Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Top Ad

Breaking News:

latest

B.Ed 1st Semester Notes in Bengali Version | Course (1.1.1) 2nd Half Mark-10

বি.এড ফার্স্ট সেমিস্টার নোটস |  বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্র | Course Code : (1.1.1) 2nd Half Mark-10 ❐  আরো পড়ুনঃ   B.Ed Notes A2z   1st Semeste...


বি.এড ফার্স্ট সেমিস্টার নোটস | বিকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্র |Course Code : (1.1.1) 2nd Half Mark-10


❐ আরো পড়ুনঃ B.Ed Notes A2z

১. প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি সম্পর্কে একটি টীকা লিখুন। 
Write a note on emotional intelligence.
1990 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার দুই অধ্যাপক Dr. John Mayer এবং Dr. Peter Salovey প্রাক্ষোভিক ক্ষেত্রে
ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিমাপক প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি (Emotional Intelligence) শব্দটি ব্যবহার করেন। যদিও ‘প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি’ শব্দটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন Daniel Goleman (1995) Daniel Goleman (1995) তাঁর লিখিত পুস্তক 'Emotional Intelligence'-এ বলেছেন—প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি ব্যক্তিত্বের একাধিক সংলক্ষণের সমন্বয়, যেমন—সহমর্মিতা, প্রেষণা, ধৈর্য, বাঞ্ছিত আচরণ এবং সামাজিক দক্ষতা। মনোবিদ John D Mayer এবং Peter Salovey (1905) প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির সংজ্ঞায় বলেছেন, “প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি হল চারটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা—প্রক্ষোভ প্রত্যক্ষণ করা, চিন্তার সঙ্গে সমন্বয় করা, একে বোঝা এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।” অর্থাৎ এই সংজ্ঞা থেকে বলা যায় যে, প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি হল প্রক্ষোভ পরিচালনার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় বর্তমান।

প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির পরিমাপ: প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি পরিমাপের কয়েকটি অভীক্ষা বা স্কেল হল— 1. Dr. John Mayer  নির্মিত Mayer Emotional Intelligence Scale (MEIS) 2. Mayer, Salovey and Caruso Emotional Intelligence Scale (by Dr. John Mayer, Dr. Peter Salovey এবং Dr. David Carusa)

প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির উপযোগিতা: ব্যক্তি এবং সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য ব্যক্তির প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি সম্পর্কে সচেতনতা প্রয়োজন। প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির উপযোগিতা এইরূপ— 
নিজের প্রক্ষোভকে জানা : বেশিরভাগ মানুষই নিজের প্রক্ষোভকে ঠিকমতো জানতে বা চিনতে পারে না। নিজের পছন্দ-অপছন্দ, অনুভূতি সম্পর্কে নিজেই জানতে না পারায় অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গঠনেও অসুবিধা দেখা দেয়। অন্যদিকে প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি মানুষকে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন করে তোলে। ➋ নিজের প্রক্ষোভগুলিকে ঠিকমতো পরিচালনা করা: সমাজে সুস্থ জীবনযাপন করতে হলে প্রক্ষোভের সুষ্ঠু প্রকাশের প্রয়োজন। প্রক্ষোভের সুষ্ঠু বিকাশ না হলে জীবনের বিকাশ পরিপূর্ণ হয় না। প্রক্ষোভগুলি ঠিকমতো পরিচালনার অর্থ হল—বিভিন্ন প্রক্ষোভগুলিকে সমাজসম্মতভাবে প্রকাশের ক্ষমতা অর্জন। অনেকে প্রক্ষোভগুলিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ করতে পারে, আবার অনেকেই প্রক্ষোভগুলিকে তীব্রভাবে প্রকাশ করে ফেলে, প্রকাশভঙ্গিকে সংযত করতে পারে না। প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি ব্যক্তিকে সঠিকভাবে প্রক্ষোভ প্রকাশে সাহায্য করে।
নিজের কাজের প্রেষণা লাভ : টমাস আলভা এডিসন বলেছেন সাফল্য হল 2% প্রেরণা এবং 98% কঠোর পরিশ্রমের ফল। এই কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে ব্যক্তির যে ঐকান্তিক আত্মনিবেদন থাকে তাই হল প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি। সুতরাং প্রেষণা প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অন্যের প্রক্ষোভকে স্বীকৃতিদান ও প্রভাবিত করা: প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তির প্রক্ষোভকে চিনতে সাহায্য করে এবং তা স্বীকৃতি প্রদানেও সাহায্য করে। এই দক্ষতা দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরের প্রাক্ষোভিক অবস্থা বুঝে সেই অনুযায়ী অপরের সঙ্গে আচরণ করলে তবেই পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব। আর যারা তা পারেন না তাদের মধ্যে প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির অভাব আছে বলেই মনে করা হয়। সম্পর্ক তৈরি করা: অনেকসময় দেখা যায় যে, কোনো কোনো মানুষ অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গঠনে বিশেষ দক্ষ। এরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে যে-কোনো জায়গায়, যে-কোনো ব্যক্তির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন। এই সকল মানুষদের সকলে খুবই পছন্দ করে এবং পেশাগত ক্ষেত্রে এদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। জীবন সুন্দর ও সার্থক হতে হলে সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলাই উচিত। আবার এক শ্রেণির মানুষ দেখা যায় যারা কখনও কোনো সম্পর্ক দীর্ঘদিন বজায় রাখতে পারে না। সাধারণত প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির পার্থক্যের জন্যই এটি হয়।
 প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির বিকাশ: শিশুদের প্রাক্ষোভিক বুদ্ধির বিকাশের জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলি হল— ➊ শিশুদের অনুভূতি ও প্রক্ষোভ বোঝার ক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করা: নিজের এবং অল্পবয়স্কদের অনুভূতি সঠিকভাবে বোঝার ক্ষমতাকে যেমন বিকশিত করতে সচেষ্ট হতে হবে তেমনি অল্পবয়স্করা যাতে তাদের এবং অন্যান্যদের অনুভূতি বোঝার ক্ষমতাকে বিকাশ করতে পারে সে বিষয়ে তাদেরকে সাহায্য করা প্রয়োজন।  অপরের অনুভূতিকে গুরুত্ব দান: অপরের অনুভূতিকে গুরুত্ব না দেওয়া ইত্যাদিকে পরিহার করা উচিত। সন্দেহ, ঘৃণা, আক্রমণাত্মক মনোভাব ইত্যাদিকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। প্রক্ষোভ এবং মানসিক স্বাস্থ্য শিশুদের বোঝাতে হবে যে প্রতিটি প্রক্ষোভই মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অনুকূল। কারণ প্রতিটি প্রক্ষোভের মধ্যেই দেহ, মন, হৃদয় সক্রিয় হয়। ক্রোধ, ভয়, বিষাদ ইত্যাদি নেতিবাচক প্রক্ষোভগুলিও স্নেহ, সাহস, আনন্দের মতো স্বাস্থ্যপ্রদ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রক্ষোভগুলিকে সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় এবং বাঞ্ছিতভাবে প্রকাশ করা। অনুভূতিমূলক দক্ষতার বিকাশ: প্রাক্ষোভিক বুদ্ধি বিকাশের জন্য কেবলমাত্র প্রজ্ঞামূলক বিকাশই যথেষ্ট নয়, অনুভূতি মূলক দক্ষতা বিকাশের উপরেও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

