে জাতীয়তাবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলা হয়েছিল, ভার্সাই সন্ধিতে জার্মানির ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। এই সন্ধির মাধ্যমে জার্মানি থেকে জার্মান অধ্যুষিত বেশ কিছু অঞ্চল আলাদা করে নিয়ে জার্মান জাতীয়তাবাদ বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ছাড়াও পোল্যাণ্ডকে জার্মানির ভিতর দিয়ে ‘পোলিশ করিডর’ নামক সংযোগপথ উপহার দেওয়া বা জার্মানির ডানজিগ বন্দরকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা ইত্যাদি জাতীয়তাবাদবিরোধী কার্যকলাপ জার্মান জাতীয়তাবাদকে আহত করে।

(৫) অনমনীয় সন্ধি : ভার্সাই সন্ধি ছিল এক অনমনীয় সন্ধিা ভার্সাই সন্ধির বিভিন্ন শর্তগুলিতে যে অনমনীয়তা দেখানো হয়েছিল তারই প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকা রচিত হয়। ঐতিহাসিক ই এইচ. রায় বলেছেন— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ লুকিয়েছিল ভার্সাই সন্ধির মধ্যেই। ঐতিহাসিক ই, লিপসন বলেছেন— মিত্রপক্ষ একটু নমনীয় হলে জার্মানি আক্রমণকারী হত না।

(৬) অর্থ আদায়কারী সন্ধি : ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি জার্মানির ওপর আরোপ করে যেভাবে অর্থ আদায় করা হয়েছিল তাকে বহু ঐতিহাসিক অর্থ আদায়কারী সন্ধি বলে উল্লেখ করেছেন। জার্মানিকে আর্থিক দিক থেকে শেষ করে দিয়ে তার কাছে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সাহায্য চাওয়া ছিল দুরাশা। এ প্রসঙ্গে টি, ডব্লিউ, রাইকার বলেছেন— রাজহংসীকে উপোসি রেখে কেউ তার কাছে সোনার ডিমের প্রত্যাশা করতে পারে না। (“One cannot starve a goose and expect in to lay golden eggs.)


Q2. ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
◻ ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সংবাদে অস্ট্রিয়া, ইতালি ও জার্মানি প্রভৃতি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের আগুন প্রজ্জ্বলিত হতে দেখা যায়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লব কোন নির্দিষ্ট পথে চালিত না হওয়ার জন্য এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতির তারতম্যের জন্য বিপ্লবগুলির পৃথক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়৷ রাজনৈতিক হতাশা ও অসন্তোষ মোটামুটি প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই সক্রিয় ছিল। এক দেশের বিপ্লবীদের সঙ্গে অন্য দেশের বিপ্লবীদের কোন সংযোগ ছিল না। বিপ্লবের আদি ও প্রধান কেন্দ্র ফ্রান্স কোনো দেশের বিপ্লবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। একে অন্যকে নিষ্ক্রিয় উদাসীনতার দৃষ্টিতে দেখত। প্রকৃতপক্ষে, বিপ্লবগুলি শিল্প বিপ্লব জনিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের ফলেই উদ্ভুত হয়েছিল।

বৈশিষ্ট্য : ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন অবশ্য মনে করেন যে, বিপ্লবগুলির উৎস ও গতিধারায় কতকগুলি এক এবং অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।

(i) উৎস : বিপ্লবগুলির অনুপ্রেরণার আদি উৎসস্থল হল ইতালি ও ফ্রান্সের বিপ্লব। ফ্রান্সের পূর্বেই সিসিলির ‘পালের্মোবাসীরা’ বিদ্রোহের ধ্বজা উত্তোলন করেছিল। এরপর ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব আত্মপ্রকাশ করলে সারা ইউরোপ বিপ্লবী প্লাবনে প্লাবিত হয়।

(ii) ভিয়েনা ব্যবস্থা-বিরোধী : প্রতিটি বিপ্লব-ই ছিল ভিয়েনা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ভিয়েনা ব্যবস্থায় জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রবাদের প্রকাশপথ রুদ্ধ হয়েছিল৷ ঐতিহাসিক গ্রেনভিল বলেছেন যে, ফ্রান্সে গণ সার্বভৌমত্বের নীতি গৃহীত হয়েছিল বলে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতি জনগণের অনাস্থা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজবংশের অধীনস্থ ইউরোপীয় জাতিগুলি ফ্রান্সকে অনুকরণ করতে উৎসাহিত হয়ে উঠে। যে সমস্ত স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত ছিল সেখানে বিপ্লবীদের দাবী ছিল প্রধানত ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মুদ্রন যন্ত্রের স্বাধীনতা, সার্বজনীন ভোটাধিকার ইত্যাদি, মূলত গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়। আবার যে সমস্ত দেশ একই জাতিভুক্ত হয়েও বিচ্ছিন্ন বা বিদেশীদের পদানত, সেখানে বিপ্লবীদের দাবীছিল জাতীয়বাদী। ডেভিড টমসন-এর মতে প্রতিটি বিপ্লব ছিল অস্ট্রিয়া বিরোধী, ভিয়েনা ব্যবস্থা বিরোধী ও মুক্তপন্থী জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত।

