নীল বিদ্রোহ : (১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দ) : ভারতে নীলচাষের ইতিহাস অতি প্রাচীন। সম্ভবত ফরাসি বণিক লুই বোনার্ড ছিলেন ভারতের প্রথম নীলকর (১৭৭৭ খ্রি.) এবং ইংরেজ বণিক কার্ল ব্ল্যাম ভারতে সর্বপ্রথম নীলশিল্প গড়ে তোলেন। অষ্টাদশ শতকে শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে বস্ত্রশিল্পের প্রভূত অগ্রগতি ঘটে এবং এর ফলে ইংল্যান্ডে নীলের চাহিদা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যে নীল হয়ে ওঠে প্রধান দ্রব্য এবং কোম্পানির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে (১৭৮০-১৮০২ খ্রি.) নীল উৎপাদনে ভারত বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে। প্রথম দিকে নীলচাষে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার ছিল এবং নীলকর নামে ইংরেজ কর্মচারীদের সাহায্যে নীলচাষ করা হত। দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত এক বিশাল অঞ্চলে নীলচাষ হত এবং এর মধ্যে বাংলার নীলই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট।
❏ নীল চাষের পদ্ধতি: নীলকর সাহেবরা মোটা টাকা দিয়ে জমিদারদের কাছ থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য জমি ভাড়া করে তাতে নীলচাষ শুরু করে। প্রথমে তারা ভাড়াটিয়া লোক দিয়ে চাষ করাত। পরে তারা দেখল যে, চাষিকে দিয়ে তার নিজের জমিতে নীলচাষ করাতে পারলে লাভের সম্ভাবনা বেশি। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যশোহর, নদিয়া, পাবনা, খুলনা, ঢাকা, ফরিদপুর নীলকুঠিতে ভরে যায়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র বাংলায় নীলকুঠির সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। নীলকুঠি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় নীলকররা অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী ছিল। নিরক্ষর দরিদ্র চাষিকে মাত্র দু টাকা অগ্রিম দাদন দিয়ে তার সর্বোৎকৃষ্ট জমিতে তারা তাকে নীলচাষে বাধ্য করাত। ছলে-বলে-কৌশলে নীলকর সাহেবরা এমন চুক্তিপত্র তৈরি করত যে, চাষি সারাজীবন তাদের ঋণের চক্রে বাঁধা পড়ে থাকত এবং পুরুষানুক্রমে এই ঋণ শোধ করা তাদের সাধ্যাতীত ছিল। উৎপন্ন নীলের জন্য কৃষকদের যে-মূল্য দেওয়া হত, তাতে উৎপাদনের খরচ উঠত না। এর ওপর আবার নীলের মাপ বা ওজনেও তাদের ঠকানো হত। জমিতে ধান, তামাক, কলাই প্রভৃতি শস্যের চাষ লাভজনক হলেও, তাদের ওইসব চাষ করার অধিকার ছিল না। এইভাবে ধানচাষ বন্ধ হওয়ায় চাষির ঘরে তীব্র অন্নাভাব দেখা দেয়।
❏ নীলকরদের অত্যাচার: নীলচাষে বাধ্য করার জন্য বা উপযুক্ত নীল আদায়ের জন্য নীলকুঠির সাহেবরা দরিদ্র চাষির ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাত। তারা চাষিদের প্রহার করত, হত্যা করত, গোরুবাছুর লুট করত, গৃহে ডাকাতি ও অগ্নিসংযোগ করত, জোর করে কুঠিতে আটকে রাখত এমনকি তাদের স্ত্রী-কন্যাকে অপহরণ করে লাঞ্ছিত করতেও তারা পিছপা হত না। কেবল দরিদ্র কৃষকই নয় গ্রামাঞ্চলের সম্পন্ন কৃষক, জমিদার বা সাধারণ মানুষ কেউই তাদের অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেত না এবং এসব কাজে তাদের প্রধান সাহায্যকারী ছিল নীলকুঠির দেশীয় কর্মচারী ও লাঠিয়ালরা। এইসব অন্যায়ের প্রতিবাদে আদালতে গিয়েও কোনো ফল হত না, কারণ দেশের আইন নীলকরদের স্বার্থেই রচিত হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশরা ছিল তাদেরই সহযোগী এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নীলকররা নিজেরাই ছিল বিচারক।
