Gourbango b.a history notes 2nd semester in Bengali version ❐ আরো পড়ুনঃ B.A History ৫ মার্কের ইতিহাস নোটস প্রশ্ন উত্তর Q .বাতাপীর চা...
Gourbango b.a history notes 2nd semester in Bengali version
❐ আরো পড়ুনঃ B.A History
Q.গুপ্ত যুগকে 'সুবর্ণ'যুগ' বলা হয় কেন?
অথবা, ভারতের ইতিহাসে গুপ্তযুগকে সুবর্ণযুগ বলা কতটা যথার্থ তা লেখো?
Q.গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা করো।
Q.পল্লব রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতে সাংস্কৃতিক বিকাশ কিরূপ হয়েছিল?
অথবা, পল্লব কারা? পল্লবদের শিল্প ও স্থাপত্যের উপর একটি প্রবন্ধ রচনা করো।
Q.গুপ্ত যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করো।
history of india ba history notes 2nd semester question answer
Q. বাতাপীর চালুক্য কারা? এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় পুলকেশীর কৃতিত্ব আলোচনা করো।
❐ ভূমিকা : দাক্ষিণাত্যের চালুক্য বংশ খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠশতকের মধ্যেভাগে একটি শক্তিশালী শাসক বংশে পরিণত হয়। এই চালুক্য বংশের চারটি শাখার কথা জানা যায়। (১) বাতাপীর চালুক্য, (২) বেঙ্গীর চালুক্য, (৩) কল্যাণের চালুক্য এবং (৪) গুজরাটের চালুক্য। সম্ভবত এরা বাতাপির চালুক্যের বংশধর ছিলেন। এই বংশের প্রথম স্বাধীন নরপতি ছিলেন প্রথম পুলকেশী। তাদের রাজধানী ছিল বিজাপুর জেলার বাতাপী নগরে।
❐ চালুক্যদের পরিচয় : চালুক্যদের পরিচয় কি তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত বিরোধ আছে। স্মিথ মন্তব্য করেন এরা ছিল বহিরাগত গুর্জর বা চাপদের বংশধর এবং কোন এক সময় রাজপুতানা হতে দাক্ষিণাত্যে আসে। অনেকে আবার চালুক্যদের দাক্ষিণাত্যের প্রাচীন কনোড়ী বংশজাত বলে মন্তব্য করেন। চালুক্যরা অবশ্য নিজেদের রাজপুত জাতির একটি শাখা বলে দাবী করে। ঐতিহাসিকদের মতে অবশ্য এ দাবীর কোন ভিত্তি নেই। ঐতিহাসিকগণের মতামত ছাড়াও কিংবদন্তী অনুসারেও চালুক্যদের পরিচয় পাওয়া যায়। জনশ্রুতি আছে চালুক্যরা ছিল মনুর বংশধর। অন্য একটি মতানুসারে প্রথম চালুক্য বিজয়াদিত্যের পূর্ব পুরুষরা দক্ষিণ অন্ধ্রদেশে রাজত্ব করতেন। কৃষ্ণানদী তীরের হিরণ্যরাষ্ট্র ছিল বিজয়াদিত্যের আদি বাসভূমি। সেই হিসেবে চালুক্যরা দক্ষিণ ভারতের আদি নিবাসী। ডঃ ডি. সি. সরকার স্মিথের মত পরিহার করে এই মতকে স্বীকার করেন। ডঃ আর. সি. মজুমদারও চালুক্যদের দাক্ষিণাত্যের প্রাচীন কানাড়ী বংশজাত বলে মত প্রকাশ করেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং চালুক্যদের দক্ষিণের ক্ষত্রিয় বলে উল্লেখ করেছেন।
❐ চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সিংহাসন আরোহণ :
৫৩৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম পুলকেশী বাতাপিপুরায় চালুক্য রাজশক্তির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর চালুক্য সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র প্রথম কীতিবর্মন। কীতি বর্মনের মৃত্যুর পর তাঁর । ভ্রাতা মঙ্গনেশ ৫৯৭ খ্রী: চালুক্য সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু মঙ্গনেশ নিজ পুত্রকে সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা করলে চালুক্য রাজবংশে দেখা দেয় উত্তরাধিকার যুদ্ধ। কীতি বর্মনের পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশী গৃহযুদ্ধে তাঁকে নিহত করে ৬১০ খ্রীঃ সিংহাসনে বসেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান তাঁর সভাকবি রবি কীর্তি রচিত আইহোল লিপি।
❐ রাজ্যজয় : আইহোল প্রশস্তি অনুসারে সাম্রাজ্যবাদী দ্বিতীয় পুলকেশী প্রথমেই প্রতিবেশী রাজ্য জয়ের দিকে দৃষ্টি দেন। দক্ষিণে তিনি কাদম্ব ও মহীশুরের গঙ্গ বংশীয় নৃপতিদের পরাস্ত করেন। কোঙ্কণের মৌর্য রাজাগণ তাঁর হাতে পরাজিত হন। গুজরাটের বলভী রাজবংশ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে। মালবের রাজন্য বর্গও তাঁর বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন। তাঁর কাবেরী নদী অতিক্রম করার সংবাদে আতঙ্কিত হয়ে চোল, কেরল, পাণ্ড্য রাজাগণও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। দ্বিতীয় পুলকেশী পল্লব রাজ প্রথম মহেন্দ্র বর্মনকে পরাস্ত করেন। দ্বিতীয় পুলকেশীর এই কৃতিত্বের ফলে দক্ষিণ ভারতের এক বিশাল অংশ চালুক্য রাজছত্রের অধীনে চলে আসে।