(iii) মধ্য ইউরোপ বিপ্লবের ঝটিকা কেন্দ্র : দেশ ও কালের বিচারে ১৮৪৮-এর বিপ্লবী ঘূর্নির্বত্যার দুটি ঝটিকা কেন্দ্র ছিল ফ্রান্স ও ইতালী। কিন্তু বিপ্লব শুরু হবার পর পরই বিপ্লবের ভরকেন্দ্র সরে গিয়েছিল মধ্য ইউরোপে৷ ডেভিড টমসন বলেছেন, প্যারিস নয়, ১৮৪৮-এর বিপ্লবের ঝটিকা কেন্দ্র ছিল মধ্য ইউরোপ ও দক্ষিণ ইউরোপের শহরাঞ্জল। পূর্ব ইউরোপে পোল্যান্ড ও রাশিয়া এবং পশ্চিম ইউরোপে বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড ইত্যাদি বিপ্লবের অভিঘাত থেকে মুক্ত ছিল। কেননা পূর্ব ইউরোপ এবং স্পেন তখনও কৃষিপ্রধান এবং শিল্পায়ন জনিত সমস্যা থেকে মুক্ত ছিল। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ শিল্প-প্রধান ছিল বটে কিন্তু সরকার শ্রমিক কল্যাণের কর্মসূচী গ্রহণ করত। ফলে সেখানে বিপ্লব ঘটেনি। তাই ডেভিড টমসন বলেছেন “বিপ্লবগুলি ছিল একান্তভাবেই মধ্য ইউরোপীয় ঘটনা” (“The revolution were pre eminently central European events.")

(iv) ক্লাবের ভূমিকা : ১৮৪৮-এর বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ক্লাব বা সমিতিগুলির সক্রিয়তা। ১৭৮৯-এর ফরাসী বিপ্লবে জ্যাকোবিন ক্লাবের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্ত্রাসের শাসনের পরবর্তীকালে ক্লাব-রাজনীতি প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৮৪৮খ্রিঃ-এর মাঝমাঝি সময় থেকে ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালি, হাঙ্গেরী, বোহেমিয়া ইত্যাদি রাজ্যে আবার ক্লাব রাজনীতির প্রত্যাবর্তন ঘটে। এই সময়ে একমাত্র প্যারিসেই প্রায় দুইশত ক্লাব গড়ে উঠেছিল যার সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০ হাজার। মে ও জুন মাসের গণ-অভ্যুত্থানে ক্লাবগুলির বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল বলে সমকালীন সাহিত্য থেকে জানা যায়।

(v) নগরকেন্দ্রিক অভ্যুত্থান ও বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব : সর্বশেষে, এই বিপ্লবগুলি ছিল নগরকেন্দ্রিক অভ্যুত্থান প্যারিস, হাঙ্গেরী, বার্লিন, মিলান, রোম, ভেনিস, ভিয়েনা, বুদাপেস্ট, বোহেমিয়া প্রভৃতি শহরগুলি ছিল বিপ্লবের ঝঞ্ঝাকেন্দ্র। পূর্ব ইউরোপের যে সব শহরের লোকসংখ্যা এক লক্ষের বেশি সেগুলিতে বিপ্লবের দাবানল প্রসারিত হয়েছে। নাগরিক, বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত ও শ্রমিকদের অসন্তোষ ছিল এগুলির মূলে। গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে বিপ্লব কোন সাড়া জাগাতে পারেনি। আবার শহরের মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবি কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই বুদ্ধিজীবিরা আটচল্লিশের বিপ্লবকে রোমান্টিকতা ও জাতীয়তার আবেগে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এঁরা সবাই ছিলেন আদর্শবাদী ও কল্পনাবিলাসী। 
Q3. ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্বের যৌতিকতা বিচার করো।
ভূমিকা : ফ্রান্সে বিপ্লব চলাকালীন রাজতন্ত্র বিলোপ করা হয়। তারপর বিপ্লবী সংবিধান রচনা করা হয়। এই সংবিধানও বাতিল করা হয়। গণভোটের মাধ্যমে National Convention বা জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এই জাতীয় সম্মেলনের অধিবেশন ১লা সেপ্টেম্বর, ১৭৯২ সালে প্রথম বসেছিল। জাতীয় সম্মেলনে প্রথম দিকে তিনটি প্রধান দল ছিল। জিরন্ডিন বা জিরডিষ্ট, জ্যাকোবিন বা মাউন্টেন এবং মডারেট বা মধ্যপন্থী। জাতীয় সম্মেলন ষোড়শ লুইকে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেছিল। একটিমাত্র ভোটের গরিষ্ঠতায় তাঁর প্রাণদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। ২১শে জানুয়ারী ১৯৯৩ সালে রাজা ষোড়শ লুই বধ্যভূমিতে প্রাণ, দিয়েছিলেন। এরপর জাতীয় সম্মেলন প্রশাসনকে চালু রাখার জন্য একটি সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি গঠন করেন। ইতিমধ্যে ফ্রান্সে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠন করা হয়। কিন্তু অস্ট্রিয়ার কাছে ফ্রান্স পরাজয় বরণ করেছিল।এরূপ পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত জ্যাকোবিনরা ক্ষমতা দখল করেছিল। এই দলের নেতাদের মধ্যে ছিলেন রোবস্পিয়ার, কুফো, এবার, সাঁ জুস্ত প্রভৃতি, তাঁরা একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এই সংবিধানকে কার্যকরী করা যায়নি। ইতিমধ্যে আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ক্ষেত্রে তারাজকতা সৃষ্টি হয়। গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। সুতরাং নতুন সংবিধান কার্যকরী করা যায়নি। সংবিধানকে মুলতুবী রেখে “সন্ত্রাসের রাজত্ব” নামে একটি জরুরী আপৎকালীন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। দেশের সংবিধান রদ করা হয়, ১৯৯৩ সালের আগষ্ট মাস থেকে ১৭৯৪ সালের জুলাই পর্যন্ত এই সন্ত্রাসের রাজত্ব চলেছিল।

