Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Top Ad

Breaking News:

latest

(আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) HS Political Science Suggestion 2024

উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম অধ্যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সাজেশন 2024 1. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা দাও। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের...


উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম অধ্যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সাজেশন 2024

1. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা দাও। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ধারা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
2. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বোঝো? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য কী?
3. বিশ্বায়ন কাকে বলে? বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো।
4. বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দাও। বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ পর্যালোচনা করো।
5. বিশ্বায়নের ফলাফল আলোচনা করো।
6. জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক আলোচনা করো।

1. আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা দাও। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের ধারা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
❒ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা : বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অনেক সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমার্থক বলে মনে করা হয়, এর ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর 'Politics Among Nations' গ্রন্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বদলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি শব্দটি ব্যবহার করেছেন।অধ্যাপক পামার ও পারকিনস, হলসটি এবং শ্লেইচার প্রমুখ লেখকরা তা করেননি। তাঁরা মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি দুটি আলাদা বিষয়, তাই এদের মধ্যে পার্থক্যও বিদ্যমান। তা ছাড়া, এঁরা বিশ্বাস করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি অনেক ব্যাপক, তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কখনোই আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখা ঠিক নয়। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে।

❒ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশধারা : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছে আধুনিককালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। অবশ্য বহু আগে অনেক বিখ্যাত লেখক তাঁদের রচনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে কিছু মৌলিক চিন্তাভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন চিনের দার্শনিক মেনসিয়াস, ভারতের কৌটিল্য, ইতালির মেকিয়াভেলি প্রমুখ। নিন্মে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো― 

(১) জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : পণ্ডিতদের মতে, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তির ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূচনা হয়। তার আগে রাষ্ট্রব্যবস্থা যে ছিল না তা নয়, তবে প্রাচীন গ্রিসে, চিনে, ভারতে, মিশরে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল তাকে কোনোভাবেই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যায় না। যাকে আমরা ভুখণ্ডকেন্দ্রিক সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র বলছি, তার উৎপত্তি ঘটে ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে। ইউরোপের নবজাগরণ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফসল হলো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।

(২) শিল্পবিপ্লব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংলান্ডে যে শিল্পবিপ্লব ঘটে তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে অনেকে মনে করেন। শিল্পবিপ্লবের ফলে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি ঘটে এবং এর ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টি আরও সহজ হয়। রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে আরও কাছাকাছি চলে আসে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

(৩) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯) ও যুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনাবলির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যালোচনার বিষয়টি নতুন মাত্রা লাভ করে। এই সময় থেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে এবং শুরু হয় নতুন চিন্তাভাবনার।

(৪) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৪ খ্রি.) পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতির আমূল পটপরিবর্তন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর ৫১টি রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (UNO)।

(৫) নয়া বিশ্বব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৪৬ বছর পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক নতুন দিকে মোড় নেয়। এই সময় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে তার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘকাল যাবৎ চলে আসা ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই সময় সারা বিশ্বে একক মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতার মেরুকরণ একমুখী হওয়ায় এই সময় থেকে একমেরু বিশ্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

(৬) বিশ্বায়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : বিশ্বায়নের যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছিল জাতি-রাষ্ট্রের আলোচনাকে কেন্দ্র করে। সেখানে এখন বহু বিষয় আলোচ্য সূচির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আসলে যে জাতি-রাষ্ট্রের প্রভাব এককালে বিশাল ছিল, তা এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বায়নের যুগে অধ্যাপক জল বেইলিস এবং স্টিভ স্মিথ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় যেসব নতুন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থতত্ত্ব, পরিবেশগত সমস্যাসমূহ, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসারণ, সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থ, দারিদ্র্য, উন্নয়ন ও ক্ষুধা, মানবাধিকার, নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রভৃতি।