❐ হর্ষবর্ধনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব : দ্বিতীয় পুলকেশীর রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সংঘর্ষ। ডঃ আর. সি. মজুমদার উল্লেখ করেছেন পুলকেশীর গুজরাট দখল ভারতীয় রাজনীতির একটি বিশেষ ঘটনা। কারণ এর পরই হর্ষবর্ধনের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষের প্রেক্ষাপট তৈরী হয়। গুজরাট ও মালবে হর্ষ আক্রমণের উদ্যোগ গ্রহণ করলে এই অঞ্চলের শাসকগণ দ্বিতীয় পুলকেশীর অধীনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। অসন্তুষ্ট পুলকেশী হর্যের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। স্মিথের মতে নর্মদার তীরে তাঁদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হর্ষবর্ধনের পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
❐ দ্বিতীয় পুলকেশীর পরাজয় : দ্বিতীয় পুলকেশী মাত্র ৩২ বছর রাজত্ব করেছিলেন। সুতরাং তাঁর সাফল্য বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে গল্পবদের পরাজিত করতে সক্ষম হলেও তাদের হাতেই তাঁর পতন ঘটে। পরাজিত পল্লবরা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে পল্লব রাজ প্রথম নরসিংহ বর্মনের নেতৃত্বে পুলকেশীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। আইহোল লিপি অনুসারে ডঃ মহালিঙ্গম উল্লেখ করেছেন প্রথম অবস্থায় প্রথম নরসিংহ বর্মন পরাজিত হন। কিন্তু পল্লব সেনা এরপর রাজধানী বাতাপী আক্রমণ করে দখল করে নেন। পরাজিত পুলকেশী নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই বাতাপীর চালুক্যদের পতন শুরু হয়।
❐ কৃতিত্ব : ঘোর সাম্রাজ্যবাদী শাসক দ্বিতীয় পুলকেশী প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন। উত্তরে গুজরাট থেকে দক্ষিণ পাণ্ড্য রাজ্য পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তিনি ‘রণবিক্রান্ত’, ‘পৃথিবী বল্লভ’, ‘পরমেশ্বর ’প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর ভূয়সী প্রসংসা করেছেন। তিনি ছিলেন প্রজাহিতৈষী শাসক। পারস্যের সাথেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। হর্ষের সমসাময়িক দ্বিতীয় পুলকেশীকে ‘দক্ষিণাগথ’ আভিধায় ভূষিত করা যায় তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক কৃতিত্ব বিচার করে।
Q.গুপ্ত যুগকে 'সুবর্ণ'যুগ' বলা হয় কেন?
অথবা, ভারতের ইতিহাসে গুপ্তযুগকে সুবর্ণযুগ বলা কতটা যথার্থ তা লেখো?
❐ ভূমিকা : গুপ্ত যুগ ভারতীয় ইতিহাসের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। প্রতিভাবনগুপ্ত শাকদের কৃতিত্বে যেমন একটি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তেমনি তাঁদের সুশাসনের ফলে দেশে শান্তি, শৃঙ্খলা আর্থিক সমৃদ্ধি প্রভৃতির সাফল্যজনক বিকাশ ঘটেছিল। রাজনৈতিক ঐক্যের পাশাপাশি সাহিত্য, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভারতীয় মনীষার শতদল প্রস্ফুটিত হয়েছিল। একটি যুগে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিকাশের এই প্লাবন লক্ষ্য করে কোন কোন ঐতিহাসিক গুপ্তযুগকে ‘সুবর্ণ যুগ’ বলে অভিহিত করেন। ভিনসেন্ট স্মিথ ও বার্ণেট এই যুগকে যথাক্রমে ইংল্যাণ্ডের এলিজাবেথীয় যুগ ও গ্রীসের পেরিক্লিসের যুগের সাথে তুলনা করেছেন।
❐ রাজনৈতিক ঐক্যঃ গুপ্ত শাসনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সাম্রাজ্যের সংহতি। কেন্দ্রিকরণ ও বিকেন্দ্রিকরণ নীতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে গুপ্ত সম্রাটরা যে ভাবে প্রগতিশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন ও সাম্রাজ্যিক ঐক্য বজায় রাখেন, ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল।
❐ উদারনৈতিক শাসন ব্যবস্থা : ফা-হিয়েন -এর বর্ণনা থেকে গুপ্ত শাসনের উদার নৈতিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। জনসাধারণের জীবন ছিল স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ। ফৌজদারী আইনের কঠোরতা ছিলনা বললেই চলে।
❐ সাহিত্য : গুপ্তযুগে বহুসংখ্যক দিকপাল কবি সাহিত্যিক দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছিল। এ যুগ ছিল সংস্কৃত সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। এই যুগে এই ভাষার পূর্ণবিকাশ ঘটে। সম্রাট সমুদ্র গুপ্ত নিজেই সুপণ্ডিত, সুগায়ক ছিলেন। তিনি 'কবিরাজ' উপাধি লাভ করেছিলেন। তাঁর সভাকবি হরিষেণ রচিত ‘এলাহাবাদ প্রশক্তি’ এই যুগের একটি অমরসৃষ্টি। দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্তের নবরত্নের অন্যতমরত্ন ছিলেন কালিদাস। তাঁর রচিত ‘কুমার সম্ভবম্’, রঘুবংশম্’, ‘মেঘদূতম', 'অভিজ্ঞান শকুন্তলম্বি শ্বসাহিত্যের আকাশে এক একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। 'মৃচ্ছকটিক' রচয়িতা শুদ্রক, মুদ্রারাক্ষস রচয়িতা বিশাখদত্ত পানীনি, পতঞ্জলী, বসুবন্ধু, কুমারিল ভট্ট প্রমুখের আবির্ভাব ঘটেছিল এযুগেই যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি, কাত্যায়ন স্মৃতি, নারদ স্মৃতি,বৃহস্পতি স্মৃতি প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রগুলি এযুগেই রচিত হয়। দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণ বলেছেন দর্শন চিন্তার ক্ষেত্রে গুপ্তযুগে বহু মৌলিক তত্ত্বের সৃষ্টি হয়।
