Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Top Ad

Breaking News:

latest

সিসমোগ্রাফ ও রিখটার স্কেল কী

◓ ভূকম্প বা ভূমিকম্প কাকে বলে? ▸ ভূত্বকের কেঁপে ওঠাকে বলা হয় ভূকম্প বা ভূমিকম্প। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর স্থিতিস্থাপক অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক কার...

ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপা হয় কী দিয়ে
ভূকম্প বা ভূমিকম্প কাকে বলে?
▸ ভূত্বকের কেঁপে ওঠাকে বলা হয় ভূকম্প বা ভূমিকম্প। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর স্থিতিস্থাপক অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক কারণে শিলায় পীড়নের জন্য শক্তির সঞ্চয় ঘটে। অবশেষে শিলায় ফাটল সৃষ্টির মাধ্যমে এই শক্তির আকস্মিক মুক্তি ঘটে। এই শক্তি তখন তরঙ্গের আকারে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ভূপৃষ্ঠ হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয় এরূপ আকস্মিক ও ক্ষণস্থায়ী কম্পনই হল ভূকম্প বা ভূমিকম্প।

রিখটার স্কেল কী?
▸ভূমিকম্পের তীব্রতা অর্থাৎ শক্তির মাত্রা পরিমাপের জন্য 1935 খ্রিস্টাব্দে ক্যালিফোর্নিয়ার ভূকম্পবিদ্ চার্লস রিখটার এই স্কেল উদ্ভাবন করেন। তিনি স্কেলের মাত্রাক্রম 0 থেকে 10 পর্যন্ত করেছেন। এই মাত্রাক্রম সংখ্যা বর্গমান (
Logarithmic) হওয়ায় স্কেলে 1 একক বেড়ে গেলে শক্তির পরিমাণ তার পূর্ববর্তী মাত্রা-সংখ্যার শক্তির তুলনায় 10 গুণ বেশি শক্তি নির্দেশ করে। অর্থাৎ এই স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতার মাত্রা 8-এর অর্থ হল এটি 7 মাত্রা অপেক্ষা 10 গুণ ও 6 মাত্রা অপেক্ষা 100 গুণ বেশি শক্তিশালী।

ভূমিকম্পলিখ যন্ত্র সিসমোগ্রাফ কী?
▸যে যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্পের তীব্রতা ও গতিবিধির লেখচিত্র পাওয়া যায় এবং ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়, তাকে ভূমিকম্পলিখ যন্ত্র (Seismograph) সিসমোগ্রাফ বলা হয়। 1892 সালে ভূবিজ্ঞানী জন মিলনে প্রথম ‘সিমোগ্রাফ’ যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেন।

সিসমোগ্রাফ
সিসমোগ্রাফ যন্ত্র

ভূমিকম্প পরিলেখ সিসমোগ্রা কী?  
▸সিসমোগ্রাম যন্ত্রে ভূকম্পীয় আঁকাবাঁকা তরঙ্গের যে পরিলেখ বা রেখাচিত্র পাওয়া যায়, তাকে ভূমিকম্প পরিলেখ বা (Seismogram) সিসমোগ্রাম বলা হয়। এই রেখচিত্র বামদিকে থেকে ডানদিকে অগ্রসর হয়। প্রথমে ‘P’ তরঙ্গ এবং ক্রমান্বয়ে ‘S’ ও ‘L’ তরঙ্গ লিপিবদ্ধ হয়। এর সাহায্যে ভূমিকম্পের সময়, স্থায়ীত্ব, তীব্রতা ও মাত্রা জানা যায়।

মার্কালি স্কেল বা মার্সেলি স্কেল কী?
▸ ইতালীয় ভূমিকম্প বিশারদ জুসেপ্পি মার্কালি 1902 সালে ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপার এই (Mercali Scale) স্কেল প্রণয়ন করেন। এই স্কেলের মাত্রা মান I-XII (1 থেকে 12)। পরবর্তীকালে 1931 সালে হেনরি উড ও ফ্র্যাঙ্ক নিউম্যান এই স্কেল পরিমার্জন করেন।