উপসংহার : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিবর্তনের প্রক্রিয়া জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভবের যুগে শুরু হওয়ার পর বিশ্বায়নের এই যুগে এসেও থমকে যায়নি। বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি গতিশীল বিষয়। তাই এর বিবর্তনের প্রক্রিয়া আজও চলমান।
                               __________________


2. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে কী বোঝো? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য কী?
❒ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা : বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অনেক সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমার্থক বলে মনে করা হয়, এর ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিখ্যাত লেখক হ্যান্স জে মর্গেনথাউ তাঁর 'Politics Among Nations' গ্রন্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বদলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি শব্দটি ব্যবহার করেছেন।অধ্যাপক পামার ও পারকিনস, হলসটি এবং শ্লেইচার প্রমুখ লেখকরা তা করেননি। তাঁরা মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি দুটি আলাদা বিষয়, তাই এদের মধ্যে পার্থক্যও বিদ্যমান। তা ছাড়া, এঁরা বিশ্বাস করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি অনেক ব্যাপক, তাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কখনোই আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করে দেখা ঠিক নয়। বস্তুত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে।

❏ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে যেসব পার্থক্য রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
[1] আলোচনাক্ষেত্রের পরিধিগত পার্থক্য : পণ্ডিতদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির তুলনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনাগত পরিধি অনেক ব্যাপক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধু যে রাষ্ট্রগুলির মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে তাই নয়, অ-রাষ্ট্রীয় (non-state) সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়েও আলোচনা করে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধুমাত্র রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে না, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সম্পর্ক নিয়েও বিচারবিশ্লেষণ করে। অধ্যাপক পামার ও পারকিনসের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিকউভয় ধরনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করে। 

[2] বিষয়বস্তুগত পার্থক্য : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে প্রধানত ক্ষমতার লড়াইকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয়গুলির সঙ্গে জড়িত, ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য বা নতুন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিরোধ ও সংঘর্ষের ধারণা এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । অন্যদিকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতামূলক ও প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক, শত্রুতা ও মিত্রতামূলক সম্পর্ক, সংঘর্ষ ও সমন্বয় সব কিছু নিয়েই আলোচনা করে।
 
[3] দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য : আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত পার্থক্য বিদ্যমান। কে জে হলসটি-র মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনাকে অনেক সময় পররাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এখানে মূলত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতার উপাদান, পারস্পরিক সম্পর্ক ও ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতি ওপরে বেশি জোর দেওয়া হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি তা নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়গুলি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। 

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে আন্তর্জাতিক সমাজের যে পরিচয় মেলে তা আংশিক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সমকালীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার একটি সামগ্রিক পরিচয়কে তুলে ধরতে চায়।
                               __________________


3. বিশ্বায়ন কাকে বলে? বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলোচনা করো।
❏ বিশ্বায়ন : বর্তমান বিশ্বের এক বহু আলোচিত শব্দ হল গ্লোবালাইজেশন যার বাংলা প্রতিশব্দ বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন। সাম্প্রতিককালের বহু ব্যবহৃত ও পরিচিত শব্দ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বায়নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। সহজ কথায় বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের বিস্তারের কথা বলে। অর্থনীতির প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্বায়নের মূলকথা হল মুক্ত বা খোলাবাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন চায় সমগ্র বিশ্বকে একটি বাজারে পরিণত করতে, যেখানে দেশের বাজার আর বিশ্বের বাজারের মধ্যে কোনো বাধার প্রাচীর থাকে না। কোনো দেশ যে জিনিস ভালো উৎপাদন করবে, সে তা বিদেশে রপ্তানি করবে এবং বিদেশি মুদ্রা রোজগার করবে। উলটোদিকে, যা সে উৎপাদন করতে পারবে না, সেই জিনিসগুলি সে বিদেশ থেকে আমদানি করবে অর্থাৎ, বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল।

