Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Top Ad

Breaking News:

latest

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? কৃষকদের উপর এর কী প্রতিক্রিয়া ছিল?

Q . চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? কৃষকদের উপর এর কী প্রতিক্রিয়া ছিল? সূচনা : লর্ড কর্ণওয়ালিসের সংস্কার কার্যাদির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল...


Q. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী? কৃষকদের উপর এর কী প্রতিক্রিয়া ছিল?
সূচনা : লর্ড কর্ণওয়ালিসের সংস্কার কার্যাদির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ১৭৬৫ খ্রিঃ দেওয়ানি লাভ করার পর থেকেই ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমিরাজস্ব সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে বিব্রত ছিল। ১৭৭২ খ্রিঃ দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটিয়ে কোম্পানি নিজ হাতে দেওয়ানি নেওয়ার পর ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথমে পাঁচসালা ও পরে একসালা বন্দোবস্ত চালু করলেও এই ব্যবস্থা নিলামভিত্তিক হওয়ায় ছিল অস্থায়ী। মূলতঃ ১৭৬৫ খ্রিঃ থেকে ১৭৮৬ খ্রিঃ পর ও পর্যন্ত যে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় সেগুলি ব্যর্থ হয়। এর থেকে কোম্পানির যেমন লাভ হয়নি তেমনি করভারে জর্জরিত প্রজাদের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ১৭৮৬ খ্রিঃ বাংলায় এসে কর্ণওয়ালিস সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির স্বার্থ সুরক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেন এবং ১৭৯৩ খ্রিঃ, ২২ শে মার্চ বাংলায় প্রবর্তন করেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (Permanent Settlement)।

✽ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি : কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে প্রবর্তক হলেও এই ধারণার উদ্ভাবক ছিলেন না। ১৭৭০ খ্রিঃ থেকেই কোম্পানির কর্তৃপক্ষের অনেকেই এই ব্যবস্থার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেন ইংরেজ মার্কেন্টাইল অর্থনীতি আলেকজান্ডার ডাভ। তিনি বাণিজ্যের উন্নতির জন্য জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে একটি যুক্তি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ফিলিপ ফ্রান্সিক জমিদারদের সঙ্গে ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গড়ে তোলার স্বপক্ষে তত্ত্ব প্রচার করেন। পিটের ভারত শাসন আইনেও জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী আইন প্রণয়নের কথা পাওয়া যায়। বিলাতের পরিচালক সভাও এ সময় কণওয়ালিসকে নির্দেশ দেয় এই অবস্থার প্রতিকার করে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের। ১৭৯০ খ্রিঃ সেকারণেই তিনি চালু করেন বাংলায় দশশালা বন্দোবস্ত এবং ১৭৯০ খ্রিঃ সেকারণেই তিনি চালু করেন বাংলায় দশশালা বন্দোবস্ত এবং ১৭৯৩ খ্রিঃ বোর্ড অব ডিরেক্টরের অনুমোদনক্রমে এই দশশালা ব্যবস্থাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হয়।

✽ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য : বিনা স্বার্থে বা উদ্দেশ্যে কোম্পানি কিংবা কর্ণওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেননি। ইতিহাসবিদ তাঁর গবেষণমূলক গ্রন্থে(বাংলাদেশের ভূমিরাজস্ব সামাজিক সমস্যা) দেখিয়েছেন কোম্পানি চারটি সুবিধালাভের আশায় সেই বন্দোবস্ত করেছিল। এগুলি হল –(ক) সরকারের প্রাপ্ত রাজস্বের পরিমাণ নিশ্চিত করা, (খ) বড় বড় জমিদার বংশগুলোর প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস করা, (গ) দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং (ঘ) কৃষির উন্নতি ঘটানো। এছাড়াও শিল্পের জন্য কাঁচামালের উৎপাদন বৃদ্ধি, বাণিজ্যের বিকাশ এর পিছনে কাজ করেছিল। সর্বোপরি কর্ণওয়ালিস আশা করেছিলেন এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা নতুন জমিদার শ্রেণি ব্রিটিশ শক্তির স্থায়িত্ব বিধানের ক্ষেত্রে সহাক শক্তিতে পরিণত হবে। সমাজে এক স্থিতিশীল শক্তি হিসাবে ব্রিটিশের স্বার্থ রক্ষা করবে। এদের ভাগ্যকে কোম্পানির শাসনের স্থায়িত্বের উপর নির্ভরশীল করতে পারলে একটি শক্তিশালী সামাজিক গোষ্ঠীকে সহায়ক শক্তি হিসাবে পাওয়া যাবে।