✽ সন্ত্রাসের নেতৃত্ব : সন্ত্রাসের রাজত চালু হওয়ার পর জ্যাকোবিনরা দুটি সমিতি গঠন করেছিল। প্রথমটির নাম জন-নিরাপত্তা সমিতি এবং দ্বিতীয়টির নাম সাধারণ নিরাপত্তা সমিতি। এইভাবে ফ্রান্সের শাসন পরিচালনা সাঁজুস্ত, রোবসপিয়ার, কুফো প্রভৃতি নেতার হাতে চলে যায়।

✽ বিভিন্ন সংস্কার : সন্ত্রাসের রাজত্বকালে বিভিন্ন সংস্কার প্রবর্তন করা হয়, প্রথমত, যারা দেশত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে গরীব কৃষকদের মধ্যে বিক্রয় করে দেওয়া হয়, ক্ষতিপূরণ দেবার কথা আগে বলা হলেও তা বিলোপ করা হয়, দ্বিতীয়ত, গরীব লোকেদের কর লাঘব করা হয় এবং বিত্তবান বা ধনীব্যক্তিদের উপর কর বৃদ্ধি করা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারী কর ছোট ছোট কারখানার মালিক বা দোকানদারদের উপর থেকে হ্রাস করা হয়, তৃতীয়ত, Law of maximum দ্বারা জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেওয়া হয় এবং ল অব মিনিমামের মাধ্যমে সর্বনিম্ন মজুরীর হার নির্দিষ্ট করা হয়। এই আইন ভূমিহীন কৃষক, অতিদরিদ্র্য লোকেদের সাহায্য করেছিল) চতুর্থত, পরিবারের সকলের সম্পত্তির ভাগাভাগির ব্যবস্থা করা হয়, জাতীয় সেনাদলে যোগদান আবশ্যিক করা হয়, অসহায় ব্যক্তিদের আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়, এইভাবে সন্ত্রাসের রাজত্বকালে প্রকৃতই আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জনহিতকর সংস্কার প্রবর্তন করা হয় । এর ফলে সারা দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

✽ বৈদেশিক বিরোধিতা এবং আক্রমণ : এদিকে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব চলাকালীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ইউরোপের অন্যান্য রাজতন্ত্রগুলি ফ্রান্সের শিশু প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। ফ্রান্সের সেনাপতি ডুমারিয়েৎস বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুপক্ষে চলে যান। জনগণের একাংশ প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলে যায়। বৈদেশিক আক্রমণ শুরু হয়। ফ্রান্সের ব্রিটানী প্রদেশের লা ভেঁদ অঞ্চলে কৃষকদের বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। তারা সরকারী সম্পত্তির ধ্বংসসাধন শুরু করেছিল। এমনকি কর দেওয়াও বন্ধ করেছিল।

