Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Top Ad

Breaking News:

latest

B.ED 1st Semester Notes Free Course (1.1.1) Childhood and Growing Up 1st Half Mark-10

❐ আরো পড়ুনঃ B.Ed Notes A2z 1st Semester Notes 1.প্রশ্নঃ বৃদ্ধি ও বিকাশকে প্রভাবিত করে এমন সামাজিক উপাদানগুলি আলোচনা করুন।  Discuss the soc...



আরো পড়ুনঃ B.Ed Notes A2z

1.প্রশ্নঃ বৃদ্ধি ও বিকাশকে প্রভাবিত করে এমন সামাজিক উপাদানগুলি আলোচনা করুন। 
Discuss the social factors which are affecting growth and development.
▸ জীবনব্যাপী ক্রমোন্নতিশীল সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াই হল বিকাশ। বিকাশের ফলে ব্যক্তি উৎকর্ষতার সঙ্গে কর্মসম্পাদনে সক্ষম হয়। বৃদ্ধির ফলেই বিকাশ ঘটে। কারণ পরিমাণগত পরিবর্তন ছাড়া গুণগত পরিবর্তনকে বিচার করা যায় না। আবার গুণগত পরিবর্তনকে বাদ দিয়ে পরিমাণগত পরিবর্তনের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায় না। মানুষের বিকাশের কয়েকটি স্তর রয়েছে। একটি স্তর অন্যটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি স্তরের সুষ্ঠু বিকাশ না ঘটলে অন্যটির বাঞ্ছনীয় উন্নতি ঘটে না। ব্যক্তির বিকাশ কখনও বন্ধ হয়ে যায় না এবং পূর্ব স্তরটি অলক্ষ্যেই পরবর্তী স্তরে মিশে যায়। বিকাশের উপর প্রভাব বিস্তারকারী কতকগুলি উপাদান সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল—
(i) দারিদ্র্য (Poverty) : সাধারণত দারিদ্র্য বলতে যে বিষয়গুলি বোঝায় সেগুলি হল— (i) জীবনযাপনের সমাজভিত্তিক স্বাভাবিক মানের অভাব। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম বিষয়, যেমন—খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় মাত্রায় সংগ্রহ করতে না পারা। (ii) অর্থ, জমি, ঋণ ইত্যাদি আহরণে অসমর্থ।সম্পদের অভাবে সামাজিক সম্পর্কস্থাপন ও তা রক্ষার অক্ষমতা নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে হতাশাগ্রস্ত অবস্থা। সুতরাং শিশুর সুষম বিকাশের পথে একটি বিরাট বাধা হল দারিদ্র্য। 

 শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের উপর দারিদ্র্যের প্রভাব নিম্নরূপ :
(i) অপুষ্টিজনিত রোগের ফলে শিশুর মধ্যে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে ওঠে না। (ii) প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন বয়সে শিশুকে যে প্রতিষেধক টিকা দেওয়া প্রয়োজন দরিদ্র পরিবার অনেক সময় তারও ব্যবস্থা করতে পারে না। অর্থাৎ দারিদ্র্যতা শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশের উপর প্রত্যক্ষভাবে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। (iii) দরিদ্র পরিবারের বেশিরভাগ পিতামাতা উভয়েই উপার্জনের জন্য নিযুক্ত থাকেন। তারা শিশুর ন্যূনতম করারও সময় পান না। ফলে তাদের শিশুরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। (iv) দরিদ্র পরিবারের শিশুরা অনেক সময় তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। চুরি করা, মিথ্যে কথা বলা, ইত্যাদি নানা সমস্যা দেখা যায়। (v)
বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাগ্রহণের জন্য যে মানসিক প্রস্তুতি শিশুর প্রয়োজন তা থেকেও তারা বঞ্চিত হয় এবং দরিদ্র পরিবারের শিশুরা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকে নানাপ্রকার অপরাধমূলক আচরণ করে থাকে।
·
(ii) সুযোগের অভাব (Lack of Opportunities) : প্রত্যেকটি শিশু জন্মসূত্রে কিছু ক্ষমতা, প্রবণতা ইত্যাদি প্রাথমিক মানসিক উপাদান নিয়ে জন্মায়। এই ক্ষমতা এবং প্রবণতাগুলির সঠিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন সুযোগসুবিধা। রাষ্ট্র, সমাজ বা পরিবারের কাছ থেকে জীবনধারণের জন্য কিছু সাধারণ সুযোগসুবিধা পাওয়া শিশুর স্বাভাবিক অধিকার। এই সুযোগসুবিধাগুলি যখন শিশু সঠিকভাবে পায় না বা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত তখনই তাকে বলা হয় সুযোগের অভাব। কোনো শিশু যদি জীবনবিকাশের বিভিন্ন স্তরে নির্দিষ্ট সুযোগসুবিধাগুলি না পায় তাহলে তার স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। বিভিন্ন ধরনের সুযোগের অভাবে শিশুর কীভাবে ব্যাহত হয় তা নীচে আলোচনা করা হল— (ক) আর্থিক সুবিধার অভাব (Lack of Economical Opportunities): নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের খুব কম বয়সেই অর্থ উপার্জনের জন্য কাজে লাগানো হয়। লোকের বাড়িতে, দোকানে, কলকারখানায়, কৃষিতে, খনিতে ইত্যাদি কাজে এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা নিযুক্ত হয়। এই শিশুদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিকের বিকাশই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (খ )পুষ্টির অভাব (Lack of Nutrition): দরিদ্র পরিবারের মানুষ তাদের শিশুকে যথাযথ পুষ্টিকর খাবার দিতে পারে না। ফলে শিশুর দৈহিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত রোগ, যেমন—রিকেট, রক্তাল্পতা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পুষ্টির অভাবে শিশুর বৌদ্ধিক বিকাশও ব্যাহত হয়। আবার শৈশবেই অর্থ উপার্জনের জন্য কাজে নিযুক্ত হওয়ায় খেলাধুলা বা শরীরচর্চার সুযোগ পায় না ফলে দৈহিক বিকাশ ব্যাহত হয়। (গ) বাসস্থানের অভাব (Lack of Proper Housing): দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষেরই নিজেদের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান থাকে না আর থাকলেও তা খুবই নিম্নমানের। ফলে এইসব পরিবারের শিশুরা নিশ্চিত বাসস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এইসব শিশুদের অনেক সময়ই ফুটপাথে বা প্ল্যাটফর্মে রাত্রিবাস করতে হয়। এইসব শিশুদের সার্বিক বিকাশ খুবই ব্যাহত হয়। (ঘ) শিক্ষার অভাব (Lack of Education): দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী শিশুরা উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়। এইসব পরিবারের শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়স হওয়ার আগেই অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। এদের অভিভাবকদের পক্ষেও যথাযথ শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে এদের মধ্যে পরিচ্ছন্নতাবোধ বা স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি হয় না। শিক্ষার অভাবে এইসব শিশুদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক এবং প্রাক্ষোভিক বিকাশ ব্যাহত হয়।

(iii) বঞ্চনা (Deprivation) : মানুষের জীবনধারণের জন্য যা প্রয়োজন তা না পাওয়ার অবস্থাকে বলা হয় বঞ্চনা। অর্থাৎ শিশুর সার্বিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাভাবিক বিষয়গুলি থেকে কোনো না কোনো কারণে তার দূরত্ব তৈরি হওয়া। যেসব কারণে শিশু বঞ্চিত হয় সেগুলি হল— (i) মা-বাবার স্নেহভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলে শিশুর দৈহিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশ ব্যাহত হয়। (ii) আর্থিক ও সামাজিক সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে শিশুর সামাজিক ও নৈতিক বিকাশ সঠিক হয় না। (iii) শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে শিশুর সঠিক জ্ঞানমূলক বিকাশ ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে না ফলে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা থেকে বঞ্চিত হলে শিশুর সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়।

(iv) বিচ্ছিন্ন পরিবার (Disrupted Family) : মানবসমাজে পরিবার হল একটি ক্ষুদ্র মৌলিক একক যা শিশুর প্রকৃতি ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। কালের নিয়মে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবারের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে অণু পরিবার তৈরি হয়েছে। শিল্পবিপ্লব, নারীমুক্তি আন্দোলন, যন্ত্রসভ্যতা, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের শৈথিল্য, আর্থিক বিপর্যয়, মেয়েদের বেশি পরিমাণে কর্মে নিযুক্তি ইত্যাদি কারণে সমাজের মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে তা নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসাধ্য। সামাজিক এই অস্থিরতার প্রভাবে অনেক পরিবারেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। ফলে দিনের পর দিন ভগ্ন পরিবার বা বিচ্ছিন্ন পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন পরিবার বলতে বোঝায়—(i) যেসব পরিবারে বাবা-মা সবসময় ঝগড়া করে।(ii)  বাবা-মার নিজেদের মধ্যে কোনো বোঝাপড়া নেই দুশ্চরিত্র মদ্যপ পিতা বা স্বার্থপর উদাসীন মার জন্য যে পরিবারে শান্তি নেই। (iii) মৃত্যু বা বিবাহবিচ্ছেদ বা অন্য কোনো কারণে শিশু অল্প বয়সে বাবা বা মাকে হারিয়েছে এমন পরিবার। এইসব পরিবারের শিশুর সার্বিক বিকাশ বিভিন্নভাবে ব্যাহত হয়। ভালোবাসার অভাব, কঠোর শৃঙ্খলা, অবহেলা বা প্রবল শৃঙ্খলাহীনতা ইত্যাদি নানা কারণে শিশুর মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়। তারা প্রক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আবেগের অস্থিরতার ফলে তারা অনেক সময় অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।