❐ জ্ঞান বিজ্ঞান: জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও গুপ্ত যুগে প্রতিভার চরম বিকাশ ঘটেছিল। গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন, ধাতুবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে প্রতিভার উৎকর্ষতা ছিল অভূতপূর্ব। জ্যোতির্বিদ আর্যভট্ট, ‘গোলাধ্যায়ী’ গ্রন্থে প্রথম পৃথিবীর গতি সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। ‘পঞ্চসিদ্ধান্ত’, ‘বৃহৎসংহিতা' প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা বরাহমিহির এ যুগেই আবির্ভূত হন। ধন্বন্তরী, বানভট্ট এই যুগেই তাঁদের চিকিৎসা সংক্রান্ত গ্রন্থগুলি রচনা করেন।
❐ ধাতু বিজ্ঞান : ধাতু বিজ্ঞানেও গুপ্ত যুগ উন্নত ছিল। দিল্লীর কুতুব মিনারের কাছে প্রাপ্ত চন্দ্ররাজ নামাঙ্কিত লৌহ স্তম্ভটি এক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত। খোলা আকাশের নীচে দেড় হাজার বৎসর থাকা সত্বেও এতে এতটুকু মরিচা পরেনি। নালন্দা, বিহার প্রভৃতি স্থানে প্রাপ্ত তামা, ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলি এক্ষেত্রে আরো উল্লেখযোগ্য সাক্ষ্য।
❐ স্থাপত্য ও শিল্পকলা : স্থাপত্য ও শিল্পকলার বিকাশও ছিল বিস্ময় সৃষ্টিকারী। উত্তর প্রদেশের ঝান্সী জেলার দেওগরের পাথরের তৈরী দশাবতার মন্দির, কানপুরের ভিটারগাঁওয়ের ইঁটের তৈরী মন্দির, সারানাথ একলিঙ্গ মন্দির প্রভৃতি গুপ্ত স্থাপত্য শিল্পকলার চরম নিদর্শন। অজন্তা, ইলোরাতেও উন্নত স্থাপত্য কলার নিদর্শন পাওয়া যায়।
❐ শিক্ষাদীক্ষা : গুপ্ত রাজারা শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তাঁদের পৃষ্টপোষকতায় প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। নালন্দা, তক্ষশীলা, সারনাথ প্রভৃতি শিক্ষালয়ে উচ্চশিক্ষার সুবন্দোবস্ত ছিল।
❐ ভাস্কর্য : ভাষ্কর্য শিল্পের ক্ষেত্রেও এযুগ কোন অংশে কম ছিল না। গান্ধার শিল্পের প্রভাব মুক্ত নব ভাষ্কর্য রীতি এ যুগেই গড়ে ওঠে। পুরাণ ও বৌদ্ধ বিষয়ক বস্তুই ছিল গুপ্ত ভাষ্কর্যের মূল বিষয়।
❐ চিত্রশিল্প : এ যুগের চিত্রকলা এক অনন্য সম্পদ। বর্ণে ও রেখায়, ভাবে ও ব্যঞ্জনায়, বিষয়বস্তুতে এগুলি সত্যিই তুলনাহীন। অজন্তা গুহার মাতা-পুত্র, তরিণ চতুষ্টয় সত্যিই অপূর্ব। চিত্রগুলি জল রং-এ অঙ্কিত।
❐ ধর্ম: মৌর্য ও তার পরবর্তী ৬০০ বছর ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু গুপ্ত যুগে রাজ পৃষ্টপোষকতায় হিন্দু ধর্ম পুনরায় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। সে কারণে অনেকে গুপ্তযুগকে ‘হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের যুগ’ বলেন। অনেক ঐতিহাসিক অবশ্য এর বিরোধীতা করেছেন।হিন্দু ধর্মানুরাগী হলেও গুপ্ত রাজারা পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন।
❐ অর্থনৈতিক অবস্থা : রাজনৈতিক সুশাসন গুপ্তযুগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটিয়ে ছিল। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যের বিকাশ এক সমৃদ্ধশালী অর্থনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছিল।
❐ উপসংহারঃ আপাত আলোচনায় গুপ্তযুগকে সমৃদ্ধশালী এক যুগ হিসেবে মনে হয়। সে কারণে পণ্ডিতগণের অনেকে এযুগকে ‘সুবর্ণ যুগ’ বলে চিহ্নিত করেন। কিন্তু বর্তমানে এ ব্যাপারে প্রশ্ন উঠে গেছে। রোমিলা থাপার বলেছেন এ যুগের সভ্যতা সংস্কৃতি ছিল সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষের জন্য সৃষ্ট—নিম্ন শ্রেণীর মানুষের এর সাথে কোন সম্পর্ক ছিলনা। ডি. ডি. কোশাম্বী এ প্রসঙ্গে বলেছেন গুপ্তযুগে সমাজের উচ্চ শ্রেণী নিম্ন শ্রেণীর থেকে নিজেদের পৃথক রাখার জন্য ও উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে সৃষ্ট ধনী শ্রেণী আভিজাত্য রক্ষার জন্য সংস্কৃত ভাষাকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাবে জাতিভেদ প্রথা সমাজে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রাই সকল সুবিধার অধিকারী হয়। প্রদীপের নিচে অন্ধকারের ন্যায় গুপ্ত যুগে সমাজের উচ্চ স্তরের আলোক প্রাপ্তির আড়ালেই থেকে যায় নিম্ন ও বঞ্চিত শ্রেণীর হতাশা ও অন্ধকারময় জীবন।