❏ বিশ্বায়নের প্রকৃতি : বিশ্বায়ন কোনো নতুন ধারণা নয়। বিশ্বায়ন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া যা বহু পূর্বেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বজায় ছিল। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে প্রয়োগের কাজ গত শতাব্দীতে, বিশেষত ১৯৯০-এর পর শুরু হয়। রোল্যান্ড রবার্টসন-এর মতে বিশ্বায়ন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা (New World Order) প্রসারের ধারণার সঙ্গে জড়িত। পুঁজির অবাধ চলাচল, মুক্তবাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ প্রভৃতি ধারণার সঙ্গে বিশ্বায়ন ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। বিশ্বায়নের প্রকৃতিকে মূলত যে সমস্ত দিক থেকে আলোচনা করা যেতে পারে সেগুলি হল—

[1] অর্থনৈতিক দিক: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মূলভিত্তি হল তার অর্থনৈতিক প্রকৃতি। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং গ্যাট (General Agreement on Trade and Tariff) চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে গঠিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO) অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়িত করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রধান দিকগুলির মধ্যে রয়েছে বিশ্ববাণিজ্যের দ্রুত প্রসার, লগ্নি পুঁজির অবাধ আদানপ্রদান, বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে অভিগমন ও নির্গমন, দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ ও অন্যান্য বিনিময় মাধ্যমের সঞ্চালন, বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রযুক্তির আদানপ্রদান, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যমাধ্যমের বিস্তার প্রভৃতি।

[2] রাজনৈতিক দিক : রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতি-রাষ্ট্রগুলির সাবেকি চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছেবিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে ‘একটি বাজারকেন্দ্রিক সংগঠন’-এ পরিণত করেছে। অবশ্য জাতি-রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিলোপসাধন বা বিশ্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মকাণ্ড বিশ্বায়নে দেখা যায় না। অধ্যাপক হলটন তাঁর গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড দ্য নেশন স্টেট (Globalization and The Nation State) শীর্ষক রচনায় জাতি-রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন— জাতি-রাষ্ট্রগুলি যে পৃথিবীতে বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে । বিশ্বায়ন হল এই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। বিশ্বায়নের বিভিন্ন দিক জাতি- রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন সাধন করেছে। এই ধরনের পরিবর্তন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের চিরাচরিত ধারণার অবসান ঘটাতে পারে।

[3] সাংস্কৃতিক দিক : সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের প্রধান লক্ষ্য হল সারা বিশ্বে এক সমজাতীয় সংস্কৃতি (homogeneous culture) গড়ে তোলা। সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন ইনটারনেট-সহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রচার শুরু করেছে, এর ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ন হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে যে সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায় তাকে অনেকে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এভাবে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন তৃতীয় বিশ্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে এক সংকটের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে । অবশ্য সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন বিশ্বের জাতি-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটাতে এবং স্বল্পব্যয়ে উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে সাহায্য করেছে বলে অনেকে মনে করেন।

[4] পরিবেশগত দিক : পরিবেশবিদদের মতে, বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বিশ্বের পরিবেশগত ক্ষেত্রে এক সংকট সৃষ্টি করেছে। কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য প্রাকৃতিক পরিবেশকে শুধু যে বিনষ্ট করে চলেছে তাই নয়, তাকে পণ্যায়িতও করেছে। পরিবেশবিদ বন্দনা শিবা তাঁর গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (Globalization and Environment) শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন—“পৃথিবীর মূল সম্পদগুলি হল স্থল, জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্য। বিশ্বায়নের প্রভাবে এই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলি পণ্যে রূপান্তরিত হচ্ছে। নতুন ধরনের সম্পদ হিসেবে এই উপাদানগুলি উপজাতি ও কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বিশ্বায়িত কর্পোরেশনগুলির নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বায়িত বাণিজ্যের চুক্তিগুলি জাতীয় সংবিধানকে অবনমিত করে, যার অর্থ নাগরিকদের জীবনের প্রতি অধিকার, স্থল, জল এবং পরিবেশগত বৈচিত্র্যের প্রতি অধিকারের অবলুপ্তি”।
                               __________________