(v) নিম্নমানের প্রতিবেশিত্ব (Poor Neighbourhood) : যে পরিবেশে শিশু বড়ো হয় তার চারদিকের পরিবেশ ও প্রতিবেশী শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে সাধারণত প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশুর বিকাশের উপর প্রভাব বিস্তারকারী এই জাতীয় উপাদানগুলি হল- (i) প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব যেমন—প্রাকৃতিক বিপর্যয় (বন্যা, খরা)। (ii) সমবয়সি বন্ধু যেমন –সহপাঠী বা খেলার সাথিদের প্রভাব। (iii) সংগঠিত সংস্থা যেমন ক্লাব, বিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির প্রভাব। (iv) বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষের অনভিজ্ঞতা ও অশিক্ষার প্রভাব। (v) সামাজিক অবস্থা যেমন- -যুদ্ধ, অন্তবিপ্লব, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, অর্থনৈতিক অবনতি, কুশিক্ষা, বহিঃশত্রুর আক্রমণ ইত্যাদির প্রভাব। প্রতিবেশীদের নীতিগত আদর্শ সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি না থাকলে সমাজ গঠনের মৌলিক যোগসূত্রাবলি দুর্বল হয়ে পড়ে যা অসংযম ও আদর্শহীনতার রূপ নিয়ে শিশুর মনে প্রতিফলিত হয়। ফলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে  এই শিশুরাই অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

(vi) নিম্নমানের গৃহপরিবেশ (Poor Housing) : শিশুর গৃহ পরিবেশ তার বিকাশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যেমন— (i) অবাঞ্ছিত নিম্নমানের গৃহপরিবেশ শিশুর বিকাশকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য প্রক্ষোভ ও সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে। (ii) নির্ভরযোগ্য কাঠামো, ন্যূনতম আধুনিক পরিসেবা (জল, ইলেকট্রিসিটি, শৌচালয়) বা দূষণমুক্ত গৃহপরিবেশ না হলে তা শিশুর দৈহিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক বিকাশ ব্যাহত হয়। (iii) অস্বাস্থ্যকর, অপরিচ্ছন্ন গৃহপরিবেশ এবং গৃহে প্রয়োজনীয় স্থানাভাব শিশুকে গৃহের প্রতি বিরুপ করে তোলে। ফলে পরিবারের বন্ধন শিথিল হয় এবং মূল্যবোধ হ্রাস পায়। (iv) পরিবারে শিশু যদি পিতামাতার যত্ন, ভালোবাসা ও মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে সে তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পরিতৃপ্ত করার জন্য নানাপ্রকার অপরাধমূলক আচরণ করে থাকে। তাকে শিক্ষার আওতায় আনাও সম্ভব হয় না।

2.প্রশ্নঃ কৈশোরকালের বিশেষ চাহিদাগুলি সংক্ষেপে বিবৃত করুন এবং শিক্ষায় এদের গুরুত্ব উল্লেখ করুন। 
Give a brief account of the special needs of adolescence and their educational implications.
❏ কৈশোরে দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক, নৈতিক এবং জ্ঞানমূলক পরিবর্তন এত দ্রুত হয় যে, এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে নতুন নতুন চাহিদা দেখা দেয়। শৈশবে বা বাল্যে চাহিদাগুলি মূলত জৈবিক অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়, কিন্তু কৈশোরে শুধুমাত্র জৈবিক অস্তিত্বই নয়, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক বৈশিষ্ট্যের সুষ্ঠু প্রকাশও তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন চাহিদা। কৈশোরে যেসব চাহিদা দেখা যায় সেগুলির মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা নিম্নরূপ —
  1. স্বাধীনতা ও সক্রিয়তার চাহিদা (Need for Freedom and Activity); কৈশোরে দেহে ও মনে পূর্ণতা আসায় তাদের মধ্যে যে-কোনো কাজ স্বাধীনভাবে করার প্রবণতা দেখা যায়। এই সময় আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা তৈরি হয় বলে তারা স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে চায় এবং বয়স্কদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়। কৈশোরের এই স্বাধীন ও সক্রিয় আচরণকে যথাযথ মূল্য দেওয়া উচিত। এই স্তরে পরিবারই একমাত্র তাদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করতে পারে এবং শৃঙ্খলা আরোপ না করে তারা যাতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নিয়মনীতি মানে সেদিকে লক্ষ রাখা উচিত। কারণ, স্বাধীনতাই হল স্বতঃস্ফূর্ত সক্রিয়তা।
  2. আত্মপ্রকাশের চাহিদা (Need for Self-expression): কৈশোরে ছেলেমেয়েরা নানা প্রক্ষোভের সম্মুখীন হয়। ফলে তাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশের তাগিদ প্রবলভাবে দেখা দেয়। বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে তারা বয়স্কদের সামনে বা দলের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সমাজের অন্য ব্যক্তিরা তার মূল্য উপলব্ধি করবে। এটি সে বিশেষভাবে কামনা করে। তাই লেখাপড়া, গানবাজনা, নাচ, খেলাধুলা, ছবি আঁকা, অভিনয় বা অন্যান্য বিভিন্ন কাজে তারা আত্মপ্রকাশের মাধ্যম খোঁজে। এই সময় বিদ্যালয়ে সহপাঠক্রমিক বিভিন্ন কাজ এবং সৃজনশীল বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে কৈশোরের এই চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটে।
  3. আত্মনির্ভরতার চাহিদা (Need for Self-dependence): আত্মপ্রকাশের চাহিদা থেকেই কৈশোরে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চাহিদা দেখা দেয়। উপার্জনক্ষম হয়ে স্বাধীন জীবনযাপনের প্রবল ইচ্ছা এই সময় দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের বৃত্তির প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়। পরিবার ও বিদ্যালয় কৈশোরের ছেলেমেয়েদের বৃত্তি নির্বাচনে সহায়তা করে তাদের এই চাহিদাপূরণ করতে পারে।
  4. নিরাপত্তার চাহিদা (Need for Security): স্বাধীনতার চাহিদার পাশাপাশি এই সময় আর একটি চাহিদা দেখা দেয়, সেটি হল নিরাপত্তার চাহিদা। এই সময় কিশোর-কিশোরীরা আর্থিক ও পারিবারিক দিক থেকে পিতামাতার উপর নির্ভরশীল থাকে। বয়স্করা কখনও তাদের সঙ্গে বয়স্কদের মতো আচরণ করে, আবার কখনও তাদের ছেলেমানুষ ভাবে। এই পরস্পরবিরোধী আচরণের জন্য তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এই সময় বয়স্করা সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করলেই তাদের নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ হয়।
  5. সামাজিক চাহিদা (Social Need): এই স্তরে সমাজজীবনের প্রতি অনুরাগ দেখা যায়। সমাজজীবনের বিভিন্ন অংশে তারা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসায় বাইরের আহ্বান তাকে প্রবলভাবে টানে। এই সময় এরা তাই ক্লাব, ব্যান্ড বা নাটকের দল গঠন করে।এই সময় পরিবার এবং বিদ্যালয় যদি তাদের দিয়ে বিভিন্ন যৌথকর্ম করায় তাহলে তাদের এই চাহিদা পূরণ হয়। যেমন—দল বেঁধে ভ্রমণ, চড়ুইভাতি, নাটক-অভিনয়, সাংস্কৃতিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক সভা, আলোচনা সভা, ছাত্র সংগঠন ইত্যাদি। এই জাতীয় কাজে নিযুক্ত থাকলে তাদের উদ্যমশীলতা নষ্ট হয় না বা অপসংগতিমূলক আচরণেরও কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
  6. নতুন জ্ঞানের চাহিদা (Need for New Knowledge): এই সময় মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণ হওয়ায় বিশেষ আগ্রহের বিষয়বস্তুর প্রতি তাদের কৌতূহল বৃদ্ধি পায়। ফলে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জানার প্রবল ইচ্ছা তাদের মধ্যে দেখা যায়। বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিশ্বপ্রকৃতির বিভিন্ন দিকের প্রতি তাদের ঝোঁক দেখা যায়। তারা নিজেরাই পর্যবেক্ষণ করে বা পড়াশোনা করে জানার তাগিদ অনুভব করে। মাতাপিতা ও বিদ্যালয়ের উচিত এই সময় তাদের নানা বিষয়ে জ্ঞানলাভের সুযোগ করে দেওয়া। তারা যে বই পাঠ করছে বা পর্যবেক্ষণ করছে সেগুলি যেন তাদের উপযুক্ত হয় সেদিকে লক্ষ রাখা। তাহলেই কৈশোরের জ্ঞানের চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হবে।
  7. দুঃসাহসিক অভিযানের চাহিদা (Need for Adventure): জ্ঞানের চাহিদার ফলে কৈশোরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর-একটি চাহিদা দেখা যায়, সেটি হল দুঃসাহসিক অভিযানের চাহিদা। বয়স্কদের চোখে বা সমবয়সিদের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এরা এমন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে যা অন্যান্যরা এড়িয়ে যায়। আত্মপ্রকাশের জন্য এই দুঃসাহসিক অভিযান তারা যাতে নিয়ন্ত্রিতভাবে করতে পারে সে বিষয়ে অভিভাবক এবং বিদ্যালয়ের লক্ষ রাখা উচিত। তাদের দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে এমন কাজ করাতে হবে যাতে তাদের এই চাহিদা পূরণ হয়। যেমন—পাহাড়ে চড়া, বন্যাত্রাণে সাহায্য করা, রক্তদান এবং এই জাতীয় বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ।
  8. নীতিবোধের চাহিদা (Need for Moral Sense): কৈশোরে নীতিবোধের চাহিদাও দেখা যায়। ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ তাদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা যায়। নিজের এবং অপরের কাজকে নৈতিক মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে, নিজে নীতিবিরোধী কাজ করলেও তার মধ্যে অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়। তেমনি অন্যের অনৈতিক কাজকেও মেনে নিতে পারে না। পিতামাতা এবং শিক্ষকের আচরণ যেন পরস্পরবিরোধী না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। তাদের ক্ষুদ্র জগৎটুকুতে যেন বাস্তবের সঙ্গে তাদের অন্তর্জগতের সার্থক সমন্বয় ঘটে সেটুকু খেয়াল রাখলে অনেকটাই এই চাহিদার পরিতৃপ্তি হয়।
  9. যৌন চাহিদা (Sexual need): কৈশোরে যৌনবোধ পরিপূর্ণ আকারে বিকশিত হয়। দেহের যৌন অঙ্গের পরিবর্তন তাদের মনোজগতে এক বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। যৌন চেতনার ফলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ প্রবল হয়। যৌন কৌতূহল থেকে যৌন সম্পর্ক সম্বন্ধে জানার আগ্রহও দেখা যায়। যৌন কৌতূহলকে নিবৃত্ত করার জন্য এই সময় পরিবারে এবং বিদ্যালয়ে যৌনশিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তারা যাতে কোনো অশ্লীল বই, ছবি বা পর্নোগ্রাফি থেকে যৌনশিক্ষা লাভ না করে সে কারণেই উপযুক্ত যৌনশিক্ষা প্রয়োজন।
  10. জীবনদর্শনের চাহিদা (Need for a Philosophy of Life): নৈতিক বিকাশের ফলে কৈশোরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে জীবনদর্শনের চাহিদা দেখা যায়। এই সময় তাদের অহম্ সত্তার বিকাশ ঘটে। তাই জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জানার প্রবণতা তৈরি হয়। এই প্রবণতাকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে নতুন জীবনদর্শন গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এই জীবনদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে তারা জীবনের যে কোনো ঘটনার তাৎপর্য নির্ণয় করে। কৈশোরে যাতে উপযুক্ত জীবনদর্শন গড়ে ওঠে সেজন্য পরিবার এবং বিদ্যালয়ের সক্রিয় সহযোগিতা এবং সহানুভূতি প্রয়োজন। এই সময় তাদের দেশ-বিদেশের বিখ্যাত মনীষীদের জীবনী পাঠের সুযোগ দিতে হবে। তারা যাতে আধুনিক সমাজের উপযুক্ত প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উদার জীবনদর্শন গড়ে তুলতে পারে সে বিষয়ে তাদের নানাভাবে সাহায্য করতে হবে। উপযুক্ত জীবনদর্শন গড়ে তুলতে পারলেই তারা সুচরিত্রের অধিকারী হবে।
3.প্রশ্নঃ বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হয়, তার উল্লেখ করুন। ওই সকল সমস্যাসমাধানে কাউন্সেলার হিসেবে শিক্ষকের ভূমিকা বর্ণনা করুন। 
Mention the problems faced by adolescents in school. Discuss the role of a teacher as a counselor to solve those problems.