❏ শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা: নীলচাষিদের ওপর এই অবর্ণনীয় নির্যাতনের প্রতিকারের উদ্দেশ্যে দেশের শিক্ষিত সমাজ এগিয়ে আসে। নীলকরদের অত্যাচারের কথা সর্বপ্রথম ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ ও ‘সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে অক্ষয়কুমার দত্ত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-য় সর্বপ্রথম এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। পরবর্তীকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মনোমোহন ঘোষ, শিশিরকুমার ঘোষ, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ প্রমুখ নীলচাষিদের নানাভাবে সাহায্য করেন ও নীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে দীনবন্ধু মিত্রের বিখ্যাত 'নীলদর্পণ' নাটক প্রকাশিত হয়। নীলকরদের অকথ্য অত্যাচারে সোনার বাংলা কীভাবে শ্মশানে পরিণত হয়েছে তারই মর্মন্তুদ চিত্র এই নাটকে পরিস্ফুট হয়েছে। বিশিষ্ট ভারতপ্রেমিক জেম্স্ লঙ্-এর উদ্যোগে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন। নীলকররা লঙ্ সাহেবের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু করে এবং বিচারে তাঁর এক মাস কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা হয়।
❏ নীল বিদ্রোহের সূচনা: ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে কৃষ্ণনগরের কাছে চৌগাছা গ্রামে বিদ্রোহ শুরু হয়। ক্রমে বিদ্রোহের আগুন সমগ্র নদিয়া, যশোহর, পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহি, খুলনা, মালদহ, মুরশিদাবাদ, দিনাজপুর, বারাসত বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং সমগ্র বাংলা বারুদের স্তূপে পরিণত হয়। প্রায় ষাট লক্ষ কৃষক সামান্য বর্শা, তরবারি, বাঁশের লাঠি ও ঢাল নিয়ে এই বিদ্রোহে শামিল হয়। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। প্রথম পর্যায়ে তারা কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের কথা জানিয়ে প্রতিকারের জন্য আবেদন জানায়। এতে ফল না হওয়ায় দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা নীলচাষ বয়কট করে। তাদের বলপূর্বক নীলচাষে বাধ্য করা হলে শুরু হয় সক্রিয় প্রতিরোধ। নদিয়ার চৌগাছা গ্রামের বিরুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস নীলচাষের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করে। বিদ্রোহী চাষিরা নীলকুঠি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দিত, পথেঘাটে নীলকরদের লাঞ্ছিত করত, তাদের দৈনন্দিন রসদের জোগান বন্ধ করে দিত এবং নীলের চারা নষ্ট করে দিত। নীল আন্দোলনের ব্যাপকতায় ভারতের বড়োলাটও বিশেষ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। লর্ড ক্যানিং স্বীকার করেন যে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের তুলনায় নীল বিদ্রোহজনিত পরিস্থিতি তাঁর অধিকতর উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠেছিল।
❏ বিদ্রোহ দমন: বিদ্রোহ দমনের জন্য সরকার উপদ্রুত অঞ্চলে পুলিশ ও মিলিটারি এমনকি যশোহর ও নদিয়া জেলায় দুটি ছোটো রণতরি পাঠায়। এই সময় ‘একাদশ আইন' পাস করে বলা হয় যে, নীলকরদের কাছ থেকে দাদন নিয়েছে এমন কৃষক নীলচাষ না করলে তাকে বিঘা প্রতি দশ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
❏ নীল বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ: কেবলমাত্র দরিদ্র কৃষকই নয়–সম্পন্ন কৃষক, জোতদার, ছোটো ছোটো জমিদার সকলেই এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। গ্রামাঞ্চলের বহু মানুষ স্থানীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করে স্থানীয় অবস্থানুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলে এই আন্দোলনকে প্রকৃত গণআন্দোলনের রূপদান করেছিল। বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দের মধ্যে নদিয়ার বিরুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস, পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালদহের ফরাজি নেতা রফিক মণ্ডল, খুলনার কাদের মোল্লা, সুন্দরবন অঞ্চলের রহিমউল্লা, কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী আসাননগরের মেঘাই সর্দার, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার এবং নড়াইলের জমিদার রামরতন রায়, সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য, রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল পালচৌধুরী, চণ্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায় প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, মনোমোহন ঘোষ, জেম্স্ লঙ্ প্রমুখ ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তির নামও বিশেষভাবে স্মরণীয়।