২. প্রবৃত্তির প্রকৃতি বর্ণনা করুন। এর শিক্ষাগত গুরুত্ব ব্যাখ্যা করুন। 
Describe the nature of instincts. Explain its educational importance.
 প্রবৃত্তির প্রকৃতিগুলি নিম্নে বর্ণনা করা হল 
প্রবৃত্তি হল সহজাত: জন্মের পর থেকেই প্রবৃত্তি সক্রিয় হয়। যেমন–জন্মের পরেই শিশু কেঁদে ওঠে, হাত-পা ছোড়ে ইত্যাদি। প্রবৃত্তি হল বংশগত: জন্মের পরেই শিশু যে কাঁদে এটি শুধু কোনো নির্দিষ্ট সময়ে জন্মপ্রাপ্ত শিশুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এর কারণ হল শিশুর কান্না বংশধারা সূত্রে প্রাপ্ত। প্রবৃত্তিমূলক আচরণ সমতা রক্ষা করে। প্রবৃত্তি সমজাতীয় প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। যেমন—সব মাকড়সার জাল তৈরি করার পদ্ধতি এক।
প্রবৃত্তিমূলক আচরণ যান্ত্রিক এবং অপরিবর্তনীয়: অনেকে মনে করেন প্রবৃত্তিমূলক আচরণ যান্ত্রিক এবং অপরিবর্তনীয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের সাহায্যে প্রবৃত্তিমূলক আচরণের পরিবর্তন করা সম্ভব। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। প্রবৃত্তি হল উদ্দেশ্যমুখী: প্রবৃত্তি চেতনভাবে উদ্দেশ্যহীন হলেও, অচেতনভাবে উদ্দেশ্যমূলক। প্রবৃত্তি আত্মরক্ষা এবং  বংশবিস্তারমূলক উদ্দেশ্য সাধন করে। বাৎসল্য একটি প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির কারণেই মা তার শিশুকে শত অসুবিধা সত্ত্বেও লালনপালন করে।

❑ শিক্ষাগত গুরুত্ব আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশু স্বাভাবিকভাবে যা করতে চায় তাকে ভিত্তি করেই শিশুর শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করার কথা বলা হয়। যেহেতু শৈশবকালে শিশু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রবৃত্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাই শিক্ষককে শিশুর প্রবৃত্তি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। তবে শুধু প্রবৃত্তিই নয়, প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত প্রক্ষোভগুলি সকল আচরণে প্রেষণা জুগিয়ে থাকে। সেই কারণেই শিক্ষককে প্রবৃত্তি প্রক্ষোভ এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়েও জানতে হবে। শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হল শিশুর মধ্যে সুষম ব্যক্তিত্ব বিকাশ আর এই ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য শিক্ষক প্রবৃত্তিকে কীভাবে ব্যবহার করবেন তা নিম্নে উল্লেখ করা হল—

➊ শিশুর শিক্ষা হবে প্রবৃত্তিমুখী : প্রবৃত্তি সহজাত, সুতরাং তাকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট বা অবদমন করা যায় না। প্রাচীনকালে অনেকের ধারণা ছিল শিশু জন্মগত সূত্রে যেসব অবাঞ্ছিত প্রবৃত্তিগুলি নিয়ে আসে তার থেকে শিশুকে মুক্ত করতে হবে এবং সমাজবাঞ্ছিত আচরণগুলির প্রতি তাকে উৎসাহিত করতে হবে। কিন্তু ফ্রয়েডের মতে অতিরিক্ত অবদমন শিশুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে যার ফলে সে মানসিক দিক থেকে অসুস্থ হতে পারে এবং শিশুর সুষ্ঠু ব্যক্তিত্ব বিকাশ বাধার সম্মুখীন হয়। ➋ শিক্ষা হবে প্রবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে: শিশুর প্রবৃত্তি অতিরিক্ত দমন যেমন ভালো নয়, তেমনি প্রবৃত্তির অবাধ প্রকাশও বাঞ্ছিত নয়। রুশো শিশুকে জন্মগতভাবে নিষ্পাপ বলে মনে করেন এবং তিনি প্রবৃত্তির অবাধ প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার পক্ষপাতী। কিন্তু এই মতবাদকে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার অসুবিধা আছে। যেমন—শিশুর পলায়ন,প্রবৃত্তি, যুযুৎসা প্রবৃত্তি, যৌন প্রবৃত্তির অবাধ প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ না করলে বিদ্যালয়, পরিবার এবং সমাজজীবনে নানারকম অসুবিধা দেখা দিতে পার। তাই এমন মধ্যপন্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কল্যাণ হয়।

❑ শিক্ষা হবে প্রবৃত্তির উদ্‌গমনের (Sublimation) মাধ্যম: প্রবৃত্তির দমন নয়, উদ্‌গমনই হল শ্রেষ্ঠ পন্থা। কোনো প্রবৃত্তিকে অবাঞ্ছিত পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাঞ্ছিত পথে নিয়ে যাওয়াকেই উদ্‌গমন বলে। শিক্ষার মাধ্যমেই এটি সম্ভব। যেসব প্রবৃত্তির উদ্‌গমনের প্রয়োজন তা হল- ➊ সঞ্জয় প্রবৃত্তির উদ্‌গমন: অন্যের জিনিস চুরি করে সঞ্জয় করার প্রয়াস অথবা অপ্রয়োজনীয় কতকগুলি বস্তু সংগ্রহ করে সময় ও শ্রম নষ্ট না করে সংবাদপত্র থেকে নানাবিধ জ্ঞানমূলক তথ্য, ছবি ইত্যাদি সংগ্রহ করা যায়। এ ছাড়াও ডাকটিকিট, মুদ্রা ইত্যাদিও সংগ্রহ করা যায়। ➋ যৌন প্রবৃত্তির উদ্‌গমন: সৃজনাত্মক বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে যৌন প্রবৃত্তির উদ্‌গমন করা যায়। যেমন—ছবি আঁকা, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য ইত্যাদি। ধর্মীয় চিন্তাও যৌন প্রবৃত্তির উদ্‌গমনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। ➌ পলায়ন প্রবৃত্তির উদ্‌গমন: পলায়ন প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত প্রক্ষোভটি হল ভয়। শিক্ষার্থীরা কোনো শিক্ষককে ভয় করতে পারে বা বিশেষ কোনো পাঠ্যবিষয়ের উপর তাদের ভীতি থাকতে পারে। সেইসব শিক্ষক বা সেই বিষয়সমূহ যিনি পাঠদান করছেন সেই ক্লাসে শিক্ষার্থী সাধারণত অনুপস্থিত থাকে। এটিই হল পলায়ন প্রবৃত্তির প্রকাশ। এর উদ্‌গমনের জন্য প্রয়োজন হল বিদ্যালয় যেন শিক্ষার্থীদের আনন্দের স্থান হয়ে ওঠে। পরিশেষে মন্তব্য করা যায় যে, বিদ্যালয়ের মধ্যে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ইতিবাচক প্রবৃত্তিগুলিকে তৃপ্ত করতে পারে এবং নেতিবাচক প্রবৃত্তিগুলিকে উদ্‌গমনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