✽ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বৈশিষ্ট্য : এই ব্যবস্থায় বলা হয়েছিল—(১) জমিদার বংশানুক্রমিক ভাবে জমির মালিকানাস্বত্ব ভোগ করতে পারবে। (২) ১৭৯০ খ্রিঃ জমিদার ও ইজারাদাররা যেহারে রাজস্ব দিত সেই একই হারে রাজস্ব আদায় দিতে থাকবে। (৩) জমিদাররা আদায়ীকৃত রাজস্বের 
10/11 ভাগ কোম্পানিকে দিয়ে 1/11 ভাগ নিজেদের জন্য রাখতে পারবে। (৪) বাংলা বছরের শেষ দিনে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে বকেয়া রাজস্ব জমা দিতে হবে (সূর্যাস্ত আইন)। (৫) অপারক জমিদারদের জমিদারী বা জমিদারীর অংশ বিশেষ বাজেয়াপ্ত করা হবে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের স্বপক্ষে বলা হয়ে থাকে— (ক) নিয়মিতভাবে প্রতিবছর নির্দিষ্ট পরিমাণে রাজস্ব আদায় প্রশাসনিক ব্যয় বহন করার অনিশ্চয়তা দূর হয়। (খ) দেওয়ানি লাভের পর থেকে নিলাম ব্যবস্থার জন্য যে সকল দুর্নীতির (বে-আইনী, বে-নামি নিলাম ইত্যাদি) উদ্ভব ঘটেছিল তা দূর হয়। (গ) জমিতে বংশানুক্রমিক অধিকার পেয়ে জমিদার রা কৃষির উন্নতির দিকে লক্ষ্য দেয়। (ঘ) জমিতে মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক 
J.C. Marshman-এর মতে, “It was a bold, brave and wise measure.” তিনি দেখিয়েছেন এর মধ্য দিয়ে কৃষি ও শিল্পের প্রসার ঘটেছিল। R.C. Dutta মনে করেন এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল জনগণের কল্যাণের জন্য।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিপক্ষে বলা হয় শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা একটি বহু নিন্দিত ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য হয়। প্রথমতঃ রাষ্ট্র জমি থেকে চিরকালের মতো নির্দিষ্টহারে রাজস্ব পাওয়ার অধিকারী হয়। ফলে চাষির জীবনে দুঃখ কষ্টের শেষ ছিল না। দ্বিতীয়তঃ এই ব্যবস্থা জমিদার ও চাষির মধ্যে বহু মধ্যস্বত্বভোগীর জন্ম দিয়েছিল। তৃতীয়তঃ সূর্যাস্ত আইনের কঠোরতার জন্য বহু নামি, পুরাতন জমিদার বংশ লোপ পেয়েছিল। এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করতে গিয়ে 
Holmes বলেছেন, “The permanent settlement was a sad blunder."

✽ কোম্পানি, জমিদারদের উপর প্রভাব : কোম্পানির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যথাসম্ভব উচ্চহারে রাজস্ব সুনিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আদায় করা সহজ হয়েছিল। তারা বার্ষিক আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিল। তাদের পক্ষে বার্ষিক বাজেট তৈরী করা সহজ হয়েছিল। ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে পূর্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পেয়েছিল। রাজস্ব নিশ্চিত করে তারা শাসন ও বিচার বিভাগে মনোযোগনি হতে পেরেছিল। তবে ভবিষ্যতে জমি ও ফসলের মূল্য বৃদ্ধি হলেও সেই বাড়তি আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। সেকারণেই পরবর্তী সময়ে কোম্পানিকে ভারতের অন্যত্র অন্য ধরনের ভূমি বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল। 
জমিদার শ্রেণির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় তারা এই ব্যবস্থার ফলে লাভবান হয়েছিল। কোম্পানিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব মিটিয়ে নিয়ে তারা প্রভূত পরিমাণ অর্থের মালিক হতে পেরেছিল। তারা কোম্পানির অনুগত এক শক্তিতে কৃষির উন্নয়নে তারা মনোযোগী হয়েছিল। কৃষির বাণিজ্যকরণ ঘটেছিল। যদিও কেউ কেউ মনে করেন জমিদারী ব্যবস্থার ফলে কৃষির আশানুরূপ উন্নতি ঘটেনি, কেননা জমিদাররা যথেষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগে কৃষিক্ষেত্রে করেননি।

✽ কৃষকের উপর প্রভাব : রায়ত বা চাষিকে এই ব্যবস্থা সর্বাধিক প্রভাবিত করেছিল। তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সর্বাধিক। জমির মালিকানা থেকে তাদের চিরতরে বঞ্চিত করা হয়েছিল। জমির উপর প্রজাদের কোন নির্দিষ্ট স্বত্ব না থাকায় বহুক্ষেত্রেই জমিদাররা কারণে অ-কারণে চায়িকে জমি থেকে উৎখাত করতে দ্বিধা করতেন না। রায়তদের অধিকার দশ বছরের জন্য পাট্টায় লিপিবদ্ধ করে দেবেন সরকারী তরফে বলা হলেও জমিদাররা তা করেননি। খাজনার উচ্চ হার ছাড়াও অতিরিক্ত রাজস্ব রায়তের কাছ থেকে জোর করে আদায় করা হত। মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি, নায়েব-গোমস্তা ও অনুপস্থিত জমিদারদের শোষণ অব্যাহত ছিল। সবে মিলে প্রজাদের অবস্থা দিন দিন দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছিল। ডঃ নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহের মতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী করেছিল। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের মতে একটি ছিল বাংলার ইতিহাসে ‘প্রথম কালা কানুন’।

উপসংহার : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব ছিল মিশ্র। সিরাজুল ইসলাম তাঁর “
The permanent Settlement of Bengal’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন—“চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়োজীয়তার সঙ্গে বৃহৎ জমিদারীগুলির অস্তিত্ব ভিত্তিহীন হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ছোট জমিদারীগুলি কিন্তু এর দ্বারা খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।” রামমোহন জমিদার হওয়া সত্ত্বেও নিদ্ধিধায় স্বীকার করেছেন এই ব্যবস্থার ফলে কয়েকজন জমিদার লাভবান হলেও লক্ষ লক্ষ কৃষকের দুদর্শার কারণ হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধেও কৃষকদের দুর্দশার কথা ফুটে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত সরকারকে তাই ১৮৫৮ খ্রিঃ প্রজাসত্ত্ব আইন করতে হয়েছিল।

No comments

Hi Welcome ....