Q.গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি আলোচনা করো।
❐ ভূমিকা : ইতিহাসে কোন সাম্রাজ্যই চিরস্থায়ী নয়। সাফল্য ও বিস্তৃতির শিখরে আরোহণ করলেও কালের অমোঘ নিয়মে একদিন সকলকেই ধ্বংসের মুখোমুখি হতে হয়। আকস্মিক কোন ঘটনা নয়, বিভিন্ন কারণেই এই পতন সূচীত হয়। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় যে গুপ্ত সাম্রাজ্য সাফল্যের শিখরে আরোহন করেছিল, ব্রাষ্টায় পঞ্চম শতকের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে তা বিলুপ্ত হয়। বিভিন্ন কারণ এর জন্য দায়ী ছিল।
❐ রাজবংশের অন্তর্কলহ ও অক্ষমতা : রাজ সিংহাসন নিয়ে গুপ্ত রাজবংশে অন্তদ্বন্দ্ব গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের একটি প্রধান কারণ। প্রথম কুমার গুপ্তের মৃত্যুর পর পুরু গুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের মধ্যে বিবাদ শুরু হয় বলে অনেক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরবর্তীকালেও চলতে থাকে। এই পর্বে পুরুগুপ্ত, দ্বিতীয় কুমার গুপ্ত, বুধ গুপ্ত ছাড়া অপর শক্তিশালী গুপ্তরাজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালের গুপ্ত সম্রাটদের অকর্মন্যতা ও দুর্বলতায় সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির যে ক্ষতি হয়েছিল তার ফলে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না।
❐ পৃষ্যমিত্র ও হুণজাতির আক্রমণ : গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ পুষ্যমিত্র ও হুণদের ন্যায় বৈদেশিক জাতি সমুহের ক্রমাগত আক্রমণ। প্রথম কুমার গুপ্তের আমলে পুষ্যমিত্রদের আক্রমণ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল। স্কন্দগুপ্তের আমলে হুণ জাতির আক্রমণ সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তির উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। যদিও স্কন্দগুপ্ত এই আক্রমণগুলি প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তবুও পরবর্তীকালে তাদের আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে হুণ আক্রমণকে গুপ্তদের পতনের প্রধান কারণ বলেও মনে করলেও ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর মতে এই আক্রমণকে প্রধান কারণ বলা যায় না। তা শুধু পতনকে তরান্বিত করেছিল মাত্র।
❐ প্রাদেশিক শাসকদের স্বাধীনতা ঘোষণাঃ বৈদেশিক দুর্বলতার সুযোগে মান্দাশোরের শাসনকর্তা যশোবর্মন গুপ্ত রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর বলভীর মৈত্রকরা, কনৌজের মৌখরীগণ, মগধে পরবর্তী গুপ্তবংশ ও অন্যান্য প্রদেশিক শাসকরা একে একে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে শুরু করে। ডঃ আর. সি. মজুমদার এই ঘটনাকেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন, হুণ আক্রমণকে নয়।
❐ অর্থনৈতিক বিপর্যয় : অর্থনৈতিক দুর্বলতা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ। একদিকে আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও অন্যদিকে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ভেঙে পড়ে। স্কন্দগুপ্ত ও তাঁর পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটদের মুদ্রায় এই প্রকার সংকটজনক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় মেলে। স্কন্দগুপ্ত রাজত্বের শেষ দিকে খাদ মেশানো স্বর্ণমুদ্রা প্রবর্তন করতে বাধ্য হন। আরও পরবর্তীকালে তামা ও ব্রোঞ্জের মুদ্রা অপেক্ষা স্বর্ণ মুদ্রার আধিক্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের ইঙ্গিত বহন করে। বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসকরা স্বাধীনতা ঘোষণা করার ফলে রাজকোষে ঘাটতিও দেখা দেয়। খ্ৰীষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে রোম সাম্রাজ্য ধ্বংস হলে রোমের সঙ্গে বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
❐ স্থায়ী সেনাবাহিনীর অভাব : গুপ্তদের কোন স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। এজন্য তাঁরা সম্পূর্ণ ভাবে সামন্ত শাসকদের উপর নির্ভরশীল ছিল। সেনাবাহিনীর উপরে সামন্তদেরই নিয়ন্ত্রণ ছিল— সম্রাটের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নয়। ফলে সামরিক শক্তির দুর্বলতা ছিলই যা গুপ্তদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
❐ সামন্ত প্রথা : গুপ্ত যুগে সরকারী কর্মচারীরা বেতন হিসাবে ভূমি পেতেন এবং তাদের পদ ছিল বংশানুক্রমিক। এর ফলে যে সামন্ত প্রথা গড়ে ওঠে তা ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের বুনোটকে শিথিল করে দেয়।