৩. প্রেষণার উপর বিভিন্ন বিষয়ের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করুন। 
Discuss the different factors affecting the different motivation.
প্রেষণা যেমন মানুষকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে তেমনি লক্ষ্যে পৌঁছোনোর শক্তিরূপেও কাজ করে। কতকগুলি শর্তের দ্বারা আবার প্রেষণা নির্ধারিত হয়। এই শর্তগুলিকে প্রেষণার উপাদান বা নির্ধারক বলা হয়। এগুলি হল—  আগ্রহ (Interest): ব্যক্তির কোনো বিশেষ বিষয়ে প্রেষণা তার সুপ্ত আগ্রহের দ্বারা নির্বাচিত হয়। কোনো চাহিদাকে তৃপ্ত করার জন্য চাহিদা নিবৃত্তির বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে যেটির প্রতি ব্যক্তির আগ্রহ আছে, সেটিকেই সে নির্বাচন করে। ➋ কৌতূহল (Curiosity): ম্যাকডুগাল কৌতূহলকে প্রাথমিক প্রক্ষোভ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, যে বিষয়ে কোনো ব্যক্তির কৌতূহল জাগে, সেই বিষয়ে কৌতূহল নিবৃত্ত না হওয়া পর্যন্ত সে অস্বস্তি অনুভব করে। সুতরাং কৌতূহল শিক্ষার্থীর প্রেষণার অন্যতম ভিত্তি। কাজেই শিক্ষক-শিক্ষিকার কর্তব্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল জাগিয়ে তোলা, যা তাদের প্রেষণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে। ➌ উদ্‌বেগ (Anxiety): প্রত্যেক ব্যক্তিই বিশেষ পরিস্থিতিতে উদবিগ্ন হয়। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তার উদ্‌বেগ দূর হয়। কোনো বিষয়ে সাফল্য লাভের জন্য উদ্‌বেগ না থাকলে অনেকসময় প্রেষণা কমে যায়। এই ব্যাপারে Yerkes Dodson-এর একটি সূত্র আছে। এই সূত্রে বলা হয়েছে যে, কোনো কাজ যদি খুব কঠিন হয়, তবে ব্যক্তির উদ্‌বেগ বাড়ে এবং প্রেষণা কমে। আবার কোনো কাজ যদি খুব সহজে হয়, তাহলে সেই বিষয়ে ব্যক্তির উদ্‌বেগ তেমন থাকে না। এই সময় প্রেষণাও কমে যায়, কিন্তু কাজের কাঠিন্যের মান মাঝামাঝি হলে প্রেষণা সবচেয়ে বেশি হয়। ➍ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (Locus of Control): প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের আচরণের কারণকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। মনোবিদ Rotter এই আচরণের দু-ধরনের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কথা বলেছেন। (i) বাহ্যনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (External Locus of Control): বাহ্য নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে ব্যক্তির কারণে কোনো ঘটনা ঘটলে ব্যক্তি সেই দায়িত্ব নিজে নিতে চায় না। মনে করা হয়, বাইরের কোনো পরিস্থিতি এই আচরণের জন্য দায়ী। যেমন—কোনো পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার ফল খারাপ হলে সে তার ব্যাখ্যা দেয় যে, প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছিল বলেই তার ফল খারাপ। কঠিন প্রশ্নপত্র এক্ষেত্রে বাহ্য নিয়ন্ত্রক। (ii) অন্তর্নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (Internal Locus of Control): কোনো কোনো ব্যক্তি মনে করে কোনো ঘটনা ঘটার জন্য বা তার আচরণের জন্য সে নিজেই দায়ী একে অন্তর্নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বলে। যেমন—অনেক শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফল খারাপ হলে তার কারণ হিসেবে বলে থাকে যে, সে ঠিকমতো প্রস্তুতি নেয়নি বা তার শারীরিক বা মানসিক অবস্থার জন্য সে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেনি।

দক্ষতা সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস (Self-Efficacy): নিজের দক্ষতা বা ক্ষমতা সম্পর্কে আস্থাকেই বলা হয় আত্মবিশ্বাস। কোনো কোনো ব্যক্তি তাদের জীবনকে নির্দিষ্ট পথে পরিচালনা করতে পারে। তারা অনুমান করতে পারে, ভবিষ্যতে তারা কী করতে পারবে। এইসব ব্যক্তি সহজেই যে-কোনো কাজে প্রেষণা পায়। আবার কোনো কোনো ব্যক্তি মনে করে তার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সে হয়তো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। অর্থাৎ ওইসব ব্যক্তি নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে পারে না এবং এর ফলে তারা কোনো কাজে প্রেষণা পায় না। এই দুই বিপরীতধর্মী ব্যক্তিত্বই আমাদের সমাজে দেখা যায়। নিজের দক্ষতার প্রতি বিশ্বাসকেই আত্ম-কার্যকারিতা (Self-Efficacy) বলে। একজন যোগ্য শিক্ষকের কর্তব্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা, যাতে তারা যেসব বাধার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলিকে সহজে অতিক্রম করতে পারে। ➏ জীবনাদর্শ (Ideals): ব্যক্তির জীবনাদর্শ তার উদ্দেশ্যমুখী আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ ব্যক্তির মধ্যে যে সামগ্রিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে তা তার আচরণের গতি স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করে। বিশেষ চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটলেও মানুষ অভ্যাসবশত ওই কাজ করে থাকে। ➐ অভ্যাস (Habit): প্রত্যেক মানুষেরই কিছু কিছু অভ্যাস থাকে, যা তাকে কোনো বিশেষ কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রেষণা সৃষ্টি করে। যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির চাহিদা খুব বেশি থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত অভ্যাসের গতি নির্ধারণের ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু যখন ব্যক্তির বিশেষ চাহিদার পরিতৃপ্তি ঘটে যায় তখন অভ্যাসবশত মানুষ ওই ধরনের কাজ করে থাকে। একেই মনোবিদ Allport বলেছেন আচরণের স্বয়ংক্রিয়তা (Functional Autonomy)। সুতরাং অভ্যাস প্রেষণার একটি নির্ধারক। ➑ আকাঙ্ক্ষার স্তর (Level of Aspiration): ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষার স্তর তার মধ্যে প্রেষণার সৃষ্টি করে। যে ব্যক্তির সফলতার আকাঙ্ক্ষা যে রকম, তার প্রেষণার স্তরও সেইরকম। যেমন—কোনো বালকের আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে জাতীয় স্তরে খেলা। এই সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ীই তার খেলার প্রেষণা নির্ভর করে। ➒ সাফল্য (Success): সাফল্য প্রত্যক্ষভাবে ব্যক্তির মধ্যে প্রেষণা জাগ্রত করে। কোনো ব্যক্তি কোনো কাজে একবার সাফল্য লাভ করলে সে অন্য কাজ করার জন্যও অনুপ্রাণিত হয়। অর্থাৎ ব্যক্তির সাফল্য তার মধ্যে প্রেষণা সঞ্চার করে। ➓ উদ্‌বোধক (Incentive): বিভিন্ন ধরনের উদ্‌বোধক শিখন প্রক্রিয়ায় প্রেষণা সৃষ্টি করে। এই উদ্‌বোধক মূর্তবস্তু বা বিমূর্ত ধারণা—দু-ধরনেরই হতে পারে। মূর্তবস্তু বা মূর্ত উদ্‌বোধক বলতে বিভিন্ন পুরস্কারকে বোঝায়, আবার বিমূর্ত উদ্‌বোধক বলতে প্রশংসাকে বোঝায়। অর্থাৎ কোনো বিশেষ ধরনের আচরণ করার জন্য যদি সঠিক উদ্বোধক নির্ধারণ করা সম্ভব হয়, তাহলে শিক্ষার্থী স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই আচরণ সম্পাদনে প্রেষণা পায়। ◉ অর্জিত অসহায়ত্ব (Learned Helplessness) : Seligman এবং তাঁর সহযোগী পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রাণী কোনো বিষয়ে বা কাজে বারবার ব্যর্থ হয়, তখন ওই ব্যক্তি বা প্রাণী আর সেই কাজে উৎসাহ পায় না। বারংবার ব্যর্থতার ফলে ব্যক্তির মধ্যে যে অসহায়ত্বের সৃষ্টি হয় তাকে অর্জিত অসহায়ত্ব বলে। ◉ পরিবেশ (Environment): পারিবারিক বা সামাজিক বা শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ কোনো ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীর প্রেষণা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক পরিবেশ যদি উপযুক্ত না থাকে তবে কোনো ব্যক্তি কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে পারে না ফলে সে কাজে প্রেরণা হারায়। একইভাবে শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ উপযুক্ত না হলে শিক্ষার্থীরা পাঠে মনোযোগ দিতে পারে না। ফলে শিক্ষায় প্রেষণার সঞ্চার হয় না।