ইয়েন স্কেল কী?
▸ ভূ-বিজ্ঞানী ইয়েন 1828 সালে ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপের জন্য 1 থেকে 6 পর্যন্ত 6 টি তীব্রতার মানযুক্ত ইয়েন স্কেল (Yean Scale) প্রবর্তন করেন।

রোসিও-ফোরেল স্কেল কী?
▸ ইতালীয় ভূতত্ত্ববিদ Michele Stefane De Rossi ও সুইয়স প্রকৃতিবিদ্‌ Francois Alphonso Forel 1878 সালে 1-10 মানের তীব্রতাসূচক এই (Rosi-Forel Scale) স্কেল প্রবর্তন করেন।

◓ মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল কী?
▸1979 সালে টম হ্যাংকস ও হিব্র কানামোরি ভূমিরূপে নির্গত শক্তির পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য 1-10 মান বিশিষ্ট এই লগারিদম্ স্কেল প্রবর্তন করেন, বর্তমানে এটি সর্বাধুনিক ও বিশেষ জনপ্রিয়।

সমভূকম্পন রেখা কী?
▸ 'Iso’ অৰ্থাৎ ‘সমান’ এবং ‘Seismal’ অর্থাৎ ভূকম্পন। তাই সমান ভূকম্পন মাত্রা বিশিষ্ট অঞ্চলগুলিকে যোগ করলে যে কাল্পনিক রেখা পাওয়া যায়। তাকে সমভূকম্পন (Isoseismal Line) রেখা বলে । এই রেখা মার্কালি ও রিখটার স্কেল অনুসারে দেখানো হয়। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প জাপানে হয়। বছরে 7500 বার, দিনে গড়ে প্রায় 20 বার। এই জন্য জাপানকে ‘ভূমিকম্পের দেশ’ বলা হয়। এই রেখাগুলির মান উপকেন্দ্র থেকে ক্রমশ হ্রাস পায়।

সমকম্পনকাল রেখা কী?
▸ পৃথিবীর যে সমস্ত স্থানে কোনো ভূকম্পন তরঙ্গ একই সময়ে পৌঁছায়, সেইসব স্থানগুলিকে যোগ করলে যে কাল্পনিক রেখা পাওয়া যায়, তাকে সমকম্পনকাল রেখা (Homoseismal Line) বলে, এই রেখাগুলির মান উপকেন্দ্রের বাইরের দিকে ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।

সমুদ্রকম্প কী? 
▸মহাসাগর তলদেশে সৃষ্টি ভূমিকম্পকে সমুদ্রকম্প (Seaquake) বলে। জার্মান ভূবিজ্ঞানী এবারহার্ট রুডলফ 1880 সালে সর্বপ্রথম ‘সমুদ্রকম্প’ কথাটি ব্যবহার করেন। পৃথিবীর সর্বাধিক সমুদ্র ভূকম্প আটলান্টিক মহাসাগরীয় মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরায় সংঘটিত হয়।

সুনামি কী? 

‘সুনামি’ একটি জাপানি শব্দ। ‘সু’ (Tsu) শব্দের অর্থ বন্দর ও ‘নামি’ (Nami) শব্দের অর্থ ঢেউ। সুতরাং ‘সুনামি’ হল বন্দর-সংলগ্ন সামুদ্রিক ঢেউ। সুনামির উৎপত্তি প্রকৃতপক্ষে, সুনামি হল সমুদ্রবক্ষে ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট উত্তাল সমুদ্রতরঙ্গ। ভূবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সুনামি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে চলমান পাতগুলির পারস্পরিক সংঘর্ষ বা অধোগমনের ফলে সাবমেরিন ভূমিধস থেকে কিংবা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ থেকে সমুদ্রের তলদেশে তীব্র ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের সময় সামুদ্রিক ভূত্বকের স্থানচ্যুতি ঘটে। তখন সমুদ্রবক্ষ হঠাৎ নীচে বসে যায় কিংবা ওপরে উঠে যায়। সমুদ্রবক্ষের আকস্মিক ওঠা বা নামায় ভূমিকম্পের উপকেন্দ্রের সব জল সেই মুহূর্তে উঁচু হয়ে অনেক ওপরে উঠে যায়। 