4. বিশ্বায়নের সংজ্ঞা দাও। বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ পর্যালোচনা করো।
❏ বিশ্বায়নের সংজ্ঞা : বর্তমান বিশ্বের এক বহু আলোচিত শব্দ হল গ্লোবালাইজেশন (Globalization) যার বাংলা প্রতিশব্দ বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন। সাম্প্রতিককালের বহু ব্যবহৃত ও পরিচিত শব্দ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বায়নের কোনো সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। সহজ কথায় বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের বিস্তারের কথা বলে। অর্থনীতির প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্বায়নের মূলকথা হল মুক্ত বা খোলাবাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন চায় সমগ্র বিশ্বকে একটি বাজারে পরিণত করতে, যেখানে দেশের বাজার আর বিশ্বের বাজারের মধ্যে কোনো বাধার প্রাচীর থাকে না। কোনো দেশ যে জিনিস ভালো উৎপাদন করবে, তা বিদেশে রপ্তানি করবে এবং বিদেশি মুদ্রা রোজগার করবে। উলটোদিকে, যা সে উৎপাদন করতে পারবে না, সেই জিনিসগুলি সে বিদেশ থেকে আমদানি করবে। 

অর্থাৎ, বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। পণ্য, পরিসেবা, প্রযুক্তি, তথ্য ইত্যাদি বিষয়গুলি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের মধ্যেই অবাধে আদানপ্রদান করা যাবে। বস্তুত যখন দেশে বাণিজ্যিক লেনদেন ও আদানপ্রদানের ওপর কৃত্রিম কোনো বাধানিষেধ থাকে না, যখন বিভিন্ন দেশের মধ্যে মূলধন, শ্রম ইত্যাদির গমনাগমন বাজারি শক্তির স্বাধীন ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার দ্বারা নির্ধারিত হয়, তখনই বিশ্বায়ন ঘটে। বিশ্বায়ন হল বিশ্বজুড়ে প্রসারিত একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা রাষ্ট্র সংক্রান্ত সমস্ত সংকীর্ণ ধারণার অবসান ঘটে এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অবাধ আদানপ্রদানের পথ সহজ হয়। জোশেফ স্টিগলিৎস-এর মতে, বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠ সংহতিসাধন যা পরিবহণ ও যোগাযোগের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস করেছে এবং দ্রব্যসামগ্রী, পরিসেবা, পুঁজি, জ্ঞান এমনকি পৃথিবী জুড়ে মানুষের অবাধ যাতায়াতের অধিকারের ওপর আরোপিত কৃত্রিম বাধানিষেধকেও অতিক্রম করেছে।

❏ বিশ্বায়নের বিভিন্ন রূপ : বিশ্বায়নের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর কয়েকটি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়, যথা—
[1] অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন : সমগ্র বিশ্বজুড়ে একই ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের আবির্ভাব ঘটেছে । অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ধারণা অনুযায়ী সমস্ত দেশের অর্থনীতিই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মূলধন ও প্রযুক্তির বিশাল প্রবাহ, পণ্য ও পরিসেবার বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে জাতীয় অর্থনীতিসমূহকে নতুনভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত করে সমগ্র বিশ্বে এক অখন্ড বাজার গড়ে তুলেছে। একুশ শতকের বিশ্ব-অর্থনীতির মুখ্য পরিচালক ও নিয়ন্তা হিসেবে বহুজাতিক সংস্থা, শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বৃহদাকার আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা হল সবচেয়ে ক্ষমতাবান। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলির অর্থনীতি ও উন্নয়ন এদের নীতি ও নির্দেশের ওপর নির্ভরশীল।এইভাবে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের পথ সুদৃঢ় হচ্ছে।