 প্রথম অংশ: কৈশোরে ছেলেমেয়েরা উন্নত মানসিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় তাদের মধ্যে যে চাহিদাগুলি দেখা যায় সেগুলি যদি সঠিকভাবে পরিতৃপ্ত না হয় তাহলে এই চাহিদাগুলিকে কেন্দ্র করে নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় কৈশোরের এই চাহিদাগুলি পরিতৃপ্তির উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। উপরন্তু তাদের প্রতি আছে সমাজের নিঠুর উপেক্ষা ও অবহেলা। একদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো সমাজের বিভিন্ন কাজকর্মে অংশগ্রহণের প্রবল আকাঙ্ক্ষা, অপরদিকে সমাজের নিষ্ঠুর উপেক্ষা—এই দুটি বিপরীত শক্তির সংঘাতের ফলে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং তাদের মানসিক জগতে এক তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ফলে দেখা দেয় নানারকম সমস্যা। কৈশোরে সাধারণত যে সমস্যাগুলি দেখা দেয় সেগুলি নিম্নরূপ —
  1. কৈশোরে স্বাধীনভাবে কাজ করার ইচ্ছা বাধাপ্রাপ্ত হলে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হয়। এই বয়সেরছেলেমেয়েরা এই সংঘাত এড়িয়ে চলার জন্য নানারকম কৌশল অবলম্বন করে।
  2. কৈশোরের ছেলেমেয়েরা সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে যখন খাপ খাইয়ে নিতে পারে না তখন তারা তাদের অক্ষমতার গ্লানিকে দূর করার জন্য অনেক সময় দিবাস্বপ্ন কিংবা অলীক কল্পনার আশ্রয় নেয়। অতিরিক্ত মাত্রায় দিবাস্বপ্নের প্রবণতা দেখা দিলে তারা বাস্তববিমুখ হয়ে পড়ে এবং অবাস্তব কল্পনার জগতে বিচরণ করে তাদের অতৃপ্ত ইচ্ছার পরিতৃপ্তিসাধন করার চেষ্টা করে।
  3. পিতামাতা বা বয়স্কদের আচরণে তারা যদি দৈহিক ও মানসিক নিরাপত্তার অভাববোধ করে তাহলে তাদের মধ্যে নানারকম আচরণমূলক বৈষম্য দেখা দেয়। অনেক সময় এই ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তারা বাড়ি থেকে পালিয়েও যায়। এই সময় গৃহ পরিবেশের সঙ্গে সার্থকভাবে অভিযোজন করা তার কাছে একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
  4. কৈশোরে আত্মপ্রকাশের চাহিদা পূরণ না হলে তারা গোপনে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই সময় তাদের মধ্যে যে নৈতিক চাহিদা তৈরি হয়, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ জীবন অভিজ্ঞতার সংঘর্ষ বাধে। এই অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে তারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং নানারকম ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়। তা না হলে তারা বহির্জগতের সংস্রব থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে অবাস্তব কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে।
  5. জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষার দরুন কৈশোরে নানা বিষয়ের বই পড়ার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ভালোমন্দ বিচারের বোধ তাদের হয় না বলে অনেক সময়ই নিষিদ্ধ বই পড়ে নানারকম কু-অভ্যাসে আসক্ত হয়ে পড়ে।
  6. কৈশোরে যৌন চাহিদাকে কেন্দ্র করেও নানা সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে যৌনক্ষুধা তৃপ্তির অনুমোদন নেই। ফলে তাদের এই ইচ্ছাকে অবদমন করতে হয়। ফলে তারা সার্থকভাবে অভিযোজন করতে পারে না। সমস্ত যৌনজীবন তাদের কাছে বিরাট সমস্যা নিয়ে আসে। অনেকেই কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে যৌন সম্পর্কস্থাপন করে। অনেক সময় এই কারণে তাদের অনুশোচনা আসে। এই অনুশোচনা পরবর্তীকালে ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
  7. এই সময় দুঃসাহসিকতার চাহিদার জন্য তারা এমন সব কাজ করে বসে যা অনেক সময় তার পরবর্তী জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুঃসাহসিকতার জন্য অনেকেই অপরাধ জগতের সঙ্গেও লিপ্ত হয়ে যায়। 
  8. এই সময় নৈতিক চাহিদার জন্য প্রত্যক্ষ জীবন অভিজ্ঞতার সংঘর্ষ বাধে। তারা যখন দেখে যে, প্রাপ্তবয়স্কদের আচরণের কোনো নির্দিষ্ট মান নেই, তখন প্রতারণা, মিথ্যাচার, ব্যাভিচার কৈশোরের প্রক্ষোভময় জীবনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ওই প্রতিক্রিয়া অনেক সময় তাদের ব্যথিত করে আবার কখনও নানা রকম অস্বাভাবিক আচরণের মধ্য দিয়ে বহিঃপ্রকাশ লাভ করে। তারা কখনও প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাকে ভেঙ্গুেরে নিজের মনের মতো করে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। আবার কখনও বাস্তবের কঠিন আঘাতে মুহ্যমান হয়ে জগতের সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে চরম আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে কিংবা পরাজয়ের মানির ফলে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হয়।
কৈশোরের এই সমস্যাগুলি তাদের বিভিন্ন চাহিদাকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কৈশোরের সমস্যাগুলিকে যথেষ্ট বাস্তবসম্মত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা প্রয়োজন। তাঁদের মতে কৈশোরের এই সমস্যাগুলি সৃষ্টি হয় আধুনিক সভ্যতার দ্বারা সৃষ্ট পারিবেশিক প্রতিকূলতা থেকে। কৈশোরের কোনো ধ্বংসাত্মক দিক নেই। মানুষের জীবনে কৈশোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অসহায় শিশুকে মানবিক অধিকার দেওয়ার জন্যই এই কৈশোরের আবির্ভাব। কাজেই কৈশোরের সম্ভাবনাকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারলে তাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তির অহেতুক অপচয় ঘটার সম্ভাবনা থাকে না এবং তাদের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র যথেষ্ট সুগঠিত হয়। যদি তাদের আচরণে কোনো অসংগতি দেখা যায়, তাহলে সহানুভূতির সঙ্গে সমস্যাগুলিকে বিবেচনা করলে সেগুলিকে খুব সহজেই দূর করা যায়।