এর ফলে উন্মুক্ত সমুদ্রে শত শত কিমি দৈর্ঘ্যের লম্বা ও অল্প কয়েক মিটার উঁচু সমুদ্রতরঙ্গের সৃষ্টি হয়। এই তরঙ্গ ঘণ্টায় 750 থেকে 800 কিমি বেগে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসে। এই ঢেউ যতই উপকূলের কাছে আসতে থাকে ততই এর উচ্চতা বাড়তে থাকে। সাধারণত 30 থেকে 40 মিটার উঁচু হয়ে এই ঢেউ উপকূলে আছড়ে পড়ে। ঢেউগুলি খুব বড়ো হওয়ায় তাড়াতাড়ি মিলিয়ে যায় না। সুনামির দীর্ঘ স্থায়িত্ব ও বিশাল উচ্চতার জন্য বিধ্বংসী ক্ষমত। 

উদাহরণ : 2004 সালের 26 ডিসেম্বর উত্তর সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলের অদূরে উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরে বার্মা পাতের নীচে ভারতীয় পাত প্রবেশ করায় ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টি হয়েছিল। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৪.9। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ু এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জসহ ইন্দোনেশিয়া, সুমাত্রা, জাভা, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপ, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, সোমালি প্রভৃতি 15টি দেশের দ্বীপ ও উপকূলবর্তী এলাকায় 2 লক্ষ 65 হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুর কবলে পড়ে। 2011 সালের 11 মার্চ ইউরেশীয় পাতের তলায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত প্রবেশ করায় যে ভূমিকম্প হয়েছিল তা থেকে উৎপন্ন সুনামি দ্বারা জাপানে জীবনহানি ও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভূকম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে 9.2

◓ ভারতের ভূমিকম্প অঞ্চল (Earthquake Zone of India) :
ভূমিকম্পের তীব্রতা অনুযায়ী ভারতবর্ষকে মোটামুটি পাঁচটি ভূকম্প-প্রবণ অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যথা, (i) অতি অল্প, (ii) অল্প, (iii) মধ্যম, (iv) অধিক এবং (v) অত্যধিক ভূকম্প প্রবণ অঞ্চল। শেষোক্ত দুটি অঞ্চল সমগ্র হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের অন্তর্গত। পশ্চিমে নাঙ্গা পর্বত থেকে পূর্বেনামচাবারওয়া পর্যন্ত প্রায় 2,500 কিমি দীর্ঘ ও প্রায় 500 কিমি প্রশস্ত এই হিমালয় অঞ্চলে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্প হয়ে থাকে। আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ, মণিপুর, ত্রিপুরা, মিজোরাম সহ সমগ্র উত্তর-পূর্বের পার্বত্য এলাকা—অত্যধিকভূকম্প-প্রবণ অঞ্চল। এছাড়া, বিক্ষিপ্তভাবে উত্তর বিহার ও গাড়োয়াল (উত্তরাঞ্চল) অঞ্চলও অত্যধিক ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চল 

Earthquake Zone of India
Earthquake Zone of India

সমগ্র হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলটি অত্যন্ত ভূকম্প-প্রবণ হওয়ার কারণ হল—(i) এখনও পর্যন্ত পর্বত গঠন প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে, ফলে, দুটি মহাদেশীয় পাতের সংঘর্ষে ভূমিকম্প প্রায়শই হয়। (ii) ভারতীয় পাত তিব্বতীয় পাতের ভিতর প্রবেশ করতে থাকায় পর্বতশীর্ষে শিলায় পীড়ন জমতে থাকে। এই পীড়ন থেকে মুক্তিলাভ ঘটাতে শিলায় ফাটল ধরেও ভূমিকম্প হয়। (iii) এই অংশে চ্যুতি-সৃষ্টির ফলে ভূমিকম্প হয়। (iv) হিমানী সম্প্রপাতের জন্য উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। (v) মনে করা হয় যে, সমস্থিতিক ভারসাম্য অবস্থায় আসার জন্যও হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। 1993 সালে মহারাষ্ট্রের লাতুর ও ওসমানাবাদে এবং 2001 সালে গুজরাতের ভুজ অঞ্চলে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
সর্বাধিক হয়েছিল।