❐ ধর্মীয় কারণ : গুপ্তরাজারা ছিলেন হিন্দুধর্মে ও সমরনীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু পরবর্তী গুপ্তরাজাদের মধ্যে বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব তাদের মনে রণোন্মাদনা হ্রাস করে। এর ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি বিশেষভাবে হ্রাস পায়। হিউয়েন সাং-এর রচনা থেকে জানা যায় হুণনেতা মিহিরকুলের আক্রমণ কালে গুপ্তরাজ বালাদিত্য যুদ্ধ করার পরিবর্তে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। 'আর্যাঞ্জুশ্রী মূলকল্প” নামক বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায় বালাদিত্য মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী হিসেবে এটি কাম্য হলেও রাজা হিসেবে কখনোই যথোচিত নয়।
ডঃ এইচ. সি. রায়চৌধুরী গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণ হিসেবে মন্তব্য করেছেন আকস্মিক কোন কারণে গুপ্ত বংশের পতন ঘটেনি— এর পেছনে কারণ গুলি ছিল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ, বংশানুক্রমিক প্রাদেশিক শাসনকর্তা, গুপ্ত রাজপরিবারে বিদ্রোহ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী সৃষ্টি প্রভৃতি।
❐ উপসংহারঃ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও ভারত ইতিহাসে এই সাম্রাজ্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ শাসন ব্যবস্থা — এই দুই দিকের মধ্যে যে সমন্বয় গুপ্তযুগে দেখা গিয়েছিল তা সত্যিই দৃষ্টান্ত স্বরূপ। গুপ্তযুগের সভ্যতা সংস্কৃতির উজ্জ্বলতা ও ভারত ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ।
Q.পল্লব রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতে সাংস্কৃতিক বিকাশ কিরূপ হয়েছিল?
অথবা, পল্লব কারা? পল্লবদের শিল্প ও স্থাপত্যের উপর একটি প্রবন্ধ রচনা করো।
❐ ভূমিকা : দক্ষিণ ভারতে পল্লব শাসনকাল দ্রাবিড় সাংস্কৃতিক নবজাগরণ এবং বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছিল। পল্লব রাজত্বকালে দক্ষিণ ভারতে তামিল অনুষ্ঠিত অঞ্চলে সংস্কৃত চর্চার ব্যাপকপ্রসার, উত্তর ভারতীয় বৈদিক ধর্ম, বৈষ্ণব মতবাদ, জৈন ধৰ্ম, শৈব ধর্ম এবং এই ধর্মগুলিকে আশ্রয় করে মঠ নামে ধর্মীয় আশ্রমিক সংগঠনের বিকাশ এবং ভক্তিরস ভিত্তিক তামিল সাহিত্যের এবং মন্দিরগুলিকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃত চর্চার বিকাশ সাধিত হয়েছিল। তাছাড়া পল্লব রাজাগণ শিল্প ও ভাস্কর্যের একান্ত পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা তামিল অঞ্চলের স্থাপত্য শিল্প, ভাস্কর্য এবং চিত্র শিল্প উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। পল্লবযুগে দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো উত্তর ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও রীতিনীতির সাথে দক্ষিণ ভারতের তামিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মিশ্রণ। অনেকে মনে করেন যে পল্লবযুগে দক্ষিণ ভারতে আর্যীকরণ হয়েছিল। কিন্তু এই প্রকার বক্তব্যের দ্বারা পল্লব যুগের তামিল সংস্কৃতির পূর্ণ ব্যাখ্যা সম্ভব হয় না। পল্লবযুগে সুপ্রাচীন তামিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মিলন সংগঠিত হয়েছিল, যদিও এই মিলনে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পক্ষ ছিল উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি। তবে একথাও স্মরণযোগ্য যে পল্লবঘুগে দক্ষিণ ভারতীয় নিজস্ব দ্রাবিড় সংস্কৃতিও যে মোটেই অবহেলিত হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় এযুগের তামিল সাহিত্যের অভূতপূর্ব বিকাশে।
❐ ধর্মীয় বিকাশ : অষ্টম শতকে ভারতে যে ধর্ম সংস্কার আন্দলোনের প্রবল ঢেউ প্রবাহিত হয়েছিল তার আদি উৎস ছিল পল্লব রাজ্য। দক্ষিণ ভারতে উত্তর ভারতীয় জৈন ধর্মের অনুপ্রবেশ ইতিপূর্বেই সংগঠিত হলেও পল্লব রাজত্বকালে এই ধর্মের উল্লেখযোগ্য বিকাশ সাধিত হয়েছিল। জৈনধর্ম প্রচারকগণ এবং সাধকগণ সংস্কৃতকেই ধর্মীয় ভাষা রূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং মাদুরাই ও স্কাঞ্চি নগরীতে সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। সংস্কৃত চর্চার সাথে সাথেই জৈন সাধকগণ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্মের সাথে প্রতিযোগীতার জন্য প্রাকৃত এবং তামিল ভাষাকেও শিক্ষা এবং ধর্ম প্রচারের মাধ্যম রূপে গ্রহণ করেছিলেন। জৈনগণ প্রথমদিকে পল্লব রাজাদের অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। কিন্তু পল্লব রাজ মহেন্দ্র বর্মণ জৈন ধর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই সময় থেকেই তামিল অঞ্চলে জৈন ধর্মের প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে শুরু করেছিল।