❏ দ্বিতীয় অংশ: আধুনিক শিক্ষার মূলকথা হল শিশুদের চাহিদা, আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা। কৈশোরে ছেলেমেয়েদের মধ্যে যে বিশেষ বিশেষ চাহিদা দেখা দেয়, সেগুলি যদি শিক্ষার মাধ্যমে যথাযথভাবে পূরণ করা যায় তাহলে তাদের সকল রকম সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়। আর যদি এই চাহিদাগুলি পরিতৃপ্ত না হয় তাহলে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের বিপথে পরিচালিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। তাদের চাহিদাপূরণ সমস্যাসমাধানের জন্য বিদ্যালয়ে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করা প্রয়োজন—
  1. শিক্ষক কৈশোরের দৈহিক পরিবর্তনগুলিকে খোলা মনে গ্রহণ করবেন এবং এই বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রকার খেলাধুলা, যোগাসন ও ব্যায়ামের ব্যবস্থা করবেন। সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিকর খাদ্যেরও ব্যবস্থা করবেন।
  2. শিক্ষক কৈশোরের প্রাক্ষোভিক প্রবণতাগুলিকে সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে বিচার করবেন এবং তাদের প্রাক্ষোভিক বিকাশকে সমাজ নির্দেশিত পথে পরিচালনা করার চেষ্টা করবেন।
  3. কৈশোরের স্বাধীনতার চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য তারা যাতে বিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে বিভিন্ন কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ছেলেমেয়েদের উপর শৃঙ্খলা রক্ষা ও অন্যান্য কাজের দায়িত্ব দিতে হবে।
  4. বিতর্ক, আলোচনা সভা ইত্যাদির মাধ্যমে তারা যাতে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ পায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এতে তাদের আত্মপ্রকাশের চাহিদাও পরিতৃপ্ত হয়।
  5. বিদ্যালয়ে খেলাধুলা, অভিনয় শিল্পকলা, সংগীত, সাহিত্যচর্চা, NCC, রেডক্রস গার্লগাইড প্রভৃতি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির ব্যবস্থা করে তাদের মধ্যে দলগতভাবে কাজ করার প্রবণতা তৈরি করতে হবে।
  6. বিভিন্ন প্রকার সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে কৈশোরের ছেলেমেয়েরা নিজের নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার যথেষ্ট সুযোগ পাবে। সাফল্য অর্জন করার মাধ্যমে তারা আত্মস্বীকৃতি লাভ করবে এবং সৃজনাত্মক কাজে অংশগ্রহণ করার ফলে তারা আত্মপ্রকাশেরও যথেষ্ট সুযোগ পাবে।
  7. কৈশোরের সামাজিক চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য তাদের যৌথ কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার অধিকতর সুযোগ দিতেহবে। এইসব কাজের মধ্য দিয়ে সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে তারা ভালোভাবে সংগতিস্থাপন করতে পারবে।
  8. জ্ঞানের চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য শিক্ষক কোনো সমস্যার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে তাদের সামনে উপস্থাপন করবেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তারা যাতে তাদের প্রবণতা অনুযায়ী স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারে শিক্ষক তার ব্যবস্থা করবেন।
কৈশোরের শিক্ষা যদি সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে তারা তাদের অনেক চাহিদাকেই অবদমিত করবে এবং তাদের মধ্যে নানারকম অসংগতি দেখা দেবে। তাই সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থাকে চাহিদাভিত্তিক করে রচনা করতে হবে এবং সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। এই সময় শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাভাবিক প্রবণতার দরুন শ্রেণিকক্ষে নানারকম অসামাজিক আচরণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে শিক্ষক তাদের তিরস্কার না করে আলোচনার দ্বারা এই আচরণের কুফল সম্পর্কে তাদের অবগত করাবেন এবং ওই আচরণ থেকে নিবৃত্ত করবেন। এই সময় শিক্ষককে তাদের মতামতের যোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। বিরুদ্ধ মতপোষণ করলে যুক্তির দ্বারা ধীরে ধীরে তাদের মত পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন।


4.প্রশ্নঃ বাল্যের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে আলোচনা করুন। 
Discuss the physical, cognitive, social, emotional and moral characteristics of childhood.
❏ দৈহিক বিকাশের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Physical Development ): দৈহিক বা শারীরিক বিকাশের হার প্রান্তীয় শৈশবের বিকাশের হারের চেয়ে অনেক কমে যায়। এই বয়স স্তরে শিশু প্রতি।
বছর দুই থেকে তিন ইঞ্চি করে লম্বায় বাড়ে। ওজনের দিক থেকে গড় বৃদ্ধির হার তিন থেকে ছয় পাউন্ডের মধ্যে থাকে। বিদ্যালয়ে যাওয়ার স্তরে দৈর্ঘ্যে গড় উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন ফুট এবং ওজন প্রায় আটচল্লিশ পাউন্ডের মতো হয়। মেয়েদের বৃদ্ধি ছেলেদের থেকে বেশি। নিজেদের দেহ সম্পর্কে এই বয়সে বালক-বালিকারা বিশেষ সচেতন থাকে না। দেহ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে, যেমন— দৌড়ানো, লাফানো ইত্যাদির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দুধের দাঁত পড়তে থাকে এবং তার বদলে। স্থায়ী দাঁত উঠতে থাকে। মস্তিষ্কের বিকাশ উন্নত হতে শুরু করে এবং দশ বছরের মধ্যে মস্তিষ্কের পরিণমন হয়ে যায়। প্রান্তীয় বাল্যকালে দেহের নীচের দিকের অঙ্গের বৃদ্ধি বেশি হয় যার জন্য বালক-বালিকাদের পা-গুলি দেহের তুলনায়।
বেশি লম্বা হয়।

হৃদ্যন্ত্র এবং ফুসফুসের বিকাশ সম্পূর্ণ না হলেও প্রায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। বড়ো পেশিগুলির নিয়ন্ত্রণের প্রভাব ছয় বছর বয়স থেকে শুরু হয় এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। এই বয়সে বত্রিশটি দাঁতের মধ্যে আঠাশটি স্থায়ী দাঁত ওঠায় চোয়ালের আকৃতি স্থায়ী রূপ নেয়। শৈশব পর্যন্ত নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে শিশুর যৌনতা (Sexuality) পরিণতি লাভ করে। কিন্তু বাল্যকালে তার যৌনতা অন্তর্নিহিত ও সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কোনো দিক দিয়েই তার বাহ্যিক অভিব্যক্তি দেখা না গেলেও বস্তুত বাল্যকালে অন্তর্নিহিত অবস্থায় তা তার পূর্ণ পরিণতির দিকে এগিয়ে চলে। এইজন্য বাল্যকালকে যৌনতার প্রসুপ্ত কাল (Latent Period) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। 

❏ মানসিক বিকাশের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Mental Development) : বাল্যকালে ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশ যথেষ্ট উন্নত হয়। ভাষাবিকাশের দিক থেকে দেখা যায় এই সময়কালে শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে তারা যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তা অনেকদিন মনে রাখতে পারে অর্থাৎ স্মৃতিশক্তি এই বয়সে অপেক্ষাকৃত প্রখর থাকে। কিছু সংখ্যাবাচক শব্দ, সময় নির্দেশক শব্দ, টাকাপয়সা সংক্রান্ত শব্দ ইত্যাদি এই সময়ে শেখা হয়ে যায় এবং প্রয়োজনে প্রয়োগ করতে পারে। নয় বছর বয়সের পরে বাক্য সুসংহত হয়। সাংকেতিক ভাষায় কথা বলা, কৌতুক করা, অন্যের বাচনভঙ্গি নকল করার ঝোঁক দেখা যায়। অপরের ভাষা ও পাঠ্যবিষয়ের ভাষা বোঝার ক্ষমতা বাড়ে। জীবন বিকাশের এই স্তরে ছেলেমেয়েরা কোনো কিছুতে বেশিক্ষণ মনোযোগ রাখতে পারে না, কোনো কাজ সঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে পারে না। কিন্তু এই বয়সে বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে ধারণা অনেক বিস্তৃত হয় এবং তাদের আগ্রহের পরিধি অনেক বেড়ে যায় বলে অনেক মনোবিদ বলেছেন। এই স্তরে ছেলেমেয়েদের যত বেশি পরিমাণ বস্তুর প্রতি আগ্রহ থাকে, জীবনের অন্য কোনো স্তরে থাকে না।