✽ সন্ত্রাসের দমন ও ব্যাপক হত্যাকান্ড : জ্যাকোবিন দল সাফল্যের সঙ্গে বৈদেশিক যুদ্ধ চালিয়েছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন—বোর্দো, লায়নস, লা ভেঁদ প্রভৃতি অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন করা হয়। রানী ম্যারী অ্যানেটানেট, মাদান বোলা, ডিউক ডাব অর্লিয়েন্স প্রভৃতি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়। এমনকি জ্যাকোবিন দলে প্রভাবশালী ব্যক্তি ডাল্টনকে গিলোটিনে মৃত্যু দন্ডাদেশ দেওয়া হয়।

✽ রোবসপিয়ারের মহাসন্ত্রাস : ডাল্টনের মৃত্যুর পর রোবসপিয়ার নিজের একাধিপত্য স্থাপন করেন। তিনি মহা সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেন। তাঁর আদেশে বহু লোককে অর্থাৎ প্রায় ৩৫-৪০ হাজার লোককে বিনা বিচারে হত্যা করা হয় । তাছাড়া বহু লোককে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এরপর রোবসপিয়ার Summary Trial! অর্থাৎ দ্রুত মামলার নিষ্পত্তির নামে বিরোধীদের একেবারে শেষ করার চেষ্টা করেন। ১৭৯৪ খ্রিঃ রোবসপিয়ারের মৃত্যুর পর সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান হয় । সন্ত্রাসের রাজত্বের সমালোচনা: সন্ত্রাসের রাজত্বের বিরুদ্ধে অনে সমালোচনা করা হয়েছে। অনেকের মতে,“সন্ত্রাসের দ্বারা বিপ্লব তার নিজ সন্তানদের গিলে ফেলেছিল।" রোবসপিয়ার নিজেকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিলেন। বিনা বিচারে অথবা বিচারের প্রহসন করে বহু ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ ব্যর্থ হয়।
Ads8
কিন্তু সন্ত্রাসের রাজত্বের সার্থকতা একেবারে ছিল না একথা বলা যায় না। পরিস্থিতির জন্যই সন্ত্রাসের রাজত্ব জন্মলাভ করেছিল। সন্ত্রাসের রাজত্বকালে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারগুলি প্রবর্তন করা সম্ভব হয়। খাদ্যদ্রব্য মূল্যের নিয়ন্ত্রণ, মজুরী আইন প্রবর্তন, জমিদারদের ক্ষতিপূরণের দাবী নাকচ, কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ প্রভৃতি কল্যাণমূলক কাজ এই সময়ে হয়েছিল। সন্ত্রাসের রাজত্ব ছাড়া বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হত না। প্যারিসের জনগণ আতঙ্কে দিন কাটিয়েছিল এইরূপ ভাববার কোন অবকাশ ছিল না। কারণ সন্ত্রাসের রাজত্বকালে প্যারিসের অপেরা ও থিয়েটার হলগুলিতে জন সমাগমের অভাব ছিল না। বিভিন্ন হোটেল এবং রেঁস্তোরাও গমগম করত ক্রেতাদের ভিড়ে। সবশেষে বলা যায় যে, সন্ত্রাসের রাজত্বকালকে সামগ্রিক ফরাসী বিপ্লবের থেকে পৃথক করে দেখলে চলবে না। এর ফলে প্রতিক্রিয়া শুরু হয় এবং সন্ত্রাসের রাজত্বের ভয়ঙ্কর দিনগুলি থেকে মুক্তি পাবার জন্য জনগণ নেপোলিয়নের স্বৈরতন্ত্রকে আহ্বান জানিয়েছিল ।

মূল্যায়ণ : প্রকৃতপক্ষে বহিঃশত্রুর আক্রমণ, আভ্যন্তরীণ প্রতিবিপ্লব, সাধারণ মানুষের শৃঙ্খলাহীনতা, অর্থনৈতিক অরাজকতা দমনের জন্য সন্ত্রাস ছাড়া কোন পথ ছিল না। স্বাধীনতাকে স্থায়ীভাবে রক্ষা করার জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সাময়িকভাবে বলি দিতে হয়। সন্ত্রাসের ফলে প্রগতিশীল সংস্কার প্রবর্তন সম্ভব হয়। কিছু লেখক সন্ত্রাসের শাসনের সময় হত্যালীলাকে অতিরঞ্জিত করেছেন। সাধারণ নিরীহ মানুষ সন্ত্রাসের কবলে পড়েনি। রবিনসনও রিয়ার্ডের মতে, সন্ত্রাসের সময় সাধারণ মানুষ আমোদ প্রমোদেই দিন কাটাত। থিয়েটার ও অপেরাগুলি পূর্ণ থাকত। সুতরাং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা সত্ত্বেও সন্ত্রাস বিপ্লবের আদর্শ রক্ষা করেছিল বলা যায়, অতঃপর ২৭শে জুলাই রোবসপিয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাঁকে গিলোটিনে হত্যা করা হলে “সন্ত্রাসের রাজত্বের” অবসান ঘটে।


animated-new-image-0047  Read More :

No comments

Hi Welcome ....