৪. ম্যাসলো-র তত্ত্বের উল্লিখিত চাহিদাগুলির ব্যাখ্যা দিন। এই তত্ত্বের যে-কোনো তিনটি শিক্ষাগত তাৎপর্য উল্লেখ করুন। 
Explain different needs as mentioned in Maslow's theory Mention any three educational implications of this theory.
ম্যাসলো-র তত্ত্বে বলা হয়েছে প্রাণী তথা মানুষের কাছে প্রথম প্রয়োজন প্রাণধারণ। প্রাণধারণ জন্য খাদ্য, জল, যথার্থ উত্তাপ ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় চাহিদা পূরণ হলে, পরবর্তী উচ্চতর চাহিদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। নিরাপত্তা ও প্রাণধারণের অনুকূলে যা কিছু চাহিদা তা পূরণ হলে মানুষ ভালোবাসা পেতে ও দিতে চায় তার কারণ যে ব্যক্তি বা পরিবার বা সমাজ তাকে খাদ্য, আরাম নিরাপত্তা দেয় তার সঙ্গে শিশু একাত্মবোধ করে। এই রকম একটি পরিবেশেই একজনের পক্ষে নিজের মূল্য তথা সম্মানের চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে। মর্যাদার চাহিদা পূরণ হলে তখন দেখা দেয় আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা। এই চাহিদাগুলির এবং সংশ্লিষ্ট প্রেষণার বিষয়টি আরও একটু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
নীচের চিত্রটিতে ম্যাসলো-র চাহিদার পিরামিডটি দেখানো হয়েছে।


1. জৈবিক ও শারীরবৃত্তীয় চাহিদা (Biological and Physiological Needs) :
জন্মের পর একটি শিশুর কাছে সবচেয়ে বড়ো বিষয় তার অস্তিত্ব রক্ষা করা। জন্মের পূর্বে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কোনো স্বতন্ত্র প্রয়াস দরকার হয়নি। কিন্তু জন্মের পর খাদ্য, জল, শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য নির্মল বায়ু, পরিচ্ছন্ন ও অনুকূল উত্তাপযুক্ত পরিবেশে যথার্থ আবাস প্রাণধারণের একান্ত আবশ্যিক উপাদান। এই চাহিদাগুলি শিশু অনুভব করতে পারে বলেই এর কোনোটির অভাব ঘটলে কান্নার মাধ্যমে তার চাহিদার কথা জানাতে সচেষ্ট হয়। মা ও অন্যান্যরা তার কান্নার ভাষা বুঝতে পারে বলেই চাহিদা পূরণ হয়। কিন্তু শিশুর দিক থেকেও সক্রিয়ভাবে স্তন্যপান করার চেষ্টা হয় বলেই তার চাহিদা পূরণ হয়। সুতরাং সর্বপ্রথম নিম্নতম স্তরের প্রেষণা, প্রাণধারণের উপযোগী চাহিদা পূরণের প্রেষণা। এই চাহিদা সারাজীবনই বজায় থাকে। কারণ সারাজীবনে কখনোই খাদ্য ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় উপাদানের গুরুত্ব কমে যায় না। কিন্তু বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জোগান সরাসরি হয় না। খাদ্য সংগ্রহ করার শক্তি অর্জন, বৃত্তি বা পেশার মাধ্যমে অর্থোপার্জন, অর্থোপার্জনের জন্য বিদ্যাচর্চা, এইভাবে খাদ্যের চাহিদা পূরণের প্রেষণার সামনে আরও নানা চাহিদা ও তা পূরণের জন্য প্রেষণা সৃষ্টি হয়। মানুষের জৈবিক ও শারীরবৃত্তীয় চাহিদা পূরণ না হলে পরবর্তী উচ্চতর চাহিদা পূরণের প্রেষণা সৃষ্টি হয় না।

2. নিরাপত্তার চাহিদা (Safety or Security Needs) :
প্রাথমিক জৈবিক চাহিদা পূরণ হলে প্রাণীর সামনে নিরাপত্তার প্রশ্নটি প্রাধান্য পায়। নিরাপত্তা ও প্রাণধারণ এবং আত্মরক্ষার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু যার খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়নি তার কাছে নিরাপত্তা অর্থহীন। তখন প্রাথমিক চাহিদা পূরণের জন্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলেও কিছু আসে যায় না। নিরাপত্তা শুধুমাত্র যে দৈহিক তা নয় মানসিক নিরাপত্তার চাহিদাও পূরণ হওয়া প্রয়োজন। এই চাহিদার ভিত্তিতেই মানুষের মধ্যে আশ্রয়, প্রকৃতির প্রতিকূলতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রেষণা সৃষ্টি হয়। শিশুর প্রাথমিক নিরাপত্তাবোধ আসে মায়ের যত্ন ও স্তন্যদানের মাধ্যমে। কোলের উদ্বু আরাম তাকে দেয় নিরাপত্তা। ক্রমশ পরিবারের অন্যান্য সদস্য, তারপর পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিই তার নিরাপত্তাবোধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যে সামাজে শিশু বড়ো হয়। শেষ পর্যন্ত সেই সমাজ তার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বড়ো হওয়ার পর বাসস্থান, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপাদান, বিদ্যালয়, জীবিকা তথা পেশা সবকিছু থেকেই নিরাপত্তা পাওয়া যায়। নিরাপত্তা পাওয়ার সম্ভাবনা যেখানেই আছে মানুষ সেখানেই নিরাপত্তা খোঁজে। এমনকি সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও যতটুকু নিরাপত্তা পাওয়া যায় মানুষ তা খুঁজে নেয়। তার কারণ নিরাপত্তার চাহিদা মানুষের মধ্যে স্থায়ী প্রেষণার জন্ম দেয়। নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ হলে তখনই পরবর্তী পর্যায়ের চাহিদা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। মানুষ তখন যার বা যে সূত্র থেকে নিরাপত্তা পায় তার সঙ্গে একাত্মতাবোধ করে।