কৌতূহল এই বয়সে মানসিক বিকাশের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সব কিছু জানার জন্য বাল্যকালে ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রবল কৌতূহল দেখা দেয়। যেমন—কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা, বৈজ্ঞানিক তথ্য, ঐতিহাসিক ঘটনা ইত্যাদি সমস্ত কিছু সম্পর্কে এদের কৌতূহল বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। যুক্তি করার ক্ষমতার (Reasoning Power) বিকাশ এই বয়সে পরিপূর্ণ না হলেও বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করার ক্ষমতা জন্মায়। বাল্যের স্তরে পৌঁছোলে শিশুর মধ্যে শৃঙ্খলা ও সংযতভাব দেখা যায়। 8/10 বছরের একটি ছেলে বা মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে তার মধ্যে খুব অল্পই মানসিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। সে তার পরিবেশের সঙ্গে সবদিক দিয়েই অভিযোজন করতে সক্ষম হয়। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মতোই বিরাজ করে তার মানসিক স্থৈর্য ও সুসংহত আচরণ। এই জন্য আর্নেস্ট জোন্স বয়ঃপ্রাপ্তিকে 'বাল্যকালের পুনরাবৃত্তি’ বলে বর্ণনা করেছেন। বাল্যকালের আর-একটি মানসিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল সৃজনশীলতা। কাঠের বা মাটির জিনিস তৈরি করা, ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া প্রভৃতি কাজের প্রতি এই বয়সের ছেলেমেয়েরা একটি সহজ আকর্ষণ বোধ করে এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূল হলে কোনো কিছু সৃষ্টি করার আনন্দে তারা মেতে ওঠে।

বিচারকরণের শক্তি শৈশবে খুব কমই থাকে এবং সাত-আট বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা সহজ ও সাধারণ সমস্যা ছাড়া কিছু সমাধান করতে পারে না। এগারো/বারো বছর বয়স থেকে সত্যকারের বিচার ক্ষমতা জন্মায়। বিভিন্ন ঘটনা বা বস্তু সম্পর্কে বিচার করতে পারে। আরও কিছু বয়স বাড়লে এদের পক্ষে জটিল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়।

❏ সামাজিক বিকাশের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Social Development) : এই সময় শিশুরা অনেকটা সময় সমবয়সিদের সঙ্গে কাটায়। অনেকটা সময় সমবয়সিদের সঙ্গে থাকা যায় বলে বাল্যকালে ছেলেমেয়েরা দলনির্ভর খেলাধুলায় আগ্রহী হয়। সামাজিক দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা, সহযোগিতা, সচেতনতা প্রভৃতি মৌলিক সামাজিক গুণগুলি নিজেদের অজান্তেই আয়ত্ত করতে শুরু করে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে দলবদ্ধ হয়ে থাকার আগ্রহ বেশি দেখা যায়। মেয়েরা এই সময় সামাজিক রীতিনীতির কারণে অন্তর্মুখী হতে শুরু করে। ছেলেমেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে উপদল তৈরি করে নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। সম্পর্কের বিচারে সকলের সঙ্গে সমান অন্তরঙ্গতা থাকে না। নেতৃত্বের প্রতি সম্ভ্রম ও আনুগত্যের শিক্ষা এই সময় শুরু হয়, নিজেদের মধ্যে নেতৃত্বদানের বোধও জাগ্রত হয়। শুধুমাত্র সামাজিক কারণে ছেলেমেয়েরা এই সময় প্রক্ষোভজনিত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।

❏ প্রাক্ষোভিক ও নৈতিক বিকাশের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Emotional and Moral Development )ছেলেমেয়েরা বাল্যকালে শুধুমাত্র সামাজিক কারণে প্রক্ষোভজনিত আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তারা রাগ, হিংসা, ঈর্ষা অনেকসময় প্রকাশ করতে চায় না বন্ধুত্ব নষ্ট হবে ভেবে। কিন্তু পরিবারে আবার সামাজিক দৃঢ় সম্পর্কের ভিত্তিতে শৈশবের মতোই প্রবলভাবে কোনো-না-কোনো প্রাক্ষোভিক প্রতিক্রিয়া করে ফেলে। এর জন্য মা-বাবার কাছ থেকে শাস্তিও পায়। একই কারণে পরিস্থিতি বিচারে প্রাক্ষোভিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে আনে। ভয় এই বয়সের ছেলেমেয়ের মধ্যে দেখা যায়। যেমন- ভূতের ভয়, অন্ধকারের ভয়, শাস্তির ভয়, পরীক্ষার ভয়, এমনকি বিদ্যুৎ চমকালেও তারা ভয় পায়। শৈশবে রাগ হলেই রাগের বিষয়বস্তুকে আক্রমণ করা বা জিনিস ছুড়ে ফেলার প্রবণতা থাকে, কিন্তু বাল্যে এমন আচরণ দেখা যায় না। নিজের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্যভাবে সে রাগকে প্রকাশ করে। অর্থাৎ অনেকক্ষেত্রেই প্রক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সরাসরি হয় না। বিকল্প ব্যক্তি বা বস্তুর মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়। যেমন- মায়ের উপর রাগ করে ছোটো ভাইকে শাসন করা রাগের বহিঃপ্রকাশের একটি দৃষ্টান্ত। বাল্যে আনন্দ, স্ফূর্তি, উচ্ছ্বাস প্রভৃতি অনুভূতিমূলক আচরণের প্রাধান্য দেখা যায়। তুলনামূলকভাবে এই সময়কে উদ্‌বেগশূন্য কাল বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশজনিত কারণে উদ্‌বেগ সৃষ্টি হতে পারে। যেমন—পরীক্ষাজনিত উদবেগ, বাড়ির প্রিয়জনেরা সঠিক সময়ে বাড়িতে ফিরে না এলে উদবেগ ইত্যাদি।

ছোটো ভাইবোনদের প্রতি যেমন ভালোবাসা জন্মায় তেমনি আবার তাদের প্রতি ঈর্ষাও দেখা যায়। বাবা-মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা-আদর থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তাদের মনে দেখা দেয়। বাবা-মায়ের প্রতি প্রাক্ষোভিক আচরণের বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, আবার অনেকসময় বিরূপ প্রতিক্রিয়া তাদের মধ্যে দেখা দেয় ভুল বোঝাবুঝির কারণে। উল্লিখিত সমস্ত ক্রিয়াকলাপই প্রাক্ষোভিক বিকাশের বৈশিষ্ট্যাবলি।

5.প্রশ্নঃ কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ তত্ত্বের মূল স্তর বা উপাদান গুলি ব্যাখ্যা করুন?
▸ কোহলবার্গ ব্যক্তির উপর সামাজিক রীতিনীতির প্রভাবে র গুরুত্ব অনুযায়ী নৈতিক বিকাশের প্রক্রিয়া কে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন –

প্রথম পর্যায়: [প্রাক্ সংস্কার নীতিবোধের পর্যায়]: শিশুর চার থেকে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত এই পর্যায় চলে। এই পর্যায়ে শিশুর যে জ্ঞানমূলক বিকাশ হয় তার দ্বারা সে ভালো মন্দ বিচার করতে পারেনা। কেবলমাত্র ব্যক্তিগত তৃপ্তিলাভ ও শাস্তি এড়ানোর জন্য সে নৈতিক আচরণ করে। এই পর্যায়ে কে আবার দুইটি স্তরে ভাগ করা যায় সেগুলি হল…..

১. সামঞ্জস্যহীন নীতিবোধের স্তর: এই স্তরে শিশু ভালো-মন্দ বিচার করে ফলাফল অর্থাৎ শাস্তি বা পুরস্কার এর দ্বারা। অর্থাৎ যে আচরণের জন্য পুরস্কৃত হয় সেটি ভালো আর যার জন্য সে শাস্তিও পায় সেটি মন্দ। তবে এই স্তরে ভালো-মন্দের বোধ তার নিজস্ব নয় সে যার দ্বারা পরিচালিত তার দ্বারা শিশুর ভালো-মন্দ বোধ গড়ে ওঠে। ২. ব্যক্তিকেন্দ্রিক নীতিবোধের স্তর: এই স্তরে শিশুর নৈতিক আচরণ তার নিজস্ব ইচ্ছার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য যে আচরণ করা প্রয়োজন শিশু এই স্তরে ঠিক তাই করে। এই স্তরে তাই আত্মকেন্দ্রিক নীতিবোধ বিকশিত হয় কারণ সে যে আচরণ করছে তা যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা তৈরি তার হয়না।

দ্বিতীয় পর্যায়: [সংস্কার প্রভাবিত নীতিবোধের পর্যায়]: শিশুর ১০ থেকে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত এই পর্যায় বিস্তৃত। এই পর্যায়ের নীতিবোধ সামাজিক রীতিনীতির দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই পর্যায়ে শিশু ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় প্রকার সমর্থন প্রত্যাশা করে। পরিবার ,সামাজিক গোষ্ঠী, ধর্মীয় দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি নিয়ম দ্বারা এই পর্যায়ে নৈতিক বিকাশ নিয়ন্ত্রিত হয়। এই পর্যায়ের ও দুটি স্তর আছে সেগুলি হল....১. প্রত্যাশা মূলক নীতিবোধের স্তর: এই স্তরে নীতিবোধের উৎপত্তি হয় প্রত্যাশা থেকে। এই সময় শিশুর নীতিবোধ অন্যদের সমর্থনের প্রত্যাশা করে। যেমন - পড়াশোনায় খুব ভালো,খুব ভালো গান করে ইত্যাদি। ২. সমাজ নিয়ন্ত্রিত এবং বিবেক নিয়ন্ত্রিত নীতিবোধের স্তর: এই স্তরে শিশুর নৈতিক আচরণ সমাজের স্বার্থ এবং নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এই স্তরে আইন,সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি শিশুর কাছে প্রাধান্য পায়।

তৃতীয় পর্যায়: [সংস্কারমুক্ত নীতিবোধের পর্যায়]: এই পর্যায়ে শিশুর ১২ বছর বয়সের পর থেকে শুরু হয়। এই পর্যায়ে প্রকৃত নৈতিক বিকাশ হয় এবং নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যক্তি অপরের উপর নির্ভর করে না। আত্মস্বার্থ বা সমাজ স্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তির নীতিবোধ তার ব্যক্তিগত যুক্তি অর্থাৎ বিবেক বোধ দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই পর্যায়ের দুটি স্তর আছে সেগুলি হল...