[2] রাজনৈতিক বিশ্বায়ন : জাতীয় রাষ্ট্রক্ষমতার সংকোচন, ন্যূনতম রাষ্ট্রের ধারণার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর সংকোচন, শ্রমিক সংগঠনের ব্যাপারে জনগণের অনীহা রাজনৈতিক বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য হিসেবে এগুলি চিহ্নিত হতে পারে| সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের পথ ধরে সুদূর অতীতে যেভাবে অনুন্নত রাষ্ট্রগুলির ওপর সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিকতাবাদী রাষ্ট্রগুলি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, একইভাবে বর্তমানে বিশ্বায়নের পথ ধরে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর আধিপত্য কায়েম করে রাজনৈতিক বিশ্বায়নকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

[3] সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়নের প্রবক্তারা মনে করেন যে, সমগ্র বিশ্বে সংস্কৃতিগত সমরূপতাই হল সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের মূলকথা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংস্থাগুলি বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নানান সাংস্কৃতিক প্রবাহকে জাতিগত ও ভৌগোলিক গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর এবং এই কাজে প্রধান সহায়ক হয়েছে ইনটারনেট ব্যবস্থার মতো অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমগুলি এর ফলে স্বল্প ব্যয়ে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ পারস্পরিক সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে।

উপসংহার : এ কথা ঠিক যে, উন্নত বা উন্নয়নশীল সকল দেশেই বিশ্বায়ন আজ পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এর কুফল দেখা দিতে শুরু করেছে। বিশ্বায়ন আজ ধনী ও দরিদ্র দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যই শুধু বৃদ্ধি করেনি, উন্নয়নশীল দেশগুলির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবনধারাকে বিনষ্ট করেছে।
                               __________________


5. বিশ্বায়নের ফলাফল আলোচনা করো।
❏ ভূমিকা :  বিশ্বায়ন (Globalization) একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। জোশেফ স্টিগলিৎস-এর মতে, বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল—

[1] উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি : বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতির ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে | এডওয়ার্ড এস হারমানের মতে বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী মানুষের আয়ের ফারাক ১৯৬০ সালে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ সালে ৮২:১-এ দাঁড়িয়েছে।

[2] বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ:  বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি, এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্যাবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয় কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।

[3] বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য বিস্তার : বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Measures or TRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। কোনো কোনো বহুজাতিক সংস্থার বার্ষিক আয় একটি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, মার্কিনি বহুজাতিক সংস্থা জেনারেল মোটরসের বার্ষিক আয় নরওয়ের জাতীয় আয়কে অতিক্রম করেছে। আবার মার্কিনি তেল সংস্থা এক্সনের বার্ষিক আয় ভেনেজুয়েলার জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

[4] নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতির এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাত : বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং ‘উত্তর-দক্ষিণ’ সংঘাতের উদ্ভব ঘটেছে। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছে। উন্নত দেশগুলির কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ (Labour Cost) সংক্রান্ত বিধান, অভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত নীতিগ্রহণ ইত্যাদি পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

[6] সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংকট : বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক সমতা তৈরির চেষ্টা চলেছে। ইনটারনেট-সহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির নিরন্তর প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ন হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমতা চাপিয়ে দিতে চায়। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতির আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।

[7] জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সংকট : বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তার নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নাগরিকবৃন্দের ওপর চূড়ান্তভাবে প্রযোজ্য হয়। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সর্বব্যাপী ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি ‘বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে’ পরিণত করেছে। এর ফলে সার্বভৌমত্বের ধারণার বদল ঘটেছে।

[8] পরিবেশদূষণ : বিশ্বায়নের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি এই সমস্ত এলাকায় যেসব শিল্প গড়ে তুলছে, সেগুলির কারণে যথেচ্ছভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশের ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের মতো কোনো কঠোর আইন এখানে না থাকায় বহুজাতিক সংস্থাগুলি খুব সহজেই এখানে পরিবেশদূষণকারী শিল্প গড়ে তুলতে পারছে । তাছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্যনীতির সুযোগে উন্নত দেশগুলির উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য পদার্থ উন্নয়নশীল দেশে পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে সেখানকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