◓ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস (Forecast of Earthquake): ভূমিকম্পের পূর্বাভাস যে ভাবে দেওয়া যেতে পারে তা হল (1) উন্নত যন্ত্রের সাহায্যে শিলার স্থিতিস্থাপক ধর্মের পরিবর্তনের সঙ্গেভূকম্প-তরঙ্গবিস্তারের গতিবেগের পরিবর্তন পরিমাপ করে। (2) ভূমিকম্প ঘটার পূর্বে উপকেন্দ্র অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ হেলে যাওয়ার প্রতি লক্ষ রেখে।(3) অগ্রবর্তী কম্পন পরবর্তী ভূমিকম্প সম্বন্ধে যে নির্দিষ্ট কিছু ইঙ্গিত দেয়, তা বিশ্লেষণ করে। (4) শিলার তড়িৎ-প্রতিরোধ, চৌম্বকত্ব, সচ্ছিদ্রতা, জলচাপ ও অন্যান্য ভৌতধর্মের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে।(5) কূপের জলের র‍্যাডনের পরিমাণ ও এর তাপমাত্রার তারতম্য ও জলপৃষ্ঠের পরিবর্তন পরিমাপ করে।(6) জীবজন্তুর অস্বাভাবিক আচার-আচরণ লক্ষ করে।

◓ ভূমিকম্পের কারণ (Causes of Earthquake) : ভূমিকম্প বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে। এই কারণ গুলিকে দুটি মুখ্য শ্রেণিতে ভাগ করা যায়—
(ক) প্রাকৃতিক কারণ
(খ) কৃত্রিম কারণ। 
(ক) প্রাকৃতিক কারণ (Physical causes): প্রাকৃতিক বিভিন্ন শক্তি ও প্রক্রিয়ার ফলে তীব্র থেকে মৃদু ভূমিকম্প হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক কারণকে পুনরায় দুটি উপবিভাগে ভাগ করা যায়, যথা—(1) ভূ গাঠনিককারণ (Tectonic) ও (2) অ-ভূগাঠনিক কারণ (Non-Tectonic)।

(1) ভূ-গাঠনিক কারণ (Tectonic causes): মহিভাবকও গিরিজনি আলোড়ন হল প্রধান ভূগাঠনিক আলোড়ন। এই দুই আলোড়নের সম্মিলিত প্রভাবে শিলায় ভাঁজ পড়ে ও চ্যুতির সৃষ্টি হয়। তাই চ্যুতি বরাবর শিলাস্তূপ স্থানচ্যুত হলে কিংবা শিলা প্রবল ভাবে ভাঁজ প্রাপ্ত হতে থাকলে ভূকম্পনের সৃষ্টি হয়, একে ভূগাঠনিক ভূমিকম্প বলে। এধরনের ভূমিকম্পে নদীর গতিপথের পরিবর্তন ঘটে। ব্রহ্মপুত্র নদী এজন্য তার গতি পথ বদলেছে। এছাড়া সুনামির উৎপত্তিও ঘটায়। বিভিন্ন ভূগাঠনিক কারণ গুলি হল—