পল্লব শাসন কালে তামিল অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্মের ও বিরাট পুনরুত্থান ঘটেছিল। হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের অনুষঙ্গ রূপে তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলের মন্দির গুলিতে সংস্কৃত ভাগ। ও শাস্ত্র শিক্ষার জন্যে বিদ্যালয় গঠিত হয়েছিল। রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন যে মন্দির সংলগ্ন এই প্রকার সংস্কৃত বিদ্যালয়কে ঘেটিকা নামে অভিহিত করা হতো। প্রথম দিকে এই সকল ঘেটিকায় সকল বর্ণের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল, কিন্তু কালক্রমে শুধু ব্রাহ্মণ দেরই ঘেটিকায় শিক্ষা লাভের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। পল্লব যুগে তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলে পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের উত্থানের সাথে সাথে মঠ নামে একপ্রকার ধর্মীয় সংগঠন গড়ে উঠেছিল। রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন যে দক্ষিণ ভারতে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবপুষ্ঠ হয়ে হিন্দু ধর্মেও মঠ প্রথা প্রাধান্য লাভ করে। এই সকল মঠ ছিল একধারে মন্দির, শিক্ষার কেন্দ্র এবং ধর্মীয় আলোচনার কেন্দ্র স্বরূপ। মঠগুলিকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ভারতে দুইটি প্রধান ভক্তিবাদী ধর্মীয় ধারা গড়ে উঠেছিল। এর একটি ছিল শৈব ধর্ম ভিত্তিক এবং অপরটি বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। শৈব পন্থী সাধকগণ নায়নার নামে পরিচিত ছিল। এই সকল সাধকগণ ভক্তিবাদী শৈবধর্মাশ্রিত বহু সঙ্গীত তামিল ভাষায় রচনা করেছিলেন। এই রচিয়তা শৈবসাধকদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন।
অপপর, শাভান্ডার, মানিক্কবাসতার প্রভৃতি। শৈব সাধকদের ন্যায় বৈষ্ণব সাধকগণও তামিল ভাষায় বহু স্রোত্র রচনা করেছিলেন। এই সকল বৈষ্ণব সাধক কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নামম্মালবার এবং আন্ডাল। ভক্তিবাদী শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্মের এই প্রকার উত্থাণের প্রসঙ্গ রোমিলা থাপার একটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, তামিল অঞ্চলে ভক্তিধর্মের এই প্রকার উত্থান প্রকৃতপক্ষে আর্যীকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। অবশ্য কালক্রমে আর্যধর্ম এবং ভক্তিবাদের মধ্যে একটি সহযোগীতা মূলক মীমাংসায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছিল। উত্তর ভারতীয় ধর্মের অনুষঙ্গ রূপে পল্লবযুগে ঘেটিকা গুলিতে সংস্কৃত চর্চার যে সূচনা হয়েছিল, সেই সংস্কৃত চর্চা উচ্চতর বিদ্যায়তন পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। মঠগুলিতেও তামিল ভাষার সাথে সাথে সংস্কৃত চর্চা ছিল। তবে সংস্কৃত চর্চার পীঠস্থানে পরিণত হয় কাঞ্চী নগরী। কালক্রমে কাঞ্চী সংস্কৃত বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত চর্চার ধারা সমসগ্র দক্ষিণ ভারতেই প্রসারিত হতো। এইজন্যে কাঞ্চী নগরীকেদক্ষিণ ভারতের বারানসী নগর নামে অভিহিত হয়েছে।
❐ সাহিত্য : পল্লব যুগে দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃত ভাষা এবং সাহিত্য চর্চা ও তার সাথে সাথে ধ্রুপদী তামিল সাহিত্য চর্চার ও অভূতপূর্ব বিকাশ হয়েছিল। মন্দির, মঠ এবং কাঞ্চী বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মশাস্ত্র চর্চার সাথে সাথে ভাষা, অলংকার, ছন্দ প্রভৃতি শিক্ষারও প্রসার হয়েছিল। তারই দলশ্রুতি রূপে দক্ষিণ ভারতে সংস্কৃত গদ্য এবং কাব্যসাহিত্য উভয়ই সমৃদ্ধ হয়। দ্বিতীয় নরসিংহ বর্মণের সভাকবি দন্ডিন ছিলেন সংস্কৃত গদ্য সাহিত্যের পথিকৃৎ। সিংহ বিষ্ণুর রাজসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন উত্তর ভারতের বিখ্যাত সংস্কৃত কবি হারবি। দণ্ডিনের উক্তি থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে দক্ষিণ ভারতে কালিদাসের জনপ্রিয়তাও উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রসার লাভ করেছিল। কাঞ্চীর বিভিন্ন মন্ডবে মহাভারতের রীতি মতো আবৃতি এবং আলোচনা অনুষ্ঠিত হতো। কুরম নামক স্থানে ১৪৮ টি পরিবার বেদ চর্চায় রত ছিলেন কিন্তু শুধু সংস্কৃত ভাষারই প্রসার ঘটেনি, পল্লবযুগে তামিল সাহিত্যেরও অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছিল। পরবরাজ মহেন্দ্র বর্মণ তামিল ভাষায় মত্তবিলাস প্রহসন নামে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া ন্যায়নার এবং অলর অর্থাৎ শৈব এবং বৈষ্ণব ভক্তিবাদী সাহিত্যিকগণ তামিল কাব্য সাহিত্যিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন।