১. সামাজিক চুক্তি নিয়ন্ত্রিত নীতিবোধের স্তর: এই স্তরে ব্যক্তির নৈতিক আচরণ সমাজের প্রতি তার দায় বদ্ধতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সামাজিক আইন এর পরিপ্রেক্ষিতে তার নৈতিক আচরণ গুলি প্রকাশিত হয় এবং ব্যক্তি তার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাজের কল্যাণকারী সামাজিক মূল্যবোধ গুলিকে গ্রহণ করে। ২. সর্বজনীন নীতিবোধের স্তর: এই স্তরে ব্যক্তির অনৈতিক আচরণ এর ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে তার নিজস্ব বিচারবোধ বা যুক্তি অর্থাৎ বিবেক। সমাজের কল্যাণকারী সামাজিক রীতি নীতি গুলিকে সে যুক্তি দ্বারা গ্রহণ করে আর সামাজিক মূল্যবোধ গুলিকে নিজের আচরণে প্রকাশ করে। যাদের অত্যন্ত সংবেদনশীল বিমুর্ত চিন্তন এর ক্ষমতা আছে তারাই এই স্তরে পৌঁছাতে পারে।


6.প্রশ্নঃ দারিদ্র্য কী? বিকাশের উপর দারিদ্র্যের প্রভাব লেখ?
 দারিদ্র্য সম্পর্কিত ধারণাটিকে আলোচনার ক্ষেত্রে একাধিক ব্যাখ্যা উল্লেখ করা প্রয়োজন। যেমন অধ্যাপক আহুজা তাঁর "সোশ্যাল প্রবলেম ইন ইন্ডিয়া"শীর্ষক গ্রন্থের তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিরিক্ষে দারিদ্র্য বিষয়টি আলোচনা করেছেন।
১. বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ।
২. নির্দিষ্ট সমাজভিত্তিক জীবনযাত্রার মান ও বৈষম্য।
৩. জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় খাদ্য, পোশাক, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি।

বৃদ্ধি ও বিকাশের উপর দারিদ্র্যের প্রভাব: ব্যক্তির বৃদ্ধি ও বিকাশের সঙ্গে দারিদ্র্যের সম্পর্ক উভয় মুখী। দারিদ্র্যের ফলে বৃদ্ধি বিকাশ ব্যবহৃত হয় আবার বৃদ্ধি বিকাশ নিশ্চিত করতে পারলে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। দারিদ্র্যের সঙ্গে মানব বিকাশের সম্পর্কের মূল চারটি স্বীকৃত সূচক হল –
ক. প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে নিরক্ষরতার শতাংশ
খ. চল্লিশ বছর বয়সের আগে মৃত্যুর সম্ভাবনা বৃদ্ধি
গ. শিশুদের অপুষ্টি।
ঘ. স্বাস্থ্যপরিসেবা পানীয় জল ও নিকাশি ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ব্যাক্তিবর্গ।

শিশুদের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের প্রধান প্রভাব পড়ে সুষম বৃদ্ধির উপর। অধিকাংশ দারিদ্র্য পরিবারের শিশুরা সামাজিক ,মানসিক, প্রাক্ষোভিক বিকাশ সে বাধা পায়। আত্মবিশ্বাস, ভাষা, প্রেষণা মনোযোগ, কৌতুহল ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। ফলে বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণের পূর্ব প্রস্তুতি থেকে শিশু বঞ্চিত হয়।বিকাশশীল এবং দরিদ্র দেশগুলোতে পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা গেছে যে বিদ্যালয়ের অপচয় ও অনুন্নয়নের মূল কারণ হলো দারিদ্র। এ সমস্ত ক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিশুর উন্নতি সাধনে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। বিদ্যালয় মারফত তার চাহিদা গুলি পূরন হলে শিশু পুনরায় বিকাশের পথে চালিত হতে পারে।

7. প্রশ্নঃ শিশুর কৈশোরকালীন দৈহিক, মানসিক, সামাজিক এবং প্রাক্ষোভিক বিকাশ সংক্ষেপে আলোচনা করুন। 
Discuss briefly the Physical, Mental, Social and Emotional development in the adolescent period of a child.

▸ দৈহিক বিকাশ (Physical Characteristics) : (i) কৈশোরে ওজন ও উচ্চতা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তবে এই সময় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বৃদ্ধির হার বেশি হয়।(ii)  এই সময় দেহের মাংসপেশি, হাড়, গ্রন্থি, মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড প্রভৃতির বৃদ্ধি হয়। (iii) কৈশোরের প্রারম্ভে মেয়েদের চেহারায় একটি লাবণ্য আসে, কিন্তু সেই তুলনায় ছেলেদের চেহারার মধ্যে একটি শীর্ণতা ও কাঠিন্য লক্ষ করা যায়। (iv) এই সময় ছেলেমেয়েদের বাগ্যত্র দ্রুত প্রসার লাভ করে, ফলে ছেলেদের কণ্ঠস্বর ভাঙা ভাঙা ও কর্কশ হয় এবং মেয়েদের কণ্ঠস্বর কিছুটা তীক্ষ্ণ হয়। (v) এই সময় পিটুইটারি গ্রন্থি নিঃসৃত হরমোনের প্রভাবে ছেলেমেয়েদের যৌনাঙ্গের বিকাশ হয় এবং দেহের নান স্থানে যৌন রোমের আবির্ভাব ঘটে।(vi) ছেলেদের দাড়িগোঁফ গজায় এবং শুক্রোৎপাদনের ক্ষমতা তৈরি হয়। (vii) মেয়েদের স্তনের বৃদ্ধি হয় এবং রজঃসৃষ্টির ক্ষমতার বিকাশ হয়।

▸মানসিক বৈশিষ্ট্য (Mental Characteristics) : (i) এই সময় দৈহিক বিকাশ যত দ্রুত হয় মানসিক বিকাশ তত দ্রুত হয় না। (ii) এই সময় স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ, গ্রহণ ক্ষমতা, ভাষার উপর দখল বৃদ্ধি পাওয়ায় ধারণার বিকাশ দ্রুত হয় এবং বুদ্ধিমত্তার যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। (iii) মনোযোগের চঞ্চলতা কমে যায়, বিমূর্ত চিত্তনের ক্ষমতা বিকশিত হতে শুরু করে বিশেষ বিশেষ বস্তুকে কেন্দ্র করে অনুরাগ বিকশিত হয়। (iv) এই সময় কৌতূহল, অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় সাহস ও বীরত্ব দেখিয়ে সব কাজে এগিয়ে যেতে চায় এবং অভিভাবকদের বিরক্তিকর শাসনের প্রতি কিছুটা অবজ্ঞা প্রকাশ করে। (v) এই সময় ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন চিন্তাধারার মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে পারে।

▸সামাজিক বৈশিষ্ট্য (Social Characteristics) : (i) সামাজিক দিক থেকে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের খুব বেশি রকম অসামাজিক মনে হয়। (ii) দৈহিক বিকাশকে লুকিয়ে রাখার জন্য তারা সামাজিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আবার বাবা-মায়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। (iii)  এই বয়সের ছেলেমেয়েদের বহির্বিশ্বের প্রতি সমাজের প্রতি প্রবল আকর্ষণ দেখা যায়, তাই এই সময় জনকল্যাণমূলক কাজের প্রতি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এদের মধ্যে মানবতাবোধও প্রবল আকারে দেখা যায়। (iv) এই স্তরের শেষের দিকে দলের প্রতি আকর্ষণ হঠাৎ করে আবার বেড়ে ওঠে এবং দলের কাজে নিজের ইচ্ছা, ভালোলাগা সবই সমর্পণ করে এবং দলের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। (v) এই সময় সমাজের নিয়ম, শৃঙ্খলা, অনুশাসন, মূল্যবোধ প্রভৃতির সঙ্গে সংগতিবিধান করতে হয়। কিন্তু সেই অনুশাসন লঙ্ঘন করে নতুন নিয়ম সৃষ্টি করার প্রবণতাও এদের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা দেয়।

▸ প্রাক্ষোভিক বৈশিষ্ট্য (Emotional Characteristics): (i) এই স্তরে প্রক্ষোভমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ কখনও খুব তীব্রভাবে হয়, আবার কখনও একেবারেই হয় না। (ii) এই বয়সের ছেলেমেয়েরা কখনও আনন্দে মাতোয়ারা আবার কখনও বিমর্ষ বা ভারাক্রান্ত থাকে। (iii) হীনম্মন্যতা, লজ্জাবোধ, অপরাধবোধ, ভয়, আগ্রাসী মনোভাব ইত্যাদি অনেক সময় প্রকট সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় (iv) এরা ভাবালু, আবেগপ্রবণ এবং কল্পনাবিলাসী হয়।