(i) পাত-ভূগাঠনিক কারণ : পৃথিবীর ভূত্বক বড়ো ছয়টি ও ছোটো কুড়িটি মহাদেশীয় ও সামুদ্রিক পাত নিয়ে গঠিত। এই পাতগুলি চলমান। ফলে একটি পাতের সঙ্গে আর একটি পাতের সংঘর্ষে বা ঘর্ষণে শিলা চ্যুতি ঘটে এবং পাত সীমানা বরাবর প্রবল ভূমিকম্প হয়। একে পাত ভূগাঠনিক কারণ বলা হয়। এ-জাতীয় ভূমিকম্প খুব শক্তিশালী হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প ঘটে বিভিন্ন পাত-সীমানা বরাবর। যেমন- 
  • প্রতিসারী বা গঠনকারী সীমানায় ভূমিকম্পের কারণ : প্রতিসারী পাত সীমানায় দুটি পাত পরস্পরের থেকে দূরে সরে যায়। দুই পাতের মাঝখান দিয়ে ম্যাগমা ভূগর্ভ থেকে একেবারে উপরে উঠে আসে এবং সামুদ্রিক শৈলশিরার আশেপাশে মহাসাগরের তলদেশ গঠন করে। ম্যাগমার উত্থানে শিলায় প্রবল চাপ পড়ে ও প্রতিসারী পাত সীমানা বরাবর ভূগর্ভস্থ শিলায় ফাটল ধরে, চ্যুতি হয় ও ভূমিকম্প ঘটে। মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরা বরাবর এ ধরনের ভূমিকম্প ঘটে।
  • অভিসারী বা ধ্বংসাত্মক পাত সীমানায় ভূমিকম্পের কারণ : অভিসারী পাতসীমানায় দুটি পাত পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসে। ফলে দুটি পাতের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এছাড়া অপেক্ষাকৃত হালকা পাতের নীচে ভারী পাতটি জোর পূর্বক ঢুকে যায় ও ঢুকে যাওয়া অংশটি ধ্বংস হয়। এজন্য ভূআলোড়ন, চ্যুতি ও অগ্ন্যুৎপাত ঘটে এবং প্রবল ভূকম্প অনুভূত হয়। 26 শে ডিসেম্বর 2004 সালে বার্মা পাতের নীচে ভারতীয় পাত প্রবেশ করায় তীব্র ভূমিকম্প ও সুনামি ঘটেছিল।
  • নিরপেক্ষ পাত সীমানায় ভূমিকম্পের কারণ : নিরপেক্ষ পাত সীমানায় দু’টি পাত পরস্পরের গা ঘেঁসে একে অন্যকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় ৷ পাশ কাঠানোর সময় দুটি পাতের অন্তর্বর্তী কিনারায় ব্যাপক শিলাচ্যুতি ঘটে এবং প্রবল ভূমিকম্প হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে একারণে ভূমিকম্প ঘটে।
(ii) নবীন ভঙ্গিল পর্বতের উত্থান : গিরিজনি আলোড়নের প্রভাবে প্রবল পার্শ্বচাপে পর্বতের উত্থান ঘটে এবং শিলাচ্যুতি হয় । ফলে, ভূকম্প অনুভূত হয়। 1950 সালে আসামে ভূমিকম্প এভাবে হয়েছিল। (iii) আগ্নেয়গিরি-জনিত কারণ : আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ ও ছিদ্র পথ দিয়ে উত্তপ্ত গ্যাস, লাভা প্রভৃতি বের হওয়ার সময় ভূত্বকে প্রচণ্ড চাপ দেয় তখন ভূত্বক কেঁপে ওঠে। কখনো কখনো প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভূ-অভ্যন্তর থেকে এসব পদার্থ বেরিয়ে এলে ভূকম্প হয়। এছাড়া লাভার গহ্বরে চাপের ফলে আগ্নেয়গিরির মধ্যে চ্যুতি হয় এবং লাভা বেরিয়ে আসার পর গঠিত শূন্যস্থানে ধস ইত্যাদি ঘটলে ভূমিকম্প হয়। (iv) ভূ-অভ্যন্তরেসংকোচন : পৃথিবী জন্মের পর থেকেই তাপবিকিরণ করে সংকুচিত হচ্ছে। এখনও পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগে তাপবিকিরণ প্রক্রিয়া চলছে। ফলে, শিলাস্তরের ওপর ক্রমাগত টান ও পীড়ন উৎপন্ন হওয়ায় ভূমিকম্প ঘটে।