উপসংহার : একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন এক অবশ্যম্ভাবী আন্তর্জাতিক প্ৰক্ৰিয়া। সাম্প্ৰতিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বকে এক ‘ভুবন গ্রাম’-এ (Global Village) রূপান্তরিত করেছে | এর ফলে রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক আরও নিবিড়ভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের মুক্ত বাণিজ্য নীতি (Free Trade Policy) উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। বিদেশি পুঁজি লগ্নি, বিদেশি বিনিয়োগ, তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ আদানপ্রদান, রফতানি বাণিজ্যের উদারীকরণ ইত্যাদি বিষয়কে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে বিশ্ববাণিজ্যকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ এনে দিয়েছে বিশ্বায়ন। 
                               __________________


6. জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক আলোচনা করো।
❏ জাতীয় স্বার্থ  :  জাতীয় স্বার্থের ধারণাটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। যে কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির প্রথম লক্ষ্যই হলো জাতীয় স্বার্থ পূরণ। এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে যোসেফ ফ্রাঙ্কেল বলেছেন, “জাতীয় স্বার্থ হলো পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সর্বপ্রধান ধারণা।”

❏ জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক : জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে যে কোনো জাতীয় অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত এর অর্থ হলো কোনো জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রকে সর্বাগ্রে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অন্য রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে রক্ষা করাই হবে প্রাথমিক কাজ। জাতীয় স্বার্থের ধারণা কেবলমাত্র নিজের স্বার্থের সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত নয়, অন্য জাতীয় স্বার্থের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। এ কারণে অন্য জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করে কোনো জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বার্থ অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থ পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন।

(১) পররাষ্ট্রনীতি : ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, জাতীয় স্বার্থের ধারণা পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয়। পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক নির্ধারক হল জাতীয় স্বার্থ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র নিঃস্বার্থভাবে অপর কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে না। মূলত জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে।

(২) অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণদান : প্রতিটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করে। এছাড়া উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলি উন্নত রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে ঋণ বা আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে থাকে। এর ফলে দেখা যায় যে প্রতিটি রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক প্রয়োজন অনুসারে তার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে।

(৩) জাতীয় শক্তি অর্জন করা : রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক মর্যাদার ক্ষেত্রে জাতীয় শক্তির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এই সব লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে জাতীয় শক্তির প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। এই জাতীয় শক্তি অর্জনের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ জাতীয় স্বার্থেরই অঙ্গ। জাতীয় স্বার্থের ধারণা জাতীয় মূল্যবোধের ধারণার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে । কোনো রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্যকে নির্ধারিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে কিনা তা অন্য রাষ্ট্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি রাষ্ট্র পরস্পরের সঙ্গে কোনো-না কোনোভাবে যুক্ত থাকে। সেই কারণে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে জাতীয় স্বার্থ পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

(৪) কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় লক্ষ্য পূরণ করাও জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে জড়িত : আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে তা জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিমেরু প্রবণতার পরিবর্তে যে তৃতীয় বিশ্বভুক্ত দেশগুলির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হচ্ছে তার মূলেও আছে জাতীয় স্বার্থের সংঘাতের প্রকাশ।

(৫) সীমিতকরণ এবং নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্য : প্রতিটি রাষ্ট্রই আণবিক যুদ্ধের ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে সচেতন। সেই কারণে প্রতিটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে সীমিত রাখার যে নীতি গ্রহণ করেছে তা সম্পূর্ণভাবে জাতীয় স্বার্থেরই প্রতিফলন।

উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের গুরুত্ব বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। মরগেন থাউ যথার্থই মন্তব্য করেছেন— “As long as the world is politically Organized into nations, the national interest is indeed the last word in world politics” অর্থাৎ “যতদিন পর্যন্ত পৃথিবী রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থই বিশ্ব-রাজনীতির শেষ কথা বলবে।”
                               __________________


 animated-new-image-0047   Read More .....

No comments

Hi Welcome ....