3. একাত্মতার চাহিদা (Need for Belongingness) :
কোনো মানুষ যদি বলে আমি বাঙালি অথবা ভারতীয়, কিংবা আমার দেশ, তার অর্থ বাংলা বা ভারত নামক ভৌগোলিক সীমার মধ্যে জন্ম ও বসবাস করা বোঝায় না, দেশ নামক একটি কাল্পনিক সত্তার সঙ্গে নিজের অভিন্নতাবোধকে বোঝায়। আর এই অভিন্নতাবোধ এক বিশেষ আনন্দ ও মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করে। ছোটোবেলায় আমার মা, আমার বাবা, আমার বাড়ি বা পরিবার, আমার স্কুল ইত্যাদি অনুভব যে গর্ব ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তার কারণ শিশু এদের কাছে নিরাপত্তা পাওয়ার দরুন নিজেকে এদেরই একজন বলে মনে করতে চায়। এই চাহিদাই একাত্মতার চাহিদা বা অভিন্নতাবোধের চাহিদা।
পরিবার যদি অত্যাচার ও অবহেলার স্থান হয় তখন শিশুর পক্ষে তার প্রতি একাত্মবোধ করা সম্ভব হয় না। আর পরিবারের প্রতি একাত্মতাবোধ না জন্মালে সামগ্রিকভাবে সমাজের সঙ্গেও একাত্মতাবোধের চাহিদা সৃষ্টি হয় না। মানুষ মানসিকভাবে সমাজবিচ্ছিন্ন বা সমাজের প্রতি উদাসীন (Social alienation) এক প্রাণীতে পরিণত হয়। তখন নিজের প্রতি মর্যাদাবোধও অর্থহীন। কারণ ব্যক্তির যদি সামাজিক বন্ধন না থাকে তবে নিজেকে মূল্যহীন ও অবাঞ্ছিত বলে বোধ হয়। সেই কারণে ব্যক্তির একাত্মতাবোধের চাহিদা পূরণ হওয়া প্রয়োজন। এই চাহিদা পূরণের প্রেষণা তখনই জাগ্রত হয় যখন জৈবিক ও নিরাপত্তার চাহিদা যথাযথভাবে সন্তুষ্টি লাভ করে।

4. আত্মসম্মান বা মর্যাদার চাহিদা (Self Esteem Needs) :
কোনো অবস্থাতেই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক একতরফা অভিযোজন মাত্র নয়। ব্যক্তি যেমন নিজেকে পরিবার বা সমাজের একজন হিসেবে ভাবতে চায় তেমনি আশা করে সমাজ ও পরিবার ব্যক্তি হিসেবে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেবে। ছোটো শিশুরাও তার নিজের অস্তিত্বের স্বীকৃতি চায়। দুই বছরেরও ছোটো শিশু নানাভাবে মা-বাবা ও অন্যান্যদের মনোযোগ দাবি করে, তার স্বীকৃতি চায়। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। কোনো মানুষই চায় না তার উপস্থিতি, কথা ও মতামত সম্বন্ধে অন্যরা উদাসীন থাকুক, তার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করুক। তার কারণ একাত্মতার চাহিদা পূরণ হলে মানুষ চায় নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে। যদি তা প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ব্যক্তির কাছে নিজের মূল্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মানুষ নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ, সামাজিক এবং অন্যের চোখে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে গ্রাহ্য বলে মনে করে। তার আত্মমর্যাদার চাহিদা এইভাবেই পূরণ হয়। তবে এই চাহিদা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয় না। ব্যক্তির দিক থেকে চাহিদা ও চাহিদা পূরণের প্রেষণা থাকে বলেই সে নিজেকে একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ হিসেবে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজনীয় প্রয়াস চালিয়ে যায়। আর তার অভীষ্ট পূরণ হলে সে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয়।

5. আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা (Self Actualization Needs) :
সামাজিকভাবে আত্মমর্যাদা স্বীকৃত হলে ব্যক্তি নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্ত গুণ, বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাবনাকে যথাসম্ভব মেলে ধরতে চেষ্টা করে। কারণ নিজের গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ হলে সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা সেই কারণে ম্যাসলো-র তত্ত্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ের চাহিদা এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তির যে প্রয়াস তা তখনই সম্ভব যখন তার আত্মমর্যাদা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। যদি আত্মমর্যাদার চাহিদা পূরণ না হয় তখন নিজেকে প্রকাশ করার, নিজের সর্বপ্রকার সক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার প্রচেষ্টা ও উদ্যম দেখা যায় না। এই কারণে প্রান্তিক সমাজের ব্যক্তিবর্গ অত্যন্ত সীমিতভাবে নিজের প্রতিষ্ঠার কথা ভাবে। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তেমন কিছু থাকে না। নিজের প্রতি প্রত্যাশা ও আস্থা কম থাকার অর্থ ব্যক্তি নিজের সক্ষমতার সন্ধান রাখতে আগ্রহী নয় বা রাখে না। তার কারণ আত্মমর্যাদার অভাব এবং সমাজের সঙ্গে অসম্পূর্ণ একাত্মতা।

ম্যাসলো-র তত্ত্বের তিনটি শিক্ষাগত তাৎপর্য হল—
এই তত্ত্বের দ্বারা ব্যক্তি তার সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
এই তত্ত্বের দ্বারা ব্যক্তির মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করার তাড়নার সঞ্চার হয়।
এই তত্ত্বের দ্বারা ব্যক্তি সমাজে মর্যাদা লাভ করে থাকে।

৫. 'আত্মসামর্থ্য' প্রসঙ্গে আলোচনা করুন। 
Discuss in brief about self-efficacy.
আত্মসামর্থ্যর ধারণা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন Albert Bandura তাঁর 1997 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'Self Efficacy: The Exercise of Control' নামক গ্রন্থে। বিগত বিশ বছরে এই ধারণা গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয় এবং
নানাদিক থেকে বিষয়টির ব্যাপক চর্চা হয়। আত্মসামর্থ্যর ধারণা তাঁর Social Cognitive Theory of Learning তত্ত্বের অংশবিশেষ। Bandura আত্মত্মসামর্থ্যর সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে- নিজের জীবন ও কর্মকুশলতার ধারণা ব্যক্তি নিজে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করে (Individuals belief in their abilities to exert control over their lives, feelings of competency)  সহজ কথায় প্রত্যেক ব্যক্তি ছোটোবেলা থেকেই সে কী পারে বা পারে না, সে কতটা দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম সে সম্বন্ধে নির্দিষ্ট বিশ্বাস পোষণ করে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজের কুশলতা সম্বন্ধে বিশ্বাসের পরিবর্তন হয় কিন্তু আত্মসামর্থ্যর বিশ্বাস থাকেই। আত্মসামর্থ্যর বিশ্বাস নিজের দক্ষতা, সক্ষমতা ইত্যাদির নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন নয়। একান্ত ব্যক্তির বিশ্বাস আমি কী পারি বা পারি না, তার সম্বন্ধে নিজস্ব ধারণা। কিন্তু এই ধারণা পুরোপুরি মনগড়া নয়। কারণ বান্দুর আত্মসামর্থ্যতা গড়ে ওঠার চারটি কারণের কথা বলেছেন।

① সক্রিয়তার মধ্যমে প্রাপ্ত সার্বিক শিখনের অভিজ্ঞতা (Enactive mastery experience): 
আমরা যখন সক্রিয়ভাবে আমাদের পরিবেশকে নিজের অনুকূলে আনতে চাই, বা পরিবেশের উপর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাই তখন সাফল্য বা ব্যর্থতার যে অভিজ্ঞতা ঘটে তা আত্মসামর্থ্য গঠনের অন্যতম ভিত্তি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যখন ব্যক্তি নিজের প্রচেষ্টার ফল হিসেবে লাভ করা যায় তা নিজের কর্মকুশলতা সম্বন্ধে বিশ্বাসকে দৃঢ় করে। ছোটোর যখন কোনো কাজ নিজে করতে চেষ্টা করে তখন তাতে বাধা না পেলে এবং সফল হলে নিজের সক্ষমতা সম্বদে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা যখন শ্রেণিকক্ষে কোনো চিত্র নিজেদের খাতায় এঁকে নিতে পারে, তাদের আত্মসামর্থ্য একইভাবে দৃঢ় হয়।

অপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা (Vicarious experience) : 
অন্যের সাফল্যের অভিজ্ঞতা থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় এখানে সেই পরোক্ষ অভিজ্ঞতার কথাই বলা হয়েছে। যখন সকলেই কোনো কাজ পারে তার ভিত্তিতে ব্যক্তি এই বিশ্বাস অর্জন করে যে সেও পারবে তখন তার আত্মকুশলতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বিপরীতটিও এক্ষেত্রে সম্ভব অর্থাৎ সকলে যা পারে তাতে ব্যর্থ হলে ব্যক্তির আত্মসামর্থ্য অত্যন্ত কমে যায়। সেই কারণে শিক্ষকরা অনায়াসে শিক্ষার্থীদের আত্মসামর্থ্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রথমে এমন ধরনের কৃত্য (Task) নির্দিষ্ট করতে পারেন
যা সকলেই পারে। পরে ধাপে ধাপে অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজ দেওয়া হলে পূর্বার্জিত আত্মসামর্থ্যর দরুন
সম্পন্ন করার প্রেষণা সৃষ্টি হতে পারে।

বাচনিক বাধ্যবাধকতা (Verbal Persuation): 
সরাসরি মৌখিক আদেশের ভিত্তিতে কোনো কাজ বাধ্যতামুলক হিসেবে ঘোষণা করলে, বাধ্যবাধকতার দরুন সকলেই কাজটি করতে চেষ্টা করে তার কারণ মৌখিক নির্দেশ্যে ফলেও আত্মসামর্থ্য বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব। বাধ্য হয়ে কর্ম সম্পাদন করতে করতে মানুষ বেশি সফল হয় যদি কাজে দুরূহতা অত্যন্ত বেশি না হয় এবং তার ফলে আত্মসামর্থ্য বৃদ্ধি পায়। যদি নির্দেশ বা আদেশ এমন ব্যক্তির নিকট  থেকে আসে যার কর্তৃত্ব আছে (যেমন— শিক্ষক, মা-বাবা ইত্যাদি) তবে তার প্রভাব আত্মসামর্থ্য বিকাশের পথে সবচেয়ে সহায়ক।

শারীরবৃত্তীয় ও অনুভবমূলক অবস্থা (Physiological or Affective State): 
যদি শারীরবৃত্তীয় অনুভবমূলক অবস্থা নেতিবাচক হয় তবে কর্মসম্পাদনের ক্ষেত্রে তার আশঙ্কা বারবার ফিরে আসে। যদি কোনে কাজ খুব কষ্টদায়ক (Stressful) হয়, যদি ভীতিজনক মনে হয়, তবে সেক্ষেত্রে আত্মসামর্থ্যর অবনমন ঘটে এবং একই পরিস্থিতিতে ওই ধরনের মানসিক অবস্থা বারবার ফিরে আসে। যে শিক্ষার্থী অঙ্কে ভয় পায়, সহজ বা কঠিন হোক, অঙ্ক কষার প্রয়োজন হলেই তার ভয় হয় এবং আত্মসামর্থ্য কমে যায়।

৬. উপযুক্ত উদাহরণসহ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রেষণার ব্যাখ্যা দিন। মেকলেল্যান্ড-এর প্রেষণার তত্ত্বটি শিক্ষাগত তাৎপর্যসহ আলোচনা করুন। 
Explain the meaning of Extrinsic and Intrinsic motivation with suitable examples. Discuss McClelland's theory of motivation with its educational Implication.)
or,
প্রেষণার সংজ্ঞা দিন। ম্যাকলেল্যান্ডের প্রেষণার তত্ত্বটি ও শ্রেণিকক্ষে এর প্রয়োগ আলোচনা করুন। 
Define motivation. Discuss McClelland's theory of motivation and its classroom implications.
মনোবিদ Weiner-এর মতে, প্রেষণা হল এমন একটি অবস্থা, যা আমাদের বিশেষ একটি কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে, কাজকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী করে এবং লক্ষ্যপুরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে কাজে ব্যস্ত রাখে। প্রেষণা মানুষকে কর্মে উদ্বুদ্ধ করে, আচরণ নির্দিষ্ট করে ও নিয়ন্ত্রণ করে এবং উদ্দেশ্যমুখী আচরণে প্রবৃত্ত করে। মনোবিদগণ প্রেষণাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- অভ্যন্তরীণ প্রেষণা (Intrinsic Motivation): অভ্যন্তরীণ প্রেষণার অন্যতম শর্ত হল—কোনো বাহ্যিক উদ্দীপক বা পুরস্কার ছাড়াই ব্যক্তি উদ্দেশ্যপূরণের জন্য ক্রিয়াশীল হয়। এর প্রধানতম শক্তি হল ব্যক্তির নিজের চাহিদা, প্রবণতা, আগ্রহ, কৌতূহল ইত্যাদি। ② বাহ্যিক প্রেষণা (Extrinsic Motivation): বাহ্যিক প্রেষণার ক্ষেত্রে ব্যক্তি আপাতভাবে কোনো নির্দেশ মেনে নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাহ্যিক প্রেষণা সৃষ্টি হয় সামাজিক চাপ, পুরস্কার, বাহ্যিক নানা উন্মাদনা ও প্রকৃতি থেকে। শুধুমাত্র বাহ্যিক আচরণ দেখে কোনটি অভ্যন্তরীণ ও কোন্‌টি বাহ্যিক প্রেষণা থেকে উদ্ভূত তা বোঝা যায় না। আচরণের কারণ বা উৎস বিশ্লেষণের সময়ই কোন্‌টি অভ্যন্তরীণ ও কোটি বাহ্যিক প্রেষণা তা বোঝা যায়। যেমন—একজন ছাত্র গানবাজনা বা আঁকা তার নিজস্ব আগ্রহে করতে পারে (অভ্যন্তরীণ), আবার ওই একই কাজ সমাজে বা পরিবারের কারোর দ্বারা প্রভাবিত হয়েও করতে পারে (বাহ্যিক)। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের আচরণগুলি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুই প্রকার প্রেষণার একটি ধারাবাহিকতার মাঝামাঝি স্তরে বিচরণ করে। তবে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রেষণা কোনো ধারাবাহিকতার দুটি প্রান্ত নয়, সম্পূর্ণ পৃথক দুটি অবস্থান। এগুলি পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণহীন। তবে আমাদের প্রতিটি কাজই কিছুটা অভ্যন্তরীণ ও কিছুটা বাহ্যিক প্রেষণার ফল।

সাম্প্রতিককালে সাফল্যলাভের প্রেষণার (Achievement Motive) উপর মনস্তত্ত্ববিদ, সমাজতত্ত্ববিদ এবং শিক্ষাবিদের নজর আকর্ষিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আর্থিক বিকাশের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে আমরা সকলেই সচেতন। মনস্তত্ত্ববিদগণ বিষয়টিকে সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রক্ষমতা এমনকি দার্শনিক দিক থেকে বিচার করেছেন। ব্যক্তির সামাজিকতা দেশের আর্থিক উন্নয়ন সম্পর্কিত সমস্যার উপর কী প্রভাব ফেলে তা মনস্তত্ত্ববিদদের নিকট বিরাট প্রশ্ন। বিভিন্ন দেশের আর্থিক উন্নয়নের বৈষম্যের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলি সম্পর্কে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক David MeClelland অনুসন্ধান করেন। তিনি মনে করেন, ব্যক্তি ও জাতির মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করলে এই বিষয়ে অনেক তথ্য জানা যেতে পারে। আর্থিক উন্নয়নের পশ্চাতে গতানুগতিক আর্থিক উপাদানের ধারণাকে তিনি বাতিল করেন। তিনি তাঁর, ‘Acheiving Society' নামক পুস্তকে এই বিষয়ে একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, কেবলমাত্র আর্থিক উপাদানের দ্বারা ধনতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাঁর মতে, ব্যক্তির মৌলিক বিকাশ এবং মনোভাব দেশের আর্থিক বিকাশে প্রেরণ সঞ্চার করে। তিনি আরও বলেন, 'সাফল্যলাভের প্রেষণা'র মাত্রার দিক থেকে ব্যক্তিগত পার্থক্য বর্তমান। ব্যক্তির মধ্যে এই পার্থক্য বিভিন্ন দেশের আর্থিক বৈষম্যের অন্যতম কারণ।

