❏ ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ ✱ নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও : প্রশ্নের মান-৮ 1. ট্রুম্যান ও মার্শাল পরিকল্পনা সম্পর্কে কী জান? ( Mark : 5+3 ) ...
❏ ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ
✱ নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও : প্রশ্নের মান-৮
1. ট্রুম্যান ও মার্শাল পরিকল্পনা সম্পর্কে কী জান? (Mark : 5+3)
2. ঠান্ডা লড়াই বলতে কী বোঝো? ঠান্ডা লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ভিত্তি ব্যাখ্যা করো। (Mark : 5+3)
3. ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো। (Mark : 5+3)
4. কিউবা সংকটের কারণ ও ফলাফল উল্লেখ করো। (Mark : 5+3)
5. বার্লিন সংকট কীভাবে হয়? এই সংকটের গুরুত্ব কী। (Mark : 5+3)
6. গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উদ্ভব কীভাবে সৃষ্টি হয়? বিশ্বরাজনীতিতে এর প্রভাব কী পড়েছিল? (Mark : 3+5)
7. কোরিয়া সংকট কী? এই সংকটের ফলাফল ও গুরুত্ব লেখো। (Mark : 2+6)
৪. জোটনিরপেক্ষ নীতি কী? এই নীতির প্রবক্তা কে? জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের পশ্চাতে বিভিন্ন কারণগুলি লেখো। (Mark : 2+2+4)
1. ট্রুম্যান ও মার্শাল পরিকল্পনা সম্পর্কে কী জান?
❏ ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমগ্র বিশ্ব বিশেষত ইউরোপীয় দেশগুলি প্রবল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়, যার প্রধান কারণ ছিল যুদ্ধে ব্যাপক অর্থ ও লোকক্ষয়। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এই অবস্থায় পশ্চিম ইউরোপের মিত্রপক্ষীয় দেশগুলির সংকটকে বাড়িয়ে তোলে পূর্ব ইউরোপে রুশ সম্প্রসারণ।
❏ ট্রুম্যান নীতি : মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান 1947 খ্রিস্টাব্দের 12 মার্চ মার্কিন কংগ্রেসে একটি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতার মূল বিষয়বস্তু ছিল যে, বিশ্ব এখন দুটি পরস্পর বিরোধী আদর্শ ও চিন্তাধারায় বিভক্ত—মুক্ত গণতন্ত্র এবং সাম্যবাদ। সুতরাং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছিল যে, বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তে যেসব স্বাধীন জনগণ সশস্ত্র সংখ্যালঘিষ্ঠের অথবা বহিঃশক্তির আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করবে এই ঘোষণা ট্রুম্যান নীতি’ বা ‘ট্রুম্যান ঘোষণা’ নামে পরিচিত। যার প্রধান রূপকার ছিলেন মার্কিন কূটনীতিবিদ জর্জ এফ. কেন্নান। তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে ট্রুম্যান প্রকৃতপক্ষে মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশগুলির স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষা এবং সাম্যবাদী শক্তির দ্বারা আক্রান্ত দেশগুলিকে সাহায্যদানের কথা ঘোষণা করেন।
❏ ট্রুম্যান নীতির তাৎপর্য : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য লাভের পিছনে ট্রুম্যান নীতির ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্যবাদের প্রসার প্রতিরোধ করা ছাড়াও মার্কিন বাণিজ্যকে সচল রাখাও ছিল এই নীতির অপর একটি উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হওয়ার ফলে যে সকল বণিক গোষ্ঠী তাদের অস্ত্র কারখানাগুলিকে নিয়ে চিন্তিত ছিল, সম্ভবত তাদের চাপেই ট্রুম্যান এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ, এই নীতির পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল সাহায্য বা ঋণদানের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে অস্ত্র বিক্রয় করা। ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার ফলে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলি দেখা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৈদেশিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে উদাসীনতা প্রদর্শন করেছিল এই নীতি ঘোষণায় সেই গতানুগতিকতার অবসান ঘটে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক আইজ্যাক ডয়েসচারের মতে, ট্রুম্যান নীতির ফলেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল। এর পরই আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট গড়ে ওঠে। আমেরিকা সোভিয়েত প্রভাবকে ইউরোপে সীমাবদ্ধ রাখার জন্যই বেষ্টনী নীতি গ্রহণ করেছিল। ট্রুম্যান ঘোষণা ছিল মার্কিন ‘বেষ্টনী নীতির’-ই বহিঃপ্রকাশ। গ্রিস ও তুরস্কে কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ করার জন্য আমেরিকা ট্রুম্যানের ঘোষণা অনুসারে 40 কোটি ডলার অর্থসাহায্য প্রেরণ করে। ট্রুম্যান ঘোষণা আন্তর্জাতিক সংকটকেও বৃদ্ধি করেছিল। যার ফলে সমগ্র ইউরোপে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়।