❐ ভাস্কর্য: পল্লবযুগে তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থাপত্য শিল্প একটি উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। অবশ্য ঐতিহাসিকগণ এই যুগের স্থাপত্য শিল্পকে পল্লব-চালুক্য স্থাপত্যরীতি নামে অভিহিত করেছেন। পল্লবযুগে, দক্ষিণ ভারতে পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ এবং তার সাথে সাথে গঠিত মন্দির নির্মাণ পদ্ধতি উভয়ই অনুসৃত হয়েছিল। রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন যে পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ পদ্ধতি প্রধাণত বৌদ্ধ অনুপ্রেরণাতেই গড়ে উঠেছিল। তবে এই পদ্ধতি দ্রাবিড় রীতি নামে পরিচিত ছিল। পল্লব যুগের স্থাপত্য শিল্পকে কতগুলি নিয়মিত ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে যথা -(১) মহেন্দ্ররীতি, (২) মামল্য রীতি, (৩) রাজ সিংহ রীতি এবং (৪) অপরাজিতা রীতি। মহেন্দ্র রীতিতে নিরেট পাহাড়কে গোলাকৃতি ভাবে কেটে গুহামন্দির নির্মাণ হতো। এর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো কাঞ্চীর একেশ্বরনাথ মন্দিরের স্তম্ভগুলি। মামল্য রীতি অনুসারে নিরেট গ্রানাইট পাথর বা পাহাড় খোদাই করে রথের আকারে অথবা গুহার আকারে মন্দির নির্মাণ করা হতো। মামল্য পুরমের সমুদ্রতীরের অবস্থিত পাঁচটি রামমন্দির এবং শৈব মন্দির এর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এই সকল পাঁচটি রথ মন্দির মহাভারতের পান্ডবদের নামে উৎসর্গীকৃত হয়েছিল। এছাড়াও এই যুগের গঙ্গাবতরণ ভাষ্কর্যের মধ্যেও মামল্য রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। রাজসিংহ রীতির মন্দির পাহাড় খোদাই করে নির্মাণ করা হতো না, বরং উত্তর ভারতে ভাষ্কর্য রীতি অনুসরণ করে গেঁথে তোলা হত। কাঞ্চীর এই প্রকার গঠিত মন্দির এবং মামল্যপুরমের একটি মন্দির এই রীতির বিশিষ্ট উদাহরণ কাঞ্চীর কৈলাস নাথ মন্দির ও বৈকুন্ঠপেরুমল মন্দির এই রীতি অনুসারে নির্মিত হয়েছিল। অপরাজিতা মন্দির নির্মাণ রীতি নবম শতক থেকে প্রসারিত হয়ে চোল স্থাপত্য রীতির সাথে মিশে গিয়েছিল। রোমিলাথাপার উল্লেখ করেছেন যে এই সকল মন্দিরে বহির্গাত্র অলংকরণের জন্যে ভাষ্কর্য শিল্প ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ দেওয়াল চিত্রিত করার জন্যে চিত্রিকলারও বিকাশ সাধিত হয়েছে। এমনকি ভাষ্কর্য এবং চিত্রকলার নিয়মিত চর্চার জন্যে তামিলভাষায় বহুগ্রন্থ এইযুগে রচিত হয়েছিল।
Q.গুপ্ত যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করো।
❐ ভূমিকা : প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় গুপ্তযুগ এক স্মরণীয়কাল। বিভিন্ন উপাদান যথা- মুদ্রা,লিপি, ফা-হিয়েন এর বিবরণ, স্মৃতিশাস্ত্র প্রভৃতি থেকে এই যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস জানা যায়।
❐ সামাজিক জীবন বর্ণপ্রথা ও চতুরাশ্রম :
জাতিভেদ প্রথা গুপ্তযুগে প্রকটভাবে প্রচলিত ছিল। হিন্দুসমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে বিভক্ত ছিল। ‘চতুরাশ্রম' প্রথাও সমাজে প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন বর্ণের সংমিশ্রণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পিতাই ছিলেন পরিবারের সর্বময় কর্তা।
❐ ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব : গুপ্ত যুগে সমাজে ব্রাহ্মণরা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করত ও তাদের আদর্শ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট ছিল। স্মৃতিশাস্ত্রে ব্রাহ্মণদের দ্বিজ ও পবিত্র বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণরা সমাজের প্রধান স্বরূপ ছিলেন। তাঁরা শিক্ষা ও ধর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। রাজারাও ব্রাহ্মণের প্রতি সম্মান জানাতেন। তাঁদের অর্থ ও জমিদান করার রীতি প্রচলিত ছিল।
❐ বিবাহ ব্যবস্থা : বর্ণভেদ প্রথার কঠোরতা সত্বেও গুপ্তযুগে আন্তবর্ণ বিবাহ প্রচলিত ছিল। প্রধাণত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত ছিল। বহু বিবাহেরও প্রমাণ মেলে। রাজ পরিবারেও বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল। তবে ধর্মকার্যে কেবলমাত্র প্রধান মহিষীই অংশগ্রহণ করতে পারতেন।
