Q. 1970- এর দশক পর্যন্ত ভারতে শ্রমিক ইতিহাস চর্চার ধারাগুলির বর্ণনা সম্পর্কে লেখ? ভূমিকা : ভারতে শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ও শ্রমিক আন্দোলনের সূচ...
Q. 1970-এর দশক পর্যন্ত ভারতে শ্রমিক ইতিহাস চর্চার ধারাগুলির বর্ণনা সম্পর্কে লেখ?
ভূমিকা : ভারতে শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ও শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা যে সময়ে হয়, সেই একই সময়ে সাম্রাজ্যবাদর বিরোধি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। তাই শ্রমিক ও তাদের আন্দোলন মূলধারার ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি তেমনভাবে আকর্ষণ করেনি। জাতীয়তাবাদী, সাম্রাজ্যবাদীও নয়া সাম্রাজ্যবাদী কোন গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক শ্রমিক শ্রেণির গুরুত্ব বা জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা সম্বন্ধে বিশেষ শ্রদ্ধা পোষণ করেন না।✽ শ্রমিক ইতিহাস চর্চার সূচনা : বিষয় হিসাবে শ্রমিক ইতিহাসচর্চা ভারতবর্ষে শুরু হয় মোটামুটিভাবে 1920-র দশক থেকে। প্রথম দিকে শ্রমিক আন্দোলনের তুলনায় শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থা, তাদের কাজের অবস্থা খাদ্য, বাসস্থান ও সংশ্লিষ্ট সমস্যাই প্রধানত অর্থনীতিবিদ ও সমাজতত্ববিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তখনও ঐতিহাসিকরা এই বিষয়ে খুব দৃষ্টিপাত করেননি। এই পর্বের উল্লেখযোগ্যকারি গবেষকদের মধ্যে আছেন রজনীকান্ত দত্ত, দেওয়ান চমললাল, বি.শিবা রাও, বি.আর. শেঠ প্রমুখ। স্বাধীনতা উত্তরকালে ধারায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন রাধারমন মুখার্জী, কে. পি. চট্টোপাধ্যায় রঘুনাথ সিং প্রমুখ। অধিকাংশ গ্রন্থে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা আলোচিত হয়েছে।
✽ মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি : প্রথাগত মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা সবসময় শ্রমিকের শ্রেণি সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিলেও এই ধরনের রচনাশৈলীর উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। রজনীপাম দত্তের (ইন্ডিয়া টুডে 1940) সময় থেকে মার্কসবাদী লেখকরা প্রতিটি ধর্মঘটকেই শ্রেণি সচেতনতার প্রকাশ ও শ্রেণি সংগ্রামের প্রত্যক্ষ উদাহরণ বলে গণ্য করতে চেয়েছেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ই.জে. হবসম শ্রমিক শ্রেণি ও তাদের আন্দোলন, আন্দোলন ও সংগঠন, সংগঠন ও নেতৃত্বকে একাসনে বসানোর নামে সামাজিক বাস্তবকে অস্বীকার করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সুকোমল সেন প্রথম মার্কসবাদি লেখক যিনি ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের একটি বিস্তারিত কালানুক্রমিক বর্ণনা দিয়েছেন। প্রসিদ্ধ মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী ও সংগঠক অধ্যাপক সুনীল সেন সম্ভবত মার্কসীয় শ্রমিক ইতিহাস চর্চার সর্বশেষ সংযোজন।
✽ শ্রমিক আন্দোলন চর্চায় নতুন ধারা : ভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এক যুগান্তর আসে 1970-এর দশক থেকে। যখন বেশ কয়েকটি নতুন গবেষণা প্রকাশিত হতে শুরু করে। শ্রমিক আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণে বেশ কিছু নতুন ধারার সৃষ্টি হয়। অন্য একটি হল ব্যাপক সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে না গিয়ে সময় অঞ্চল ও শিল্পভিত্তিক অনেক সীমাবদ্ধ নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা। বোম্বাই-এর সূতাকল শ্রমিকরা ঐতিহাসিকদের সম্প্রতিকালে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই প্রসঙ্গে আর এস চন্দ্রভারকার এর ‘দ্য অরিজিন্স অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজম ইন ইন্ডিয়া’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এই গ্রন্থে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত প্রায় একশো বছরের পরিধিতে আলোচনা বিস্তৃত করলেও কালানুক্রমিক বর্ণনার বদলে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য হল শ্রমিক মণি, রাজৈ নেতৃত্ব, পুঁজিপতি শ্রেণি ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রশক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের জটিলতা অন্বেষণ করেছেন।
✽ তুলনামূলক গবেষণা : শ্রমিক ইতিহাসচর্চার আর একটি নতুন ধারা হল পাশাপাশি ও কাছাকাছি অবস্থিত একাধিক শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা, যেমন, ইয়ামন মার্ফি দক্ষিণ ভারতের চারটি সূতাকল অঞ্চলের শ্রমিকদের নিয়ে, জানকী নায়ার মহীশূর রাজ্যের কোনার স্বর্ণখনি ও ব্যাঙ্গোলরের সূতাকল শ্রমিকদের নিয়ে। নির্বাণ বসুর পলিটিক্স অ্যান্ড প্রটেস্ট গ্রন্থে বাংলার সূতাকল, চা বাগান, কয়লাখনি ইস্পতি। শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা।
✽ নিউম্যানের দৃষ্টিভঙ্গি : নিউম্যান মনে করেন যে, বোম্বাইয়ের সূতাকলের ক্ষেত্রে 1930 দশকের মধ্যভাগের আগে পর্যন্ত বাইরের নেতৃত্বে শ্রমিকদের কাছে পৌঁছতেই পারেনি। ততদিন পর্যন্ত শ্রমিকরা তাদের চিরায়ত নেতৃত্ব অর্থাৎ সর্দারের দ্বারাই চালিত হত। সর্দারদের ভূমিকা ছিল দ্বিমুখী। প্রথমতঃ কর্তৃপক্ষের প্রতিভু হিসাবে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। দ্বিতীয়তঃ শ্রমিক সংগঠক, হিসাবে এই শ্রমিকদের সাধারণ দাবি দাওয়াকে কেন্দ্র করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামানো।
✽ জানকী নায়ারের দৃষ্টিভঙ্গি : অধ্যাপক নায়ার তার গবেষণায় কোলার স্বণখনি বাংলার সূতাকল শ্রমিকদের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে ভারতীয় শ্রমিকদের বহুবিধি সত্তা-পরিচিতির উল্লেখ করেছেন, তার বিশ্লেষণ অনুযায়ি ভারতীয় শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে শ্রেণির তুলনায় বর্ণ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। শ্রমিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে কিন্তু বর্ণ সম্বন্ধে বিস্ময়করভাবে কম আলোচনা হয়েছে। সেদিক থেকে নায়ারের গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম।
✽ দীপেশ চক্রবর্তীর গবেষণা : প্রথাগত মার্কসবাদীরা শ্রমিক-মালিক সম্পর্ককে যেভাবে মূলত অর্থনৈতিক মনে করেন অধ্যাপক চক্রবর্তী সেই বক্তব্যকেই খন্ডন করতে চান। তার কাছে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কমূলত একটি মানবিক সমস্যা, ধারণা ও চেতনার প্রশ্ন এবং কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
মূল্যায়ন : সম্প্রতিকালের নতুন ধরনের শ্রমিক ইতিহাস চর্চার ধারাগুলি অবশ্যই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অমিয় কুমার বাগচি এই ধরনের ইতিহাস চর্চার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, এগুলির একটা সাধারণ ঝোঁক হল অর্থনৈতিক বিষয়গুলির ওপর গুরুত্ব না দিয়ে অর্থনীতি বহির্ভূত বিষয়গুলির উপর ঝোঁক দেওয়া। তিনি আরো মনে করেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা নিজেদের তাত্ত্বিক ঝোঁক বা বিশ্বাস অনুযায়ি বেচে বেছে পছন্দমত তথ্য আহরণ করে তার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এর ফলে শ্রমিক ইতিহাসের সামগ্রিকতা ক্ষুন্ন হয়ে তা অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে খন্ডিত ও একপেশে।
No comments
Hi Welcome ....