❏ মার্শাল পরিকল্পনা : 1947 খ্রিস্টাব্দে মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে ট্রুম্যান নীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটে। ইউরোপীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক সংকট অধিক হারে বৃদ্ধি পেলে তা সাম্যবাদ প্রসারলাভের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে—এই আশঙ্কায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য মার্শাল পরিকল্পনা রচনা করেছিল। মার্শাল পরিকল্পনার প্রধান রূপকার ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জর্জ সি. মার্শাল।
❏ মার্শালের ঘোষণা : 1947 খ্রিস্টাব্দের 5 জুন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জর্জ সি. মার্শাল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা প্রদান করেন। এই বক্তৃতায় তিনি জানিয়েছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে ইউরোপীয় দেশগুলির পক্ষে উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা দুষ্কর হয়ে উঠলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ তথা বিশ্বের যে-কোনো অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে সাহায্যদানে এগিয়ে আসবে এটি ‘মার্শাল ঘোষণা’ নামে পরিচিত। এই ঘোষণায় বলা হয়—সাহায্যের দ্বারা প্রাপ্ত অর্থ দেশগুলিকে এমনভাবে ব্যয় করতে হবে যাতে তা অর্থনৈতিক পুনর্গঠনেইম কাজে লাগে।আর্থিক সাহায্য প্রাপ্ত দেশটিকে নিজ উদ্যোগে অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর হয়ে উঠতে হবে। এই পরিকল্পনাটি ছিল দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে গৃহীত উদ্যোগস্বরূপ। যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলি বিশেষত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইটালি এই পরিকল্পনাকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এই পরিকল্পনার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ মার্শাল পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করেন। কারণ তাঁর মতে, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থগ্রহীতা রাষ্ট্রগুলির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হরণ এবং ডলার সাম্রাজ্যবাদ প্রসারের প্রচেষ্টা করছে। বস্তুত মার্শাল পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্যও ছিল আর্থিক সাহায্য দানের দ্বারা সর্বাধিক সংখ্যক দেশকে মার্কিন ছত্রছায়ায় আনা, যাতে ইউরোপে সাম্যবাদের প্রভাব হ্রাস পায়। বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে অর্থসাহায্যের মাধ্যমে একটি অনুগত রাষ্ট্রজোট গঠন করাও মার্শাল পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
❏ মার্শাল পরিকল্পনার রূপায়ণ : মার্শাল পরিকল্পনা অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 1947–48 খ্রিস্টাব্দে এক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া শুরু করে। এই পরিকল্পনা অনুসারে স্থির হয় যে, 4 বছরের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 18টি ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে সকল প্রকার আর্থিক সাহায্য প্রদান করবে। 1948–51 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আর্থিক পুনরুজ্জীবনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় 1200 কোটি ডলার ব্যয় করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অগ্রগতি রোধ করাই ছিল এই পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য। 1952 খ্রিস্টাব্দে এই পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটে।
❏ মার্শাল পরিকল্পনার ফলাফল : মার্শাল পরিকল্পনা ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দাকে রোধ করতে সমর্থ হয়েছিল। মার্কিন সাহায্য গ্রহণের ফলে সেখানকার দেশগুলির উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি পায় এবং মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পায়। মার্শাল পরিকল্পনা পশ্চিম ইউরোপকে আর্থিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। ফলে এই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলিতে গণতান্ত্রিক দলগুলি সমাজতন্ত্রী দলকে হারিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে এই পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আর্থিক পুনর্গঠনের চেষ্টা করে। ফলে পশ্চিম ইউরোপে মার্কিন এবং পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ঠান্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।
___________
2. ঠান্ডা লড়াই বলতে কী বোঝো? ঠান্ডা লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ভিত্তি ব্যাখ্যা করো।