8.প্রশ্নঃ 'ভাষার বিকাশ' বিষয়ের উপর একটি টীকা লিখুন। 
Write a note on 'Language development'.
▸ একটি মানব শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার মুখে কোনো ভাষা থাকে না। শুধু কান্না এবং অকারণ হাসি প্রথম পর্যায়ে তা Reflex বা প্রতিবর্ত ক্রিয়া মাত্র ছাড়া আর কোনো অভিব্যক্তি থাকে না। অথচ মাত্র দুই বছর বয়সের মধ্যে সে যতটাভাষা আয়ত্ত করে তার সাহায্যে পূর্বে উল্লিখিত ভাষার সাতটি কাজই সম্পন্ন করতে পারে। সুতরাং ভাষাতাত্ত্বিকগণ এবং মনোবিজ্ঞানীরা জানতে চেয়েছেন, মানুষ কীভাবে ভাষা আয়ত্ত করে অথবা মানুষ কেন ভাষা শেখে। এই বিষয়ে বিগত একশো বছর যাবৎ যে বিপুল গবেষণালব্ধ প্রামাণ্য তথ্য সঞ্চিত হয়েছে তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি বিচিত্র।

প্রাথমিকভাবে, প্রথম মৌখিক অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ থেকে শুরু করে পরিণত অবস্থায় ব্যবহৃত ভাষায় রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াই ভাষার বিকাশ। কিন্তু এইটুকুই যথেষ্ট নয়। ভাষার চারটি উপাদান আছে। যেমন— (i) ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology): প্রত্যেক ভাষা গঠিত হয় কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক ধ্বনির নানা সমন্বয়ের ফলে। ইংরেজিতে ধ্বনির দুটি প্রধান উপাদানকে বলে Phonemes ও Morphemes, যার প্রথমটি উচ্চারিত শব্দাংশ আর দ্বিতীয়টি ওই শব্দাংশগুলির মিলিত গঠন। সহজভাষায় আমরা যখন কথা বলি তখন নির্দিষ্ট ভাষার নির্বাচিত শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব হয় ধ্বনিটি আয়ত্ত করার ফলে।

(ii) শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics): যে-কোনো পরিণত মানুষের স্মৃতিতে অগণিত শব্দ একাধিক অর্থসহ সঞ্জিত আছে। আমরা কথা বলার সময় নিজেদের কোনো সচেতন প্রয়াস ছাড়াই উপযুক্ত শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে ভাব প্রকাশ করি। ছোটোবেলায় ভাষার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিশুরা নতুন নতুন শব্দ, তার অর্থ ও প্রয়োগ আয়ত্ত করে এবং ধীরে ধীরে অগণিত শব্দভাণ্ডার (Vocabulary) তৈরি করে, এই প্রক্রিয়াটিই শব্দার্থতত্ত্ব।

(iii) ব্যাকরণগত গঠন (Grammatical Structure or Syntax): শুধুমাত্র শব্দ ও শব্দের অর্থ আয়ত্ত করা হলেই অন্যের কাছে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। প্রত্যেক ভাষাতেই একটি নিজস্ব বাক্যগঠন রীতি আছে। এই সর্বজনমান্য বাক্যগঠন রীতির অপর নাম ব্যাকরণ। ভাষা বিকাশের স্বাভাবিক নিয়মে আমরা সঠিক নিয়মানুযায়ী বাক্য গঠন করাও শিখি, যদিও নিয়মটি শিখি অনেক পরে। অর্থাৎ ব্যাকরণ শিখে ভাষা আয়ত্ত করা নয়, আগে ভাষার সাহায্যে পরস্পর যোগাযোগ করতে শিখে তারপর ব্যাকরণের নিয়ম শেখা স্বাভাবিকভাবে ঘটে। কোনো কোনো ভাষায় বাক্যগঠন রীতি অত্যন্ত ঋজু, যেমন—ইংরেজি, আবার ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রে তা কিছুটা নমনীয় সবচেয়ে নমনীয় সংস্কৃত ভাষায়। যাই হোক প্রথম প্রথম শিশুরা যে সমস্ত ছোটো ছোটো বাক্য ব্যবহার করে কথা বলে, বড়ো হওয়ার পর তারাই দীর্ঘ ও জটিল বাক্য বিন্যাস করতে সুদক্ষ হয়ে ওঠে। এই পরিবর্তনও ভাষা বিকাশের অন্যতম উপাদান।

(iv) প্রয়োগ (Pragmatics): এই কথাটির অর্থ পরিবেশ উপযোগী বাচনভঙ্গির বিকাশ। একই কথা আমরা উদ্দিষ্ট ব্যক্তি এবং উপস্থিত পরিস্থিতি বিচার করে আলাদাভাবে বলি। শ্রেণিকক্ষের বাচনভঙ্গি বাইরের বাচনভঙ্গি থেকে ভিন্ন। বড়োদের সঙ্গে কথা বলার ধরন, ছোটোদের সঙ্গে কথা বলার সময় পরিবর্তিত হয়ে যায়। অর্থাৎ সামাজিক শিক্ষার ভিত্তিতে ভাষার প্রকাশভঙ্গিতে যে প্রভাব দেখা যায় বাচনিক ভাষার ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব খুবই বেশি। উপরের বিষয়গুলি থেকে দেখা যাচ্ছে যে ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং ভাষা ব্যবহারের জন্য যে মৌখিক শব্দোচ্চারণ এই দুটি মিলিতভাবে যে প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয় তাকে একসঙ্গে বাচনিক ও ভাষার বিকাশ (Development of Speech and Language) নামে অভিহিত করা হয়। মানুষের অন্যান্য বিকাশ প্রক্রিয়ার মতোই বাচনিক ও ভাষার বিকাশ জটিল কিন্তু সুশৃঙ্খল নিয়মানুগ প্রক্রিয়া। ভাষার বিকাশ প্রধানত দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে—বংশগতি ও শিখন। এর মধ্যে, ভাষা বিকাশের ক্রমপর্যায় সমগ্র মানবজাতির ক্ষেত্রে একই নিয়মে অগ্রসর হয়। একে বলা হয় ভাষাবিকাশের প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য (Phylogeny) আর ব্যক্তি হিসেবে পরিবেশ ও শিখনের ভিত্তিতে ভাষার যে বিকাশ ঘটে তা ব্যষ্টিগত বৈশিষ্ট্য (Ontogeny)
  • ভাষা বিকাশের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য সাধারণভাবে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে বিদ্যমান তাকে বলা হয় প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্য (Those characteristics of language development existing commonly amongst the whole mankind are called phylogenetic characteristics)। এদিক থেকে ভাষার বিকাশ প্রজাতিগত।
  • ভাষা ও বাচনিক বিকাশের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য পরিবেশভেদে ব্যক্তিগত বৈষম্যের সৃষ্টি করে তাকে বলা হয় ব্যষ্টিগত বৈশিষ্ট্য (The characteristics of speech and language development which cause individual differences are called ontogenetic characteristics). বাচনিক বিকাশ মূলত ব্যষ্টিগত বিকাশের ফল। তবে এই বিভাজন না করে এক কথায় বলা যায় ভাষা ও বাচনিক বিকাশ প্রজাতিগত ও ব্যষ্টিগত বিকাশের মিথস্ক্রিয়ার ফল।
9.প্রশ্নঃ যৌন-মানসশক্তি বিকাশের বিভিন্ন স্তরগুলি সংক্ষেপে বিবৃত করুন এবং শিক্ষায় এর গুরুত্ব আলোচনা করুন।
Describe briefly the different stages of psycho-sexual development and their educational
▸ ফ্রয়েড তাঁর মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে ব্যক্তিত্বের বিকাশকেই বলেছেন লিবিডোর বিকাশ। তিনি লিবিডোর বিকাশকে 5টি বিশিষ্ট পর্যায়ে বা স্তরে ভাগ করেছেন। এগুলি হল—
1. মৌখিক স্তর (Oral Stage) : জন্মের সময় লিবিডো নির্দিষ্ট কোনো অবস্থানে থাকে না। তবে তা খুব শীঘ্রই আশ্রয় নেয় শিশুর মুখে। একে বলা হয় মৌখিক রতি পর্যায় (Oral Erotic Stage)। ফ্রয়েড এই স্তরকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন— 
(a) চোষণ স্তর (Oral Sucking Stage)
(b) চর্বণ স্তর (Oral Biting Stage) 