❏ নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি: ড. চিত্তব্রত পালিত নীল বিদ্রোহকে বাঙালি জমিদারদের সঙ্গে নীলকরদের সংঘাত বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, গ্রাম-বাংলায় নীলকরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাঙালি জমিদারদের স্বার্থে আঘাত লাগে এবং তাদের নির্দেশেই কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। বলা বাহুল্য, এই মত অধিকাংশ পণ্ডিতই অগ্রাহ্য করেছেন। আসলে এই বিদ্রোহ হল প্রকৃত গণ আন্দোলন। বাংলার ছোটোলাট পিটার গ্রান্ট একে “লক্ষ লক্ষ লোকের তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ” বলেছেন। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ লিখেছে, “এটা একটা বিদ্রোহ সমগ্র দেশই এতে যোগ দিয়েছে।”
❏ নীল বিদ্রোহের ফলাফল: নীল বিদ্রোহের ফলে (১) ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘নীল কমিশন’গঠিত হয় এবং এর ফলে নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচার জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ে। কমিশন স্পষ্ট ভাষায় বলে যে, “নীলকরদের ব্যাবসা-পদ্ধতি পাপজনক, ক্ষতিকারক ও ভ্রমসংকুল।” ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ‘অষ্টম আইন’ দ্বারা ‘নীলচুক্তি আইন’রদ করে বলা হয় যে, নীলচাষ সম্পূর্ণভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন। পরে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীল উৎপাদনের ফলে এদেশে নীলচাষ প্রায় উঠে যায়। (২) এই বিদ্রোহ পরোক্ষভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেযে সাহায্য করে। নীলকরদের অত্যাচার, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ' নাটকের প্রকাশ, লঙ্-এর কারাবাস, হরিশচন্দ্রের মৃত্যু জাতীয় চেতনাকে নানাভাবে সঞ্জীবিত করে। (৩) মার্কিন ঐতিহাসিক ব্লেয়ারকিংতাঁর ‘The Blue Mutiny’ গ্রন্থে বলেন যে, নীলকরদের পতনের ফলে নিম্নবঙ্গের কর্তৃত্ব সুদখোর মহাজনদের হাতে চলে যায়। ড. বিনয়ভূষণ চৌধুরী এই মতের অসারতা প্রমাণ করেছেন।
❏ নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব: ভারত-ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। (১) এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম কৃষক, জমিদার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। (২) এই আন্দোলনেই খ্রিস্টান মিশনারিরা সর্বপ্রথম নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে চাষিদের পক্ষ অবলম্বন করে। (৩) এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে স্বৈরাচার মাথা নত করতে বাধ্য। শিশিরকুমার ঘোষ লেখেন যে, “নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল। ইংরেজ রাজত্ব কায়েম হওয়ার পর এটাই ছিল বাংলার প্রথম বিপ্লব।” (৪) এল. নটরাজন বলেন যে, নীলচাষ করতে অস্বীকার করে বাংলার কৃষকরা ভারতে প্রথম ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করে। (৫) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন, “বাংলাদেশ তার কৃষককুল সম্পর্কে গর্ববোধ করতে পারে। শক্তি নেই, অর্থ নেই, রাজনৈতিক জ্ঞান নেই, তবুও বাংলার কৃষকেরা এমন একটি বিপ্লব সংগঠিত করেছে যাকে অন্য দেশের বিপ্লবের থেকে কি ব্যাপকতায়, কি গুরুত্বে কোনো দিক থেকে নিকৃষ্ট বলা চলে না।” অমৃতবাজার পত্রিকার মতে, “এই বিদ্রোহ অর্ধমৃত বাঙালির শিরায় স্বাধীনতার উষ্ণ শোণিত প্রবাহিত করে।”
No comments
Hi Welcome ....