❏ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পুঁজিবাদী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও সাম্যবাদী সোভিয়েত রাশিয়া যে আদর্শগত সংঘাতে লিপ্ত হয় তা ‘ঠান্ডা লড়াই’ নামে পরিচিত। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লবকে দমন করার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগোষ্ঠী (আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান) জারতন্ত্রের সমর্থনে রাশিয়ায় সেনা পাঠায়। সমাজতন্ত্রকে সূচনাকালেই শেষ করে দেওয়া ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কাজেই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্বে ‘দ্বিমেরুকরণ রাজনীতি’র জন্ম হয়।
❏ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পর্যায় : দ্বিতীয় রণাঙ্গনের যুদ্ধ চলাকালে জার্মানির প্রবল আক্রমণে দিশাহারা সোভিয়েত রাশিয়া পশ্চিমি জোটের কাছে জার্মানির বিরুদ্ধে পশ্চিম ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার অনুরোধ রাখে। কিন্তু এই অনুরোধকে নিয়ে চার্চিলের দুমুখো নীতি স্টালিনকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নিয়ে সোভিয়েত ও মার্কিন মতবিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে এবং পটস্ডাম সম্মেলন থেকেই ঠান্ডা লড়াই প্রকাশ্যে আসে।
❏ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায় : চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা: ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার মিসৌরি প্রদেশের অন্তর্গত ফালটনে ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে এক ভাষণে (১৯৪৬ খ্রি., ৫ মার্চ) বলেন, উত্তর বালটিক সাগরের তীরবর্তী স্টেটিন থেকে দক্ষিণ অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের ট্রিয়েস্ট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল লৌহ যবনিকার (সোভিয়েত) আড়ালে ঢাকা। ফালটন বক্তৃতায় চার্চিল রুশ আগ্রাসন থেকে ইউরোপীয় সভ্যতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেন।
❏ ঠান্ডা লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ধারণাসমূহ :
(i) চিরায়ত বা ঐতিহ্যবাহী ধারণা : ঐতিহ্যবাহী ধারণার সমর্থকগণ হলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ এফ. কেন্নান, হার্বার্ট ফিস, ম্যাক্সিম লিটভিনভ, জন স্পেনিয়ার, উইলিয়াম এইচ. ম্যাকলিন, মার্টিন ম্যাককাউলে, জে. আর. ম্যাককারথি, জন ডব্লিউ. ম্যাসন প্রমুখ। ঐতিহ্যবাহী ধারণার মূল বক্তব্য হল ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা সোভিয়েত ইউনিয়নই বেশি দায়ী। এই ধারণা অনুযায়ী মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের শ্রেণিসংগ্রাম থেকেই ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা ঘটেছে। এই মতামত অনুসারে রাশিয়া তার কমিউনিস্ট জগতের পরিধি বাড়াতে চেয়েছিল, আর তা করতে গিয়ে রাশিয়া অকমিউনিস্ট দেশগুলির প্রতি মিত্রতামূলক সম্পর্ক নষ্ট করে। রাশিয়ার এই অগ্রগতি প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সচেষ্ট হলে বিশ্বে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা ঘটে।
(ii) সংশোধনবাদী ধারণা : ঠান্ডা যুদ্ধে সংশোধনবাদী তাত্ত্বিক ধারণার পথপ্রদর্শক ছিলেন ওয়াল্টার লিপম্যান। এই ধারণার অন্যান্য কয়েকজন সমর্থক ছিলেন ডি. এফ. ফ্লেমিং, গ্যাব্রিয়েল কলকো, গার অ্যালপারোভিজ, হেনরি এ. ওয়ালেস, ওলিভার এডওয়ার্ডস, উইলিয়াম অ্যাপেলম্যান উইলিয়ামস, ওয়াল্টার লেফেভর, নরম্যান গ্রেবনের ডেভিড হরোউইজ, লয়েড গার্ডনার প্রমুখ। সংশোধনবাদী তাত্ত্বিক ধারণার সমর্থকগণের মূল বক্তব্য হল সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণশীল নীতি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছিল। এই ধারণা অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করতে না পেরে নিজস্ব প্রভাবাধীন অঞ্চলের সম্প্রসারণ ঘটাতে শুরু করে ও ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনাকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
(iii) বাস্তববাদী ধারণা : ঐতিহ্যবাহী এবং সংশোধনবাদী উভয় ধারণার মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করে একদল গবেষক, ঐতিহাসিক ঠান্ডা যুদ্ধের যে তত্ত্ব পেশ করেছেন তা ‘বাস্তববাদী তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। এই তত্ত্বের কয়েকজন সমর্থক হলেন হ্যানস্ জে. মরগ্যানথাউ, লুই জে. হ্যালে, রিচার্ড ক্রকেট, জন লুইস গ্যাডিস প্রমুখ। বাস্তববাদী ধারণার সমর্থকেরা ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো-একটি পক্ষকে চূড়ান্তভাবে দায়ী করায় বিশ্বাসী নন। এঁদের ধারণায় ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনার জন্য সোভিয়েত বা মার্কিন উভয়পক্ষই দায়ী ছিল অথবা কোনো পক্ষই দায়ী ছিল না।