(a) চোষণ স্তর (Oral Sucking Stage): (i) এই সময় লিবিডো মৌখিক স্তরেই সংবন্ধ থাকে। জন্মের পর প্রথম আট মাস চোষার তৃপ্তিই শিশুর জীবনের সবচেয়ে আরামপ্রদ ঘটনা। এই সময় শিশুর প্রবণতা আদিম ও নগ্ন। (ii) এই সময় শিশুর জীবন আনন্দানুভূতিতে পরিপূর্ণ থাকে। কোনো আগ্রাসী প্রবৃত্তি তৈরি হয় না। এই বয়সের শিশুর মনে সৃষ্ট অনুভূতিকে পূর্বভাগ (Pre-ambivalent) বলা হয়। (iii) মায়ের সঙ্গে শারীরিক বিচ্ছেদ ঘটলেও তার স্পর্শ থেকে শিশু প্রবৃত্তিমূলক তৃপ্তি লাভ করে। তাই মৌখিক পর্যায়কে ফ্রয়েড বলেছেন আত্মরতিমূলক (Anto-Erotic) তৃপ্তির স্তর। (iv) শিশু বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের সঙ্গে যত বিচ্ছেদ ঘটতে থাকে তত তার আপন সত্তা জেগে উঠতে থাকে। (v) এই সময় শিশুকে নির্ভরতার আরাম ত্যাগ করতে হয়। চোষার তৃপ্তি এবং গিলে ফেলার আরামে বাধা পাওয়া শিশুর কাছে প্রথম প্রাক্ষোভিক আঘাতমূলক অভিজ্ঞতা (First Traumatic Experience)। (vi) এই সময় শিশু হাত-পায়ের সঞ্চালন করে, পায়ের বুড়ো আঙুল মুখে দেয়, আদর করে, ভালোবাসে। দাঁত ওঠার সময় সব জিনিসকে কামড়ে ধরার চেষ্টা করে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে তার ধ্বংসাত্মক ও আগ্রাসী মনোভাবের উদয় হয়। মায়ের থেকে বিচ্ছেদের অনুভূতিকে শিশু এই আগ্রাসী মনোবৃত্তি দিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করে।

(b) চর্বণ স্তর (Oral Biting Stage ) : (i) দাঁত ওঠার পর থেকে শিশুর জীবনের এক নতুন পর্যায় শুরু হয় এবং শিশু নতুন নতুন দৈহিক ও মানসিক ক্রিয়া করে। দেড় বছর বয়স পর্যন্ত এই স্তর চলে। (ii) এই সময় ভাত খাওয়া শুরু হয়, যা কেবল চুষে বা গিলে খাওয়া যায় না। খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। (iii) এই সময় শিশু মাকে যেমন ভালোবাসে, তেমনি তার উপর অত্যাচারও করে। এই আপাত বিরোধী (Ambivalance) মনোভাব এই বয়সের বৈশিষ্ট্য। (iv) শিশু মাকে এই সময় আঁকড়ে থাকতে চাইলেও মায়ের সাংসারিক কাজ তার কাছ থেকে মাকে একটু দূরে সরিয়ে দেয়। শিশু মায়ের এই ব্যবহারকে অবহেলা মনে করে ধ্বংসাত্মক মনোবৃত্তির আশ্রয় নেয় এবং ধীরে ধীরে মায়ের দিক থেকে মনকে সরিয়ে এনে নিজের উপর নিবন্ধ করে এবং আত্মপ্রেমে মগ্ন হয়ে যায়। ফ্রয়েড এই অবস্থাকে বলেছেন নার্সিসিজম (Nercissism)। (v) শিশু এই সময় নিজেকে একটি আরামের উৎস হিসেবে দেখে এবং লিবিডোর এক অংশকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। (vi) এই সময় পরিচ্ছন্নতা অভ্যাস করার কষ্ট, খাওয়ার আরামের পরিবর্তন এবং মায়ের ভালোবাসার ভাগ হারানো সব মিলিয়ে শিশুর কাছে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ফ্রয়েড একে বলেছেন দ্বিতীয় বেদনাহত অভিজ্ঞতা (Second Traumatic Experience)

2. পায়ু স্তর (Anal Stage ) : (i)  এই সময় লিবিডো স্থানান্তরিত হয়ে মুখ থেকে পায়ুতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই স্তরকে তাই পায়ু রতি স্তর (Anal Erotic Stage) বলা হয়। (ii) এই স্তরে শিশু মল নিঃসরণ ও মল সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে লিবিডোর তৃপ্তি আনার চেষ্টা করে। (iii) এই স্তরে আত্মরতি, আত্মসচেতনতা, বাস্তববোধ এবং আনন্দানুভূতির এক বিচিত্র সংমিশ্রণ শিশুর মনে চলতে থাকে। (iv) এই আনন্দানুভূতিতে বাধা পড়লে শিশুর মনে রাগ হয় এবং হতাশা দেখা দেয়। বাস্তবের সঙ্গে আনন্দ অনুভূতির সংঘাত শুরু হয় এই কারণে এই স্তরকে পায়ু ধর্ষণমূলক স্তর (Anal Sadistic Stage) বলা হয়।

3. লৈঙ্গিক স্তর (Phallic Stage) : (i) এই স্তরে শিশুর পরিচ্ছন্নতাবোধ এবং পোশাক ও আচ্ছাদনের চেতনাও জাগ্রত হয়। ফলে শিশুর মধ্যে লজ্জাবোধ দেখা দেয়। (ii) ছেলে ও মেয়ে শিশুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। অর্থাৎ একটি লৈঙ্গিক বোধ জাগ্রত হয়। এইভাবে পায়ু পর্যায় থেকে লৈঙ্গিক পর্যায়ে শিশু অনায়াসেই পৌঁছে যায়। (iii) এই সময় দৈহিক আনন্দবোধ ও যৌনবোধ জাগ্রত হয় এবং সেই সঙ্গে অপরাধবোধও দেখা দেয়। কারণ শিশু বোঝে যে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি তার আকর্ষণ বাড়ছে। (iv) এই সময় লিবিডো সম্পূর্ণভাবে লিঙ্গ অঙ্গে সংবদ্ধ হয় এবং পূর্ণ যৌনতা বোধ জাগ্রত হয়।

4. প্রসুপ্তি স্তর (Latency Stage ) : (i) এই স্তর পরবর্তী স্তর অর্থাৎ পূর্ণমাত্রার প্রাপ্তবয়স্কদের যৌনতাবোধ প্রকাশের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। (ii)  এই সময় শিশুর যৌনতাবোধ কিছুদিনের জন্য অবদমিত হয়ে অচেতন হয়ে যায় অর্থাৎ সুপ্ত থাকে। সমাজবোধ যৌনতাবোধকে চাপা দিয়ে দেয়। (iii)  এই সময় শিশু আত্মসুখ ভুলে যায়। এই সময়টি হল Role-playing-এর সময়। অর্থাৎ ছেলেরা পুরুষদের মতো করে এবং মেয়েরা নারীর মতো করে ভবিষ্যৎ সমাজজীবনে যে ভূমিকা নেবে তারই একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ হল প্রসুপ্তিকাল। (iv)  লৈঙ্গিক পর্যায়ে লিবিডো যৌন প্রবৃত্তি বিকাশের যে বিশিষ্ট পথ গ্রহণ করেছিল এবং দৈহিক সুখানুভূতির সঙ্গে যৌনতাকে একাত্ম করেছিল, প্রসুপ্তি স্তরে এর কোনোটিই নষ্ট হয় না, শুধুমাত্র কিছুদিনের জন্য সুপ্ত অবস্থায় থাকে লিবিডোর দৈহিক তৃপ্তি এবং অফুরন্ত শক্তি এই স্তরে খেলাধুলায় খরচ হয় এবং অন্যের সঙ্গে ঝগড়া, মনোমালিন ইত্যাদির মাধ্যমে আগ্রাসী মনোবৃত্তি প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ আত্মরতির আসক্তি বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় তাই ছেলেরা ছেলেদের এবং মেয়েরা মেয়েদের বেশি পছন্দ করে।

5. জনন স্তর বা উপস্থ স্তর (Genetic Stage) : (i) এটি লিবিডো বিকাশের শেষ স্তর। এই সময় লিবিডো অন্যসব বস্তু ছেড়ে আবার যৌনাঙ্গে সংবন্ধ হয় এবং শিশু যৌনতার সমস্ত অনুভূতি ও তৃপ্তি পুনরায় ফিরে আসে। (ii) এই সময় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি একটি তীব্র আকর্ষণ দেখা যায়। নিজেকে সুন্দর করে তোলার প্রবণতাও এই স্তরের একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য। নারী-পুরুষ উভয়েরই বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে মিলনের ইচ্ছা জাগ্রত হয়। (iii)  এই সময় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কোনো কারণে বিরোধী মনোভাব থেকে অনেক সময় সমকামিতার একটি প্রবণতা দেখা যায়।

▸ ফ্রয়েডের যৌন-মানসিক বিকাশের শিক্ষাগত তাৎপর্য (Educational Significance of Freud's Theory)ফ্রয়েডের যৌন চেতনার ক্রমবিকাশ তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য নিম্নে উল্লেখ করা হল- (i) আচরণ অধ্যয়নে একটি নতুন এবং ভালো পদ্ধতি। (ii) মানসিক অসুস্থতা এবং অস্বাভাবিক আচরণের কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার (Therapy) একটি নতুন দিক যা বর্তমানে মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতি বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। (iii) শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে একটি নতুন চিন্তা। (iv) শিশুর বিকাশে যৌনতার ভূমিকার গুরুত্ব (Role of Sex) এবং যথাযথ যৌন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। (v)  ফ্রয়েডের এই তত্ত্বটি শিক্ষাক্ষেত্রে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি এবং রুচির গুরুত্ব প্রতিপন্ন করে কারণ এইগুলির মাধ্যমে লিবিডোর সংবন্ধন থেকে শিশু মুক্ত হয়।

No comments

Hi Welcome ....