Q. কয়েকজন অগ্রগন্য মহিলা শিক্ষা সংস্কারকদের ভূমিকার বিশেষ আলোচনা সহ ভারতে স্ত্রী শিক্ষা বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ের সমালোচনা মূলক বিশ্লেষন ক...
Q. কয়েকজন অগ্রগন্য মহিলা শিক্ষা সংস্কারকদের ভূমিকার বিশেষ আলোচনা সহ ভারতে স্ত্রী শিক্ষা বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ের সমালোচনা মূলক বিশ্লেষন করুন।
ঔপনিবেশিক কালপর্বে ভারতে নারী শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগ শুরু হয়। অনেকে মনে করেন প্রাচীন ভরতে নারী শিক্ষা অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার তুলনায় উন্নত ছিল। ঋকবৈদিক যুগে যেমন নারীর উচ্চ সামাজিক অবস্থান পরিলক্ষিত হয় তেমনি পরবর্তী যুগে নারী জীবনের বহু অন্ধকার ময় জীবনের উদাহরণও পাওয়া যায়। অধ্যাপিকা রোমিলা থাপার মনে করেন, প্রাচীন ভারতে নারীর অগ্রগতি কখনই সমান্তরাল ছিল না। কোথায় নরী পেয়েছিলেন মর্যদা, আবার কোথাও নারীরা ছিলেন নির্যাতিতা। সুলতানী ও মুঘল আমলে নারী শিক্ষার অগ্রগতি ছিল সীমিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই নারী মুক্তি ও স্ত্রীশিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হতে থাকে।
✽ ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে স্ত্রী শিক্ষার বিকাশ : এ সময়ে স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে যিনি অগ্রগর্ন্য ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি হলেন ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্টীও এ সময় স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল। তবে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিল মিশনারী সম্প্রদায়। ১৮১৮ খ্রিঃ বরার্টমে চুঁচুড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এরপর ১৮১৯ খ্রিঃ ব্যাপটিস্ট মিশনারীদের উদ্যোগে কলকাতায় ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে জাতিধর্ম নির্বিশেষে মেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯২৮ খ্রিঃ মধ্যে ৩০টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেবও স্ত্রী শিক্ষার সমর্থন ছিলেন।
✽ ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্ত্রী শিক্ষার বিকাশ : বাংলার নারী শিক্ষার বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান অপরিসীম। তিনি বিদ্যালয় পরিদর্শক থাকাকালীন ১৮৫৭-৫৮ খ্রিঃ নাগাদ বর্ধমান, নদীয়া, হুগলী ইত্যাদি স্থানে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তবে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে স্ত্রী শিক্ষার ভগীরথরূপে যাঁকে চিহ্নিত করা হয় তিনি হলেন জন ইলিয়ট ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন। ১৮৪৯ খ্রিঃ তিনি কলকাতায় ২১ জন বালিকাকে নিয়ে শুরু করেন ‘Calcutta Female School'। বিদ্যাসাগর ও বেথুন সাহেবের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এ সময় স্ত্রী শিক্ষার অগ্রগতি ছিল অত্যন্ত শ্ৰথ।
✽ হান্টার কমিশন : ১৮৮২ খ্রিঃ হান্টার কমিশনের মাধ্যমে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। নারীর উচ্চশিক্ষা ও সহশিক্ষা তখনও ছিল একটি বিতর্কিত বিষয়, কারণ ৯৮ শতাংশ বালিকাই তখনও যেত না। কমিশন নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য দরাজ হতে অনুদানও বৃত্তির সুপারিশ করে। পরবর্তী দুই দশকে মাধ্যমিক ও বিশ্ব বিদ্যালয়ে মেয়েদের নাম নথিভুক্ত করণের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি ঘটে, যদিও তা ছিল সমগ্র নারী জন সংখ্যার বিচারে নিতান্তই কম।