(iv) অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাখ্যা : কেউ কেউ মনে করেন যে, ঠান্ডা লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অন্যতম দিক। গ্যাব্রিয়েল কলকো, কর্ডেল প্রমুখ এই অভিমতের সমর্থক। গ্যাব্রিয়েল কলকো দেখিয়েছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা বিশ্বের শ্ৰেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয় । আমেরিকা তার এই আর্থিক শক্তিকে ব্যবহার করে বিশ্ব-অর্থনীতির প্রধান চালকের আসন লাভের চেষ্টা করেছিল। এই লক্ষ্যে আমেরিকা তার বিদেশনীতিতে পরিবর্তন ঘটায়। মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্য দিয়ে আমেরিকা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপে নিজেকে পরিত্রাতা হিসেবে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বৈদেশিক ক্ষেত্রে আমেরিকার অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের প্রধান বাধা ছিল সোভিয়েত রাশিয়া।
উপসংহার : রাশিয়া ও তার অনুগত রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে আমেরিকা একপ্রকার ক্রুসেড ঘোষণা করে। এর ফলেই ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে।
___________
3. ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।
❏ ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই সমগ্র বিশ্বরাজনীতিতে নিজ নিজ প্রভাব বিস্তারের জন্য দুই মহাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উদ্যোগী হয়। তাদের মধ্যেকার আদর্শগত সংঘাতযে উত্তেজক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তা Cold War বা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে ঠান্ডা লড়াই একটি বিতর্কিত বিষয়। এই লড়াইয়ের উদ্ভবের পিছনে একাধিক কারণ ও ফলাফল ছিল, যথা—
❏ ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণ ও ফলাফল :
(১) দ্বিতীয় রণাঙ্গনের প্রশ্ন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা এবং জাপানের ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মতভেদ শুরু হয়। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান সমস্যাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতভেদ ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করে। সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক স্ট্যালিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় জার্মানিকে ব্যস্ত রাখতে উদ্যোগী হন। সেই কারণে তিনি পশ্চিম ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে অনুরোধ জানান। কিন্তু এই অনুরোধ রক্ষার ক্ষেত্রে চার্চিল যে দ্বিচারিতার নীতি গ্রহণ করেন তা স্ট্যালিনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
(২) মার্কিন সমর দফতর পেন্টাগনের প্রভান : মার্কিন সামরিক দফতর পেন্টাগনের সদস্যগণ ছিলেন সাম্যবাদ বিরোধী। সুতরাং, তাঁরা জন মার্শাল মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানকে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি কঠোর নীতি গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেন। একই সময় ইয়াল্টা সম্মেলনে পোলিশ সীমান্ত নিয়ে এবং পটডাম সম্মেলনে জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ প্রসঙ্গে সোভিয়েত ও মার্কিন মতবিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে।
(৩) পারস্পরিক সন্দেহ : কেউ কেউ মনে করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স গঠনের মধ্যেই ঠান্ডা লড়াইয়ের বীজ নিহিত ছিল। পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলিতভাবে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে কোনো সাধারণ শত্রুর অবর্তমানে তাদের পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস আবার তীব্রতর হয়।
(৩) ফুলটন বক্তৃতা : কেউ কেউ মনে করেন যে 1946 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে ফুলটন ওয়েস্ট মিনিস্টার কলেজে যে বক্তৃতা দেন তা থেকেই ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে। এই বক্তৃতায় তিনি আমেরিকাকে সতর্ক করে বলেন যে, উত্তরে বাল্টিকের স্টেটিন থেকে আড্রিয়াটিকের ট্রিয়েস্ট পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকা সোভিয়েত লৌহ যবনিকার অন্তরালে চলে গেছে। এখনও যদি সতর্ক না হওয়া যায় তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ণ ইউরোপকে গ্রাস করবে।
(৪) ট্রুম্যান নীতি : গ্রিস, তুরস্ক ও ইরাননে রুশ অনুপ্রবেশের আশঙ্কা প্রকাশ করে ওই দেশগুলিকে সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি গ্রিস ও তুরস্কসহ বিশ্বের যে-কোনো দেশে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এই ঘোষণা ট্রুম্যান নীতি নামে পরিচিত।