(v) সমস্থিতিক ভারসাম্য : পর্বত, মালভূমি, সমভূমি ও ভূত্বকের অন্যান্য অংশগুলি ঘনত্ব অনুসারে ঊর্ধ্বগুরুমণ্ডলের ওপর ভাসমান অবস্থায় আছে। এরূপ অবস্থায় এরা একটি ভারসাম্য বজায় রাখে যাকে সমস্থিতি বলা হয়। কিন্তু ম্যাগমার অনুপ্রবেশ, ভূত্বকীয় পাতের অনুপ্রবেশ প্রভৃতি কারণে শিলাঘনত্বের পার্থক্য ঘটলে এবং একস্থানে ক্ষয় ও ক্রমাগত অন্যত্র সঞ্জয় ঘটলে এই সমস্থিতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং তখন ভূকম্প অনুভূত হয়। একে সমস্থিতিক বা সমস্থৈতিক ভূকম্প বলে। 1949 সালে লাহোরে এধরনের ভূকম্প ঘটেছিল। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলেও এজন্য ভূমিকম্প ঘটে।

(2) অ-ভূগাঠনিক কারণ (Non-Tectonic) : ভূত্বকের কোনোরূপ গঠন ছাড়াই যে যে কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে, সেই কারণগুলিঅ-ভূগাঠনিক কারণের অন্তর্গত। এগুলি হল — (i) ভূগর্ভ গহ্বরের ধস : ভৌম জলের দ্রবণ ক্রিয়ার ফলে নীচ থেকে শিলা বা বস্তুর অবলম্বন সরে যায়। তখন ভূমির উপরিভাগ বসে গেলে আঞ্চলিকভাবে কম্পন সৃষ্টি হয়। সাধারণত কার্স্ট অঞ্চলের গহ্বরে এরূপ কম্পন ঘটে থাকে। (ii) সমুদ্র তরঙ্গের আঘাত : সমুদ্র সৈকত বরাবর তরঙ্গের প্রবল আঘাতে যেমন কম্পন অনুভূত হয়, তেমনি তরঙ্গের প্রবল আঘাতে বলপূর্বক শিলাতে ভাঙন ধরলে বা শিলা ফেটে গেলে ভূকম্পন হয়। (iii) শিলাপতন, হিমানী সম্প্রপাত প্রভৃতি : সাধারণত পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়শই ঢাল বেয়ে বড়ো বড়ো চাঁইয়ের শিলার পতন ঘটলে, হিমানী সম্প্রপাত হলে এবং বিশাল আকারে ভূমিধস ঘটলে মৃদু ভূকম্প হয়। 1911 সালে তুর্কিস্তানের ভূমিকম্প ভূমিধসের ফলে হয়েছিল। (iv) উল্কাপাত : খুব বড়ো মাপের উল্কাপিণ্ড ভূপৃষ্ঠে সজোরে আছড়ে পড়লে, ভূমিকম্পের সৃষ্টি হতে পারে। (v) জলপ্রপাত : খুব বড়ো মাপের জলপ্রপাতের প্রচুর জল একসঙ্গেঅনেক উঁচু থেকে নীচে প্রবল বেগে আছড়ে পড়লে, কম্পন অনুভূত হতে পারে।

(খ) কৃত্রিম কারণ (Artificial Causes) : মানুষের বিভিন্ন কার্যাবলির জন্যও ভূমিকম্প ঘটে। যেমন— (1) জলাধার নির্মাণ : নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণ করলে জলাধারের জলরাশির প্রবল চাপে ওই অঞ্চলের শিলাস্তরে সমস্থিতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। ওই চাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিলাস্তর ভারসাম্য অবস্থায় আসতে চায়; ফলে, ভূমিকম্প হয়। 1935 সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা প্রদেশে মিয়াদ হ্রদে হুভার বাঁধ নির্মাণের ফলে পরবর্তী দশ বছরে ওই অঞ্চলে প্রায় 600 বার ভূমিকম্প হয়েছিল। 1967 সালে 10ই ডিসেম্বর মহারাষ্ট্রের কয়না বাঁধে সঞ্চিত জলরাশির চাপে ভূমিকম্প হয়েছিল।