1951 খ্রিস্টাব্দে MeClelland এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর সহযোগীগণ ‘সাফল্য লাভের প্রেষণা'র উপর একটি তত্ত্ব প্রকাশ করেন। সাফল্যলাভের প্রেষণার সংজ্ঞায় তিনি বলেছেন, “A reintegration of a change in a fact by a cue and anticipation of a future change in affect contingent upto certain actions." তাঁর এই সংজ্ঞায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্তমান। প্রথমটি হল ‘reintegration', যার অর্থ হল পারিপার্শ্বিক কোনো ঘটনা, যা ব্যক্তির মধ্যে সচেতনভাবে মানসিক প্রক্রিয়াগুলিকে পুনরায় সচল করে। অপরটি হল 'cue' যার অর্থ হল এর ফলে ব্যক্তির মধ্যে অনুভূতির সঞ্চার হয়। উদাহরণস্বরূপ দীর্ঘকাল পরে শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ কোনো শিক্ষার্থীর মনে পুরোনো দিনের মানসিক প্রক্রিয়াগুলি সক্রিয় হয়।

MeClelland এবং Atkinson-এর মতে, প্রত্যেক মানুষই চায় বিভিন্ন কর্মে সাফল্যলাভ করতে। শিশু অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে সাফল্যলাভের আকাঙ্ক্ষা বিকাশ লাভ করে। এই আকাঙ্ক্ষা বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন। যার মধ্যে সাফল্যলাভের আকাঙ্ক্ষা যত বেশি তার সফল হওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি। যেমন—কোনো শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় প্রথম তিন জনের মধ্যে থাকার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থী চায় ওই পরীক্ষায় মোটামুটি ফলাফল, আবার কেউ চায় কেবল পরীক্ষায় পাস করতে। সুতরাং এই সাফল্যলাভের আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তিগত। Atkinson-এর মতে, সাফল্য লাভের আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যেই ব্যর্থতা এড়ানোর জন্য একটি আকাঙ্ক্ষা থাকে। কিছু কিছু ব্যক্তি আছেন যাঁরা সাফল্য লাভ করার জন্যই কাজ করেন। যেমন—কোনো ক্লাসের বা শ্রেণির কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যলাভ করার জন্য শুরু থেকেই পঠনপাঠনের চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সাফল্যলাভ করে থাকে। অপরপক্ষে কিছু ব্যক্তি আছেন যাঁরা প্রথম থেকেই ভেবে থাকেন, তাঁরা ওই কাজে ব্যর্থ হবেন এবং ব্যর্থতার আশঙ্কায় আচ্ছন্ন হয়ে ওই কাজে সক্রিয় হন। এই ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। 

Atkinson এবং Litwin বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, যেসব ব্যক্তির সাফল্যলাভের ইচ্ছা খুব বেশি তাঁরা কাজের লক্ষ্যমাত্রা এমনভাবে স্থির করেন, যাতে সাফল্য এবং ব্যর্থতার সম্ভাবনা সমান থাকে। অপরপক্ষে যেসব ব্যক্তি ব্যর্থ হবেন বলেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাঁরা কাজের লক্ষ্যমাত্রা এমনভাবে স্থির করেন, যেটি অত্যন্ত কঠিন, যা তাঁদের পক্ষে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। স্বভাবতই সেই কাজে ব্যর্থ হলে তাঁরা কাজের কঠিনতাকেই দায়ী করেন। তাঁরা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে যুক্তি দেখান যে, কাজটি কঠিন হওয়ার জন্যই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। আবার অনেক সময় এই শ্রেণির ব্যক্তিগণ অত্যন্ত সহজ লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন। ব্যর্থ হলে তাঁরা যুক্তি দেখান যে, বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এই শ্রেণির ব্যক্তিরা বিভিন্ন কাজে সফল হলেও পরবর্তী কাজের জন্য ব্যর্থতার আশঙ্কা করে থাকেন।

❑ ম্যাকলেল্যান্ড এবং শ্রেণি শিক্ষণের প্রেষণা (McClelland and Motivation of Class Teaching) :
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রেষণা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ম্যাকলেল্যান্ড-এর গবেষণা খুবই উল্লেখযোগ্য। এই প্রসঙ্গে তিনি 12টি কৌশলের কথা বলেন। এগুলি হল—
  1. লক্ষ্য স্থিরকরণ (Setting goals): শিক্ষার্থীর সামর্থ্যমতো লক্ষ্য স্থির করতে হবে।
  2. কারণ নির্ণয় (Giving reasons): শিক্ষার্থীকে বোঝাতে হবে সার্থকভাবে বেঁচে থাকার জন্য পাঠ্যবিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
  3. প্রেষণা সৃষ্টিকারী মানসিকতার শিক্ষা (Teaching thoughts that motivate): তাড়না এবং নিষ্ঠা সাফল আনয়ন করে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে।
  4. চিন্তাকে কার্যকারী করা (Relating thoughts to action): শিক্ষার্থীদের পাঠাগার ব্যবহারে উৎসাহ দিতে হবে। কাজে আগ্রহী করে তুলতে হবে এবং অন্যান্যদের প্রতি আগ্রহী হতে হবে।
  5. জীবনের সঙ্গে পাঠ্যবিষয়ের সম্পর্কস্থাপন (Relate course to life) : শ্রেণির কাজের সঙ্গে বাস্তবের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করাতে হবে।
  6. পাঠোন্নতি সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ (Keep a record of progress): শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠোন্নতি সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ করবেন এবং মাঝে মাঝে তা জানিয়ে পাঠের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ সঞ্চারে সচেষ্ট হবেন।
  7. শিক্ষার্থীদের উয় সহযোগিতা (Give wormth support): শিখন অভিজ্ঞতা অর্জনে শিক্ষার্থীকে উয় সহযোগিতা দিতে হবে।
  8. উত্তম পরিবেশের ব্যবস্থা করা (Provide good environment): শ্রেণিকক্ষে উত্তম পরিবেশের ব্যবস্থা করতে হবে।
  9. সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা (Deal with cultural value): শিক্ষার্থীর মধ্যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গড়ে
  10. শিক্ষার্থীকে দায়বদ্ধ করা (Get commitment from the learners) : শিক্ষার্থীর নিকট থেকে নির্দিষ্টমাত্রার দায়বদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
  11. উন্নতি প্রদর্শন (Demonstration progress): ব্যক্তিভিত্তিক শিক্ষার্থীদের উন্নতির তালিকা প্রস্তুত করতে হবে।
  12. দল সচলতার প্রয়োগ ( Use group dynamics ) : দল সচলতাকে সক্রিয় করে তুলতে হবে।