(৫) মার্শাল পরিকল্পনা : টুম্যান নীতি কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কিছুদিনের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সাহায্য সংক্রান্ত একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে। 1947 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন মার্শাল ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য যে পরিকল্পনা প্রকাশ করেন সেটি মার্শাল পরিকল্পনা নামে খ্যাত। তবে এই পরিকল্পনায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে অর্থনৈতিক সাহায্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।
(৬) জার্মান সমস্যা : জার্মানিকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই ক্রমশ ব্যাপক আকার ধারণ করে। সমগ্র জার্মানির সংযুক্তি না ঘটিয়ে তাকে দুটি ভাগে বিভক্ত করায় পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। জার্মানির দু-ধরনের আর্থরাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠান্ডা লড়াইয়ে ইন্ধন জোগাতে থাকে।
(৭) সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া : মার্শাল পরিকল্পনায় ক্ষুব্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন 1947 খ্রিস্টাব্দে তার মিত্র দেশগুলিকে নিয়ে গড়ে তোলে কমিনফর্ম। এরপর তারা বার্লিন অবরোধ করলেও মিত্রশক্তির তৎপরতায় তা তুলে নিতে বাধ্য হয়। তবে এই ঘটনা উভয়পক্ষের মধ্যে বিদ্বেষের সূচনা ঘটায়।
(৮) বিভিন্ন জোট : আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়পক্ষই এরপর থেকে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হয়। 1949 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র NATO গঠন করে। পক্ষান্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন 1949 খ্রিস্টাব্দে গঠন করে কমেকন। এ ছাড়া আমেরিকার নেতৃত্বে 1954 খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে নিয়ে গড়ে ওঠে SEATO।
❏ উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, কেবলমাত্র ইউরোপই নয়, ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাবে সমগ্র বিশ্ব দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তিজোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় বার্লিন সংকট, কোরিয়া যুদ্ধ ও কিউবা সংকটের মধ্যে দিয়ে। বাস্তববাদী ঐতিহাসিকদের মতে ঠান্ডা লড়াই ছিল মূলত ক্ষমতার রাজনীতি।
___________
4. কিউবা সংকটের কারণ ও ফলাফল উল্লেখ করো।
❏ ভূমিকা : পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড়ো দ্বীপ হল ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত কিউবা। 1962 খ্রিস্টাব্দে কিউবা দ্বীপে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে যুদ্ধজনিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তা কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকট নামে পরিচিত ছিল।
❏ কিউবা সংকটের কারণ :
(১) প্ল্যাট চুক্তি : 1903 খ্রিস্টাব্দে প্ল্যাট চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন সরকার কিউবার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই হস্তক্ষেপ করতে থাকে। 1934 খ্রিস্টাব্দে ওই চুক্তি বাতিল হলে কিউবা দ্বীপটি অর্থনৈতিকভাবে একটি মার্কিন উপনিবেশে পরিণত হয়। এর ফলে কিউবার জনগণ প্রবল দুর্দশার মধ্যে পড়ে।
(২) কাস্ত্রোর ক্ষমতা লাভ : আমেরিকার সমর্থনে কিউবার ক্ষমতা দখল করেছিলেন ফ্যালজেনিকো বাতিস্তা। তবে এই সরকারের পিছনে কোনো জনসমর্থন ছিল না। বাতিস্তা সরকারের স্বৈরাচারী শাসনে কিউবার জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে কিউবার ছাত্রনেতা ফিদেল কাস্ত্রো সেদেশের জনগণকে সংগঠিত করে এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটান। কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবায় নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৩) কাস্ত্রোর কার্যকলাপ : জনগণের উন্নতির জন্য কাস্ত্রো কিউবায় বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমুখী কার্যাবলি গ্রহণ করেন। তাঁর সংস্কারগুলি ছিল মূলত সমাজতান্ত্রিক নীতির অনুসারী। তাই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিন ও অন্যান্য সমাজতন্ত্রী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে কিউবার সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে নজর দেন। এ ছাড়া তিনি বড়ো বড়ো খামার, চিনিকল ও অন্যান্য শিল্পকে জাতীয়করণ করেন। এমনকি কিউবার ব্যাংকগুলিরও জাতীয়করণ করা হয়। তবে কাস্ত্রোর এই সমস্ত কার্যকলাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষিপ্ত হয়ে কিউবার সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