(2) পারমাণবিক পরীক্ষানিরীক্ষা : পারমাণবিক পরীক্ষানিরীক্ষার কারণে ভূগর্ভে শক্তিশালী বোমা ফাটানো হয়। প্রবল বিস্ফোরণে আশে পাশের অঞ্চল খুব জোরে কেঁপে ওঠে। 1974 ও 1999 সালে রাজস্থানের পোখরানে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণে ওই অঞ্চলের অসংখ্য বাড়িতে ফাটলের সৃষ্টি হয়।

(3) ডিনামাইট বিস্ফোরণ : খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিশেষত পার্বত্য অঞ্চলে সুড়ঙ্গ নির্মাণ এবং সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করতে ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় । ফলে, মৃদু ভূকম্পন সৃষ্টি হয় । ভূগর্ভ থেকে খনিজ সম্পদ (কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি) উত্তোলনে বিশাল বিশাল গহ্বরের সৃষ্টি হয়। গহ্বরের উপরের ছাদ ধসে গিয়ে ভূকম্পন ঘটে । এছাড়া, ট্রেন ও ভারী ট্যাঙ্ক চলাচলের সময়ে, কলকারখানার ভারী যন্ত্রপাতি চললে হালকা কম্পন অনুভূত হয়।


◓ ভূমিকম্পের ফলাফল ( Effects of Earthquake) :
(ক) ভূমিরূপগত পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় : (1) শিলার চ্যুতির ফলে ভৃগু সৃষ্টি ও ভূমিঢালের পরিবর্তন হতে পারে। (2) চ্যুতি রেখা বা ফাটল দিয়ে বিদার অগ্ন্যুদগম হতে পারে। গ্যাস, কাদা, গরম বাষ্প বেরিয়ে আসতে পারে। (3) ভূমিধ্বস ও ভূভাগের অবনমন ঘটে, জমি উঁচু-নীচু হয়ে যায়। সমুদ্র অথবা হ্রদের নিকট ভূখণ্ড বসে গেলে বন্যা ঘটে, সব কিছু জলের তলায় চলে যায়। 1819 সালে কচ্ছের রান অঞ্চল’ বসে গিয়ে জলাভূমির সৃষ্টি করেছে। (4) নদীর গতি পথের পরিবর্তন ঘটতে পারে। 1950 সালে অসমে দিবং নদী পুরানো খাত ছেড়ে নতুন খাতে বইতে শুরু করেছিল। (5) ভৌম জল প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। নতুন প্রসবনের সৃষ্টি হতে পারে।(6) নির্দিষ্ট কিছু অনুকূল অবস্থায় বালির বাঁধ গড়ে উঠতে পারে। (7) আগ্নেয় গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হতে পারে।(৪) সমুদ্রে প্রবল জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি হতে পারে। (9) বনভূমি ধ্বংস হতে পারে।

(খ) সংস্কৃতিক ও মানবিক বিপর্যয় :  (1) চাষের জমি নষ্ট হতে পারে।(2) ঘরবাড়ি, বাঁধ, খুঁটি, বেড়া, টাওয়ার, সেতু, পথঘাট ভেঙে পড়ে রেলপথ সরে যায় বেঁকে যায় বা দোল খেয়ে যায়। (3) জলের পাইপ, গ্যাস পাইপ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। (4) বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে আগুন লাগতে পারে। (5) সর্বোপরি মানুষ ও গৃহপালিত জীবজন্তুর প্রাণহানি ঘটতে পারে।



No comments

Hi Welcome ....