৭. প্রেষণা প্রসঙ্গে ওয়াইনার-এর সাফল্য বা ব্যর্থতার কারণ আক্ষেপণ তত্ত্বটি বর্ণনা করুন। তত্ত্বের শিক্ষাগত গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করুন। 
Describe Weiner's attribution theory of motivation. Discuss the educational importance of the theory.
কারণ নির্দেশক তত্ত্বের প্রবক্তা বার্নার্ড ওয়াইনার। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীর বৌদ্ধিক বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য উভয়ের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে প্রেষণার সৃষ্টি হয়। ওয়াইনার তাঁর তত্ত্বে বলেছেন, শিক্ষার্থীর সাফল্য-অসাফল্য কয়েকটি মৌলিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলি হল- নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (Locus of Control): শিক্ষার্থীর প্রেষণার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র তার অভ্যন্তরীণ মানসিক শক্তি হতে পারে অথবা বাইরের কোনো উদ্দীপক দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বিভিন্ন প্রাক্ষোভিক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র অভ্যন্তরীণ হলে শিক্ষার্থীর মধ্যে অপরাধবোধ ও উদ্‌বেগ তৈরি হয়। স্থায়িত্ব (Stability): যে বৈশিষ্ট্যগুলি সহজে পরিবর্তিত হয় না সেগুলিকে স্থায়ী বৈশিষ্ট্য বলে। যেমন—শিক্ষার্থীর ক্ষমতা, দক্ষতা, শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি। স্থায়ী বৈশিষ্ট্যগুলিই শিক্ষার্থীর সাফল্য বা অসাফল্যের কারণ। আবার অস্থায়ী বৈশিষ্ট্যগুলি হল শিক্ষার্থীর অসুস্থতা, ভাগ্য ইত্যাদি। নিয়ন্ত্রণযোগ্যতা (Controllability): শিশু তার সাফল্য ও অসাফল্যের কারণগুলিকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে তা নির্ভর করে তার নিজের বিশ্বাসের উপর। যেমন—শিক্ষার্থী সফল হওয়ার জন্য কতটা প্রচেষ্টা করবে তা তার নিয়ন্ত্রণাধীন কিন্তু কাজটি কতটা কঠিন হবে সেটি তার নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। শিক্ষার্থীর অসাফল্যের কারণ যদি বাহ্যিক এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য না হয় তাহলে তার মধ্যে অর্জিত অসহায়ত্ব (Learned Helplessness) সৃষ্টি হয়। 

উপরোক্ত তিনটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীর সাফল্য ও অসাফল্যের কারণ হিসেবে ওয়াইনার চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। এগুলি হল-
  1. সক্ষমতা (Ability): ব্যক্তি সাধারণত কোনো কাজে তার সাফল্য বা ব্যর্থতার উপর ভিত্তি করে তার সক্ষমতা বিচার করে। কোনো কাজে সফল হলে ব্যক্তি নিজেকে সেই কাজে সক্ষম মনে করে, আবার ব্যর্থ হলে নিজেকে অক্ষম মনে করে। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে এই মূল্যায়ন সবসময় নৈর্ব্যক্তিক নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে অন্যদের সাফল্য বা ব্যর্থতা ব্যক্তির সক্ষমতা বিচারের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতপক্ষে, ক্ষমতা ছাড়া অন্যান্য নানা কারণেই সাফল্য বা ব্যর্থতা আসতে পারে। সুতরাং, সাফল্য বা ব্যর্থতার কারণগুলিকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। শিক্ষার্থীর প্রেষণা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, আত্মসম্মানবোধ ব্যাহত না হয় তার জন্য তাকে সফল হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
  2. প্রচেষ্টা (Effort): যে-কোনো কাজে প্রথমবার কতটা প্রচেষ্টায় কতটা সাফল্য আসতে পারে সে সম্পর্কে ব্যক্তির কোনো ধারণা থাকে না। তাই প্রথমবার সাফল্য বা ব্যর্থতার কারণ হিসেবে প্রচেষ্টাকেই দায়ী করে এবং পরবর্তী প্রচেষ্টার মান নির্ণয় করার চেষ্টা করে। সাফল্য ও ব্যর্থতাকেই মাপকাঠি ধরলে প্রচেষ্টার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং ছোটো ছোটো সাফল্য বা ব্যর্থতাতে প্রভাবিত না হয়ে শিক্ষার্থী যাতে ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় তার জন্য প্রেষণা সৃষ্টি করতে হবে।
  3. কাজের দুরূহতা (Task Difficulty): কাজের দুরূহতা নির্ণীত হয় সক্ষমতা ও প্রচেষ্টার মধ্যে সামঞ্জস্যতা বিচার করে। সক্ষমতা ও প্রচেষ্টা যথেষ্ট মাত্রায় থাকলেও যদি সাফল্য না আসে তাহলে সেই কাজকে দুরূহ কাজ বলে। এক্ষেত্রে সক্ষমতার সঙ্গে প্রচেষ্টা যুক্ত না হলে এই বিচার সম্ভব নয়। তবে প্রচেষ্টা যেহেতু নিয়ন্ত্রণ যোগ্য উপাদান, তাই প্রচেষ্টার মাত্রা বাড়িয়ে দুরূহতার মাত্রা কিছুটা কমানো যায়। আবার এই মাত্রা অতিরিক্ত হলে প্রেষণার মাত্রা হ্রাস পায়। যে কাজে অধিকাংশ মানুষ সফল, তার দুবৃহতার মাত্রা কম। সুতরাং, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য এমন কার্যক্রম নির্ধারণ করবেন যাতে শিক্ষার্থী কিছুটা অন্তত সফলতার স্বাদ পায়, যাতে যে-কোনো কাজকেই তার দুরূহ বলে মনে না হয়।
  4. ভাগ্য (Luck): কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণীত না হলে ব্যক্তি কোনো কাজে ব্যর্থতার জন্য ভাগ্যকেই দায়ী করে। প্রেষণায় নিয়ন্ত্রিত উপাদানগুলির মধ্যে সামগ্রস্য না থাকলেই এই ঘটনা ঘটে। সুতরাং, এক্ষেত্রে প্রেষণার মান অতি নিম্নমানের। ভাগ্যের উপর এই নির্ভরশীলতা প্রেষণা ও প্রচেষ্টা দুই-ই কমাতে থাকে।

শিক্ষাক্ষেত্রে ওয়াইনার-এর তত্ত্বের প্রয়োগ (Application of Weiner's Theory in Education) :
  • বর্তমান সমাজব্যবস্থায় শিক্ষাক্ষেত্রে এবং পারিবারিক নানা ক্ষেত্রে সাফল্য ও ব্যর্থতা অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। তাই শিক্ষার্থীকে এ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান দেওয়া প্রয়োজন যাতে সে নিজেই সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ নির্দেশ করতে পারে। 
  • শিশু যেন সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয় প্রকার অভিজ্ঞতাই অর্জন করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষক এবং অভিভাবকদের এই বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এমন কোনো তথ্য বা মনোভাব সঞ্চালিত না হয়, যা শিক্ষার্থীর প্রেষণা হ্রাস করে।
  • কীভাবে শিক্ষার্থীরা প্রেষণায় উদ্বুদ্ধ হবে বা কী কারণে তারা প্রেষণায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে না সে সম্পর্কে শিক্ষকের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
  • যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে যে, তাদের প্রচেষ্টা ও পদ্ধতির মধ্যে কোনো ত্রুটি আছে তারা ব্যর্থ হলেও প্রেষণার উন্নত মান বজায় রেখে প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। আর যারা তা বুঝতে পারে না তাদের প্রচেষ্টা কমে যায়। তাই শিক্ষকের উচিত মূল্যায়নের পরেই শিক্ষার্থীকে তার সাফল্য বা ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে বাস্তবসম্মত নির্দেশনা ও পরামর্শদান করা।

📢 More Updated Soon ...

No comments

Hi Welcome ....