(৪) পিগ উপসাগরের যুদ্ধ : বিভিন্ন কারণে কিউবার ওপর ক্ষুব্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে দেশ থেকে কাস্ত্রো সরকারকে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করতে থাকে। এই উদ্দেশ্যে 1961 খ্রিস্টাব্দে মার্কিন মদতপুষ্ট প্রায় 1400 সৈন্য পিগ উপসাগরে অবতরণ করে। এ ছাড়া মার্কিন বি-26 বোমারু বিমান কাস্ত্রো বিরোধী কিউবার বিদ্রোহী নাগরিকদের সাহায্যের জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এই মার্কিন আক্রমণ কিউবার সেনাবাহিনী সফলভাবে দমন করে। সোভিয়েত ঘাঁটি স্থাপন : পিগ উপসাগর যুদ্ধের ঘটনায় কিউবা মার্কিন চক্রান্ত সম্বন্ধে আশঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় কিউবা সোভিয়েত সাহায্য প্রার্থনা করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র মজুত করার জন্য ঘাঁটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। 1962 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় 48টি মাঝারি ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও 2৪টি জেট আণবিক বোমারু বিমান সরবরাহ করে। বিদেশের মাটিতে এটিই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি।
(৫) মার্কিন প্রতিক্রিয়া : 1962 খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আমেরিকা তার গুপ্তচর বিমানের সাহায্যে তোলা চিত্রের মাধ্যমে কিউবায় সোভিয়েত ঘাঁটি সম্পর্কে জানতে পারে। সেভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা আমেরিকা তাদের মূল ভূখণ্ড আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডি এই সংবাদে বিচলিত হয়ে ওই ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি অপসারণে সচেষ্ট হন।
(৬) কিউবা অবরোধ : রাষ্ট্রপতি কেনেডি কিউবায় নৌ-অবরোধের নির্দেশ দেন। 1962 খ্রিস্টাব্দের 22 অক্টোবর এক বেতার ঘোষণার মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে সেই অবরোধ সম্পর্কে জানান। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সোভিয়েত সরকারও যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এই অবস্থায় শেষপর্যন্ত জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় কিউবা অবরোধের সমাপ্তি ঘটে।
❏ কিউবা সংকটের গুরুত্ব : কিউবা সংকট ক্ষণস্থায়ী হলেও তা গুরুত্বহীন ছিল না। কারণ—
(১) মানবতানাদের জয় : কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে আণবিক যুদ্ধ শুরু হতে পারে—এমন একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তবে সঠিক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন আসন্ন এই যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝতে পারে। এই দুই দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধের উদ্যোগ হ্রাস পেলে জয় হয় মানবতাবাদের।
(২) মার্কিন-সোভিয়েত সৌহার্দ্য : কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সমস্যা উপলব্ধি করার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায় যা ভবিষ্যতে ইতিবাচক পথের দিশা নির্দেশ করে।
(৩) পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিবারক চুক্তি : কিউবা সংকটের গুরুত্ব বিচার করে এই সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। 1963 খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিবারক চুক্তি নামে পরিচিত।
(৪) টেলি যোগাযোগ স্থাপন : কিউবা সংকটের অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে আমেরিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সংকটকালীন সমস্যাসমাধানে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময় দু-দেশের মধ্যে ক সমস্যা দেখা দিলে হটলাইনের মাধ্যমে টেলি যোগাযোগ দ্বারা তা সমাধান করার বিষয়ে তারা একমত হয়।
❏ উপসংহার : কিউবা সংকটের দায়িত্ব প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রকার মতবিরোধ দেখা দিলেও শেষপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয় দেশের বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত সমগ্র বিশ্বকে এক বৃহৎ আণবিক যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পায়।
___________
5. বার্লিন সংকট কীভাবে হয়? এই সংকটের গুরুত্ব কী।
❏ ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পরাজিত জার্মানিকে কেন্দ্র করে বিশ্বরাজনীতি উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ঠান্ডা লড়াই প্রবল রূপ ধারণ করে। অধ্যাপক ডেভিড টমসন (David Thomson) বলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির সঙ্গে শান্তি স্থাপনই হয়ে ওঠে সবচেয়ে কণ্টকিত বিষয় (“The problem of making peace with Germany, thorniest of all..." – Europe Since Napoleon, David Thomson, 1958, P.797) বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও জার্মানির বেসামরিকীকরণের প্রশ্নে ইয়াল্টা সম্মেলনে (১৯৪৫ খ্রি.) স্ট্যালিনের সঙ্গে ইঙ্গ-মার্কিন মহলের তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়।