✽ তিনজন পথিকৃত : হান্টার কমিশন পরবর্তী যুগে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারে তিনজন শিক্ষাবিদ গুরুত্ব পূর্ণ অবদান রেখে ছিলেন। এঁরা হলেন পন্ডিতা রমাবাঈ, মাতাজি তপস্বিনী ও ডি,কে,কার্ভে। এই তিনজনের উদাহরণ বিশেষ তাৎপর্য পূর্ণ কারণ তাঁদের বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ধর্মসংস্কারক প্রতিষ্ঠানগুলির থেকে ভিন্ন ছিল। এ গুলি ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যালয় না হলেও, জগত, শ্রেণী ও সম্প্রদায় ভিত্তিক হলেও স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের জন্য নারীকে জড়িত করার উপর অধিক গুরুত্ব দান করেছিল।
- পন্ডিতা রমাবাঈ : পশ্চিম ভারতে স্ত্রী শিক্ষার অন্যতম পথিকৃত ছিলেন পন্ডিতা রমাবাঈ। তিনি বোম্বাইএ বিধবাদের জন্য ‘সারদা সদন’ নামক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল একটি সাম্প্রদায়িক বিদ্যালয়। এখানে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সমস্ত জাতিগত রীতিনীতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মেনে চলা হয়। গোঁড়া হিন্দু সংস্কারকদের বিরোধিতা সত্বেও তিনি এই বিদ্যালয়ের কাজ চালিয়ে যান এবং ১৯০০ খ্রিঃ মধ্যে ৮০ জন বিধবাকে নার্স ও শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করে তোলেন। ১৮৯৭ খ্রিঃ মহারাষ্ট্রে যে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয় তাতে পীড়িত নারী ও শিশুদের রক্ষার্থে তিনি ব্যাপকভাবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য কর্মমুখী শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন, যা ছিল সে যুগে অভিনব।
- মাতাজি তপস্বিনী : দক্ষিণ ভারতের রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ রিবারের কন্যা গঙ্গাবাঈ ছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দু ধর্মের সাহিত্যে সুপন্ডিত। সপন্ডিত। পরবর্তীকালে তিনি মাতাজি তরস্বিনী নামে পরিচিত হন। ১৮৯৩ খ্রিঃ কলকাতায় কোন রকম বিদেশি আর্থিক সহায়তা ছাড়াই তিনি গড়ে তোলেন মহাকালী পাঠশালা। এই পাঠশালায় পড়ানো হত ধর্মগ্রন্থ, পুরণ, কিংবদন্তী যেগুলির মধ্যদিয়ে নারীর কর্তব্য ও ধর্মকে তুলে ধরা হত। এখানে কঠোর জাতীয় ভাবধারায় বালিকাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হত।
- ধনোকেশব কার্ভে : ১৮৯০ এর দশকে পুনায় কার্ভে বেশ কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়ের পাঠক্রম বিধবাদের আত্মনির্ভর ও কর্মলাভের উপযুক্ত করে গড়ে তোলবার জন্য রচিত হয়েছিল। তবে এখানে অবিবাহিত মহিলারাও শিক্ষার সুযোগ পেত। ১৯১৬ খ্রিঃ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত পাঠ্যক্রম পরিচালিত হত মাতৃভাষায়। গৃহবিজ্ঞানের মতো বিষয় এখানে পড়ানো হত। বিংশ শতকের প্রাথমিক পর্বে স্ত্রী শিক্ষার বিকাশ : এই শতকের শুরুতেই বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও ছাত্রী সংখ্যা দারুনভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯০০ খ্রিঃ মধ্যে ‘নতুন নারী’ যারা উনিশ শতকের শিক্ষাগত সংস্কারে উপকৃত হয়েছিলেন তারা নিজেদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। এদেরই উদ্যোগে ১৯০২ সালে ৪.৫ লাখ মেয়ে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে দুজন মহিলার ভূমিকা উল্লেখ করার নতন। এরা হলেন বেগম রোকেয়া এবং সিস্টার শুভলক্ষ্মী।
(ক) বেগম রোকেয়া : ১৯০৯ খ্রিঃ তিনি ভাগলপুর জেলার মুসলিম বালিকাদের জন্য একটি বিদ্যালয় শুরু করেন। মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি কলকাতায় আসেন এবং এখানে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'। এখানে তিনধরণের শিক্ষা দেওয়া হত- সাক্ষরতা, কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতামূলক শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, গৃহবিজ্ঞান ও শারিরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলির উপরও গুরুত্ব দেওয়া হত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলের ভেতর পর্দা প্রথা ছিল না। পথধক গুরুত্ব দান করেছিল।
(খ) শুভ লক্ষ্মী : মাদ্রাজের ভগিনী শুভলক্ষ্মী প্রচেষ্টা ছিল হিন্দু পরিবারের বিধবাদের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তিদান। এগারো বছর বয়সে বাল্যবিধবা হয়ে পিতৃগৃহে চলে আসার পর শিক্ষালাভ করেন। শেষপর্যন্ত সমাজের চাপে তাঁর পরিবারকে গ্রাম ছাড়তে হয়। মাদ্রাজে এসে থাকার সময় তিনি সন্ন্যাসিনী শিক্ষিকাদের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর সেবামূলক কাজের জন্য ‘সিস্টার’ নামে সমাজে পরিচিত হন। সরকারী সাহায্য নিয়ে তিনি বাল্যবিধবাদের জন্য গড়ে তোলেন আবাসিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (১৯১২খ্রিঃ)। ১৯২২খ্রিঃ প্রতিষ্ঠা করেন ‘লেডি ওয়েলিংটন ট্রেনিং কলেজ’। অধ্যক্ষ হিসাবে এই কলেজে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে বয়স্কা বিধবাদের জন্য প্রতিষ্ঠিা করেছিলেন ‘সারদা বিদ্যালয়’ নামে আবাসিক প্রতিষ্ঠান।
উপসংহার : অলোচ্য ভারতীয় শিক্ষিত সংস্কার মনস্ক মহিলারা যে শিক্ষার প্রচলন করেছিলেন তার পাঠক্রম লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মেয়েরা গৃহবধু হিসাবে যাতে পেশাদার হয়ে উঠতে পারে সেদিকেই বিশেষভাবে গুরুত্বদান করা হয়েছিল। যদিও ওই প্রয়াস কম সংখ্যক শিক্ষিত মহিলাদের আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মেয়েদের প্রয়োজনে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান দরকার সে কথা জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়েছিল। ভারতীয় মেয়েদের উদ্যোগে মেয়েদের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের ক্ষমতার সীমা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে শেখে। উচ্চ শিক্ষায় গুরুদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ ছিল তাদের কাছে দুর্বিষহ। কিন্তু মেয়েদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় গড়ে উঠায় অভিজ্ঞতার দ্বারা ‘নতুন নারী’ বুঝেছিল সমাজের কাছে তাদের পাওনা কতটুকু।
নারী শিক্ষার জন্য আলোচ্য প্রচেষ্টাগুলি অপ্রতুল হলেও বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের পর থেকে নারী প্রগতির পথে নানা বাধা ক্রমশ সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা। কারণ এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পরে দেশীয় ভাষায় মেডিকেল শিক্ষা দেওয়া হত এমন প্রতিষ্ঠানগুলিকে বন্ধ করে দিয়ে পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্য মেডিকেল কলেজের মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ফলে দেশীয় শিক্ষা পদ্ধতি সংকটের সম্মুখীন হলেও পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি তরান্বিত হয়েছিল। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয় সমাজে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্রিটিশ শাসকেরা সফল হতে পেরেছিল। কলকাতা মেডিকেল কলেজও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
Tags : স্বাধীন ভারতে নারী শিক্ষার অবস্থান, নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য গুলি কি কি,
No comments
Hi Welcome ....