❐ নারীর অবস্থা : গুপ্ত সমাজে নারীর স্থান উন্নত ছিল। নারীরা শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতেন। নারী শিক্ষালয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। নারী স্বাধীনতা ছিল ও সমাজে সতী প্রথা প্রচলিত ছিল। গুপ্তযুগে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত উভয় বয়স্কা নারীর বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। নারদ স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে বিধবাদের পুনঃ বিবাহের কথা বলা আছে। উচ্চবর্ণের লোকেরা একাধিক বিবাহ করত। স্ত্রী ধনের উল্লেখ পাওয়া যায়। নারী স্বাধীনতার কথা বলা হলেও নারীরা পুরুষের অধীনেই থাকত।
❐ আমোদ প্রমোদ : ধনী ও স্বচ্ছল লোকেরা সাহিত্য রচনা, চারুকলা, নাট্য শাস্ত্রচর্চা প্রভৃতি করে বিলাস-বাসনে দিন কাটাতো। নৃত্য, গীত ছিল বিনোদনের মাধ্যম। ধনীদের মধ্যে মদের প্রচলন ছিল। ‘কথাসরিবৎসাগর’-এ নারীদেরও মদ্য পানের অধিকার ছিল বলা হয়েছে। গুপ্ত সমাজে নৈতিকতার মান খুব উন্নত ছিল না।
❐ দাস প্রথা : গুপ্তযুগেও দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। মনু ও নারদ স্মৃতিতে দাসদের দানের কথা বলা হয়েছে। দুঃভিক্ষের সময়ে স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করা হতো বলে 'নারদ স্মৃতি' থেকে জানা যায়। যুদ্ধ বন্দীদেরও দাসে পরিণত করা হতো। আইনের চোখে দাসদের কোন অধিকার না থাকলেও ধর্মশাস্ত্রে দাসদের প্রতি মানবিক আচরনের কথা বলা হয়েছে।
❐ অর্থনৈতিক অবস্থাঃ প্রাচীন ভারতে চিরাচরিত অর্থনৈতিক চরিত্র অনুসারে গুপ্ত যুগের অর্থনীতির ও প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষি, শিল্প এবং বাণিজ্য – বিশেষত রোমান বাণিজ্য।
❐ কৃষি : ভূমি রাজস্বই ছিল গুপ্ত যুগে রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস। কৃষি জমিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হতো। ১) রাষ্ট্রীয় মালিকানায় অনাবাদি জমি, ২) রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়মিত কৃষি জমি, ও ৩) ব্যক্তিগত মালিকানায় জমি। তত্বগত ভাবে রাজাছিলেন সকল জমির মালিক। তিনি প্রথম শ্রেণীর জমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দান করতেন। রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর জমি থেকে রাজস্ব।
❐ রাজস্ব ব্যবস্থা : গুপ্তযুগের রাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তবে মোটামুটি যে কর প্রচলিত ছিল তা হলো ‘ভাগ’ বা ভূমি কর, উৎপন্ন ফসলের ১/৬ শতাংশ, ভোগকর বা চুঙ্গি কর গ্রাম ও শহরের কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করা হতো; তৃতপ্রত্যয় বা আবগারী শুল্কঃ শিল্পজাত দ্রব্যের উপর থেকে আদায় করা হতো। এছাড়াও ‘বিষ্টি’ নামক বিনা পারশ্রমিকে শ্রমদানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ফেরীঘাট, লবণকর, গোচারণ কর প্রভৃতিও আদায় করা হতো। বৈদেশিক আক্রমণের সময় ‘মল্ল’ কর নামে অতিরিক্ত কর আদায় করা হতো।
❐ শিল্প : ‘গুপ্তযুগ বিভিন্ন প্রকার শিল্পে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। রেশম ও কার্পাস বয়ন শিল্প ছিল এর মধ্যে প্রধান। বাংলায় সুক্ষ্ম সুতীবস্ত্র ও দক্ষিণ ভারতের লিনেন জাতীয় সুতী বস্ত্র শিল্প ও বস্ত্র রঞ্জক শিল্প গড়ে উঠেছিল। হাতীর দাঁতের কারুশিল্প, প্রস্তর শিল্প, ধাতু ঢালাই শিল্প, সোনা রূপার অলংকার শিল্প, মৃৎ শিল্প ছিল অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিল্প। সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রা ছিল এই যুগের বিনিময়ের মাধ্যম।
❐ বাণিজ্য : গুপ্তযুগের সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীন বাণিজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে, সিংহল, সুমাত্রা, জাভা, আফগানিস্থান, পারস্য, আরবদেশ সমূহের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য চলত। মালব, সৌরাষ্ট্র, ব্রোচ বা ভারুজ বন্দর, কল্যাণ বন্দর, উজ্জয়িনী নগরী, কোঙ্কন উপকূল প্রভৃতি বন্দর দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য চলত, আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নদী পথে ও স্থল পথে বারানসী, মথুরা, সারনাথ পাটলীপুত্র, উজ্জয়িনী, নাসিক, পৈথান, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি সংযুক্ত ছিল। মুক্তা, চন্দন কাঠ, সিল্ক বস্ত্র, বিভিন্ন বিলাস দ্রব্য ভারত রপ্তানী করত। ভারত বিদেশ থেকে অশ্ব আমদানী করত। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত বণিক ও শিল্পীদের নিগমগুলি। ব্যবসা বাণিজ্যের রাজনিয়ন্ত্রন প্রায় ছিলই না কিন্তু তিনি ১/৫ হারে পণ্য শুল্ক আদায় করতেন।
No comments
Hi Welcome ....