এরপর পটসডাম সম্মেলনের (১৯৪৫ খ্রি.) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মানিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া—এই চারটি দেশের অধিকৃত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয় এবং বলা হয় যে, প্রত্যেক রাষ্ট্র নিজ অধিকৃত এলাকা থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করবে। এই চুক্তির সুযোগ গ্রহণ করে সোভিয়েত রাশিয়া নিজ অধিকৃত এলাকা থেকে খাদ্যশস্য, শিল্প, শিল্পকর্মী—সব বিমানে বোঝাই করে নিজ দেশে পাঠাতে থাকে। কেটেলবি (Ketelbey)-র মতে পূর্ব ও পশ্চিম দুই শক্তিই জার্মানির পুনরুত্থানের বিরোধী ছিল এবং সেজন্যই জার্মানির অমীমাংসিত সমস্যা আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় (“Germany remained an unsettled problem of great international concern."—A History of Modern Times from 1789-2002, P. 503)।
❏ বার্লিন সংকটের গুরুত্ব : আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে এই ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। (১) এই ঘটনা ঠান্ডা লড়াইকে তীব্রতর করে তোলে। বার্লিন অবরোধের পরিণতি সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে শুভ হয়নি। পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ নতি স্বীকার করেনি। এই ঘটনার পর তাদের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পায়। (২) সোভিয়েত আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলি নিজেদের নিরাপত্তাকে আরও জোরদার করে তুলতে অগ্রসর হয়। (৩) বার্লিন অবরোধের পর পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ তাদের অধিকৃত অঞ্চলে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করে। এইভাবে ১৯৪৯-এর ২১শে মে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি’ (Federal Republic of Germany = F.R.G)। পশ্চিম জার্মানির প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন ‘খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক দল’এর কনরাড আদানুর। সোভিয়েত রাশিয়া আবার এর প্রতিবাদে পূর্ব জার্মানিতে রুশ-নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রতিষ্ঠা করে ‘জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (German Democratic Republic G.D.R)। এই সরকারের কর্ণধার হলেন অটো গ্রোটোহল। এইভাবে জার্মানিতে দুটি ভিন্নধর্মী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পূর্ব জার্মানিকে কেন্দ্র করে পূর্ব ইউরোপে রুশীকরণের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। (৪) এতদিন পর্যন্ত বহু মার্কিন সাংসদ টুম্যানের ‘রুশ-ভীতি’কে গুরুত্ব দিতেন না, কিন্তু বার্লিন অবরোধের পর তাঁরা পশ্চিম ইউরোপে ট্রুম্যানের ভূমিকার প্রতি সমর্থন জানান। বার্লিন অবরোধের ফলেই রিপাবলিকান নেতা আর্থার ভ্যান্ডেনবার্গ (Arthur Vandenberg) মার্কিন সেনেটে একটি প্রস্তাব আনেন এবং তা গৃহীতও হয় । প্রস্তাবে বলা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার বাইরে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে যৌথ সামরিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে। এরই ফলশ্রুতি হল ১৯৪৯-এর এপ্রিলে ‘ন্যাটো’ বা উত্তর আটলান্টিক চুক্তিসংস্থা গঠন। প্রথমে মোট ১২টি ইউরোপীয় দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর প্রতিবাদে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই মে সোভিয়েত রাশিয়া তার অনুগত পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিকে নিয়ে গড়ে তোলে ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা। (৫) পরবর্তীকালে বার্লিন সমস্যা ও জার্মানির ঐক্য সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তিক্ততা এমন স্তরে পৌঁছোয় যে, ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই আগস্ট পূর্ব জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে কংক্রিট ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে প্রাচীর গড়ে তোলে। এর ফলে কৃত্রিম ব্যবধান গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ২৮ বছর পর ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ই নভেম্বর এই বেড়া ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৯০-এর ৩রা অক্টোবর দুই জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়।
___________
❏ বার্লিন সংকটের গুরুত্ব : আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে এই ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। (১) এই ঘটনা ঠান্ডা লড়াইকে তীব্রতর করে তোলে। বার্লিন অবরোধের পরিণতি সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষে শুভ হয়নি। পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ নতি স্বীকার করেনি। এই ঘটনার পর তাদের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পায়। (২) সোভিয়েত আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলি নিজেদের নিরাপত্তাকে আরও জোরদার করে তুলতে অগ্রসর হয়। (৩) বার্লিন অবরোধের পর পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ তাদের অধিকৃত অঞ্চলে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করে। এইভাবে ১৯৪৯-এর ২১শে মে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি’ (Federal Republic of Germany = F.R.G)। পশ্চিম জার্মানির প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন ‘খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক দল’এর কনরাড আদানুর। সোভিয়েত রাশিয়া আবার এর প্রতিবাদে পূর্ব জার্মানিতে রুশ-নিয়ন্ত্রণাধীনে প্রতিষ্ঠা করে ‘জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (German Democratic Republic G.D.R)। এই সরকারের কর্ণধার হলেন অটো গ্রোটোহল। এইভাবে জার্মানিতে দুটি ভিন্নধর্মী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পূর্ব জার্মানিকে কেন্দ্র করে পূর্ব ইউরোপে রুশীকরণের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। (৪) এতদিন পর্যন্ত বহু মার্কিন সাংসদ টুম্যানের ‘রুশ-ভীতি’কে গুরুত্ব দিতেন না, কিন্তু বার্লিন অবরোধের পর তাঁরা পশ্চিম ইউরোপে ট্রুম্যানের ভূমিকার প্রতি সমর্থন জানান। বার্লিন অবরোধের ফলেই রিপাবলিকান নেতা আর্থার ভ্যান্ডেনবার্গ (Arthur Vandenberg) মার্কিন সেনেটে একটি প্রস্তাব আনেন এবং তা গৃহীতও হয় । প্রস্তাবে বলা হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার বাইরে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে যৌথ সামরিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে। এরই ফলশ্রুতি হল ১৯৪৯-এর এপ্রিলে ‘ন্যাটো’ বা উত্তর আটলান্টিক চুক্তিসংস্থা গঠন। প্রথমে মোট ১২টি ইউরোপীয় দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর প্রতিবাদে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই মে সোভিয়েত রাশিয়া তার অনুগত পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিকে নিয়ে গড়ে তোলে ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা। (৫) পরবর্তীকালে বার্লিন সমস্যা ও জার্মানির ঐক্য সমস্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তিক্ততা এমন স্তরে পৌঁছোয় যে, ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই আগস্ট পূর্ব জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে কংক্রিট ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে প্রাচীর গড়ে তোলে। এর ফলে কৃত্রিম ব্যবধান গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ২৮ বছর পর ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ই নভেম্বর এই বেড়া ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৯০-এর ৩রা অক্টোবর দুই জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়।
___________
6. গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উদ্ভব কীভাবে সৃষ্টি হয়? বিশ্বরাজনীতিতে এর প্রভাব কী পড়েছিল?
❏ ভূমিকা : 1949 সালের 1 অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চিন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মাও-জে-দং-কৃত ‘নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিষ্ঠা হয়। চিনের বিপ্লব পরিচালিত হয়েছিল চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিল শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং জাতীয় ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি চিনের বিপ্লবে সকলের উপস্থিতির কারণে একে অনেকে গণ-বিপ্লব (People's Revolution) বলে অভিহিত করেছেন।
❏ গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উদ্ভব : গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে ৪ মে (১৯১৯ খ্রি.) আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল তার ফলেই ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
(১) কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা: পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর প্রচেষ্টায় চিনে (১৯২১ খ্রি., ১ জুলাই) সাংহাই প্রদেশের ফরাসি অধিকৃত একটি গার্লস স্কুলে গোপনে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল। পিকিং, চাঙসা, ক্যান্টন প্রভৃতি জায়গায় এই কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গড়ে ওঠে। এই চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন চেন-তু- শিউ। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাও-সে-তুঙ, লিও- শাও-চি, চৌ-এন-লাই, চু-তে প্রমুখ।
(২) লং মার্চ: রাষ্ট্রপতি চিয়াংকাই-শেক ছিলেন প্রচণ্ড কমিউনিস্ট বিদ্বেষী। চিনা কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য তিনি তাদের প্রধান ঘাঁটি কিয়াং-সি অভিমুখে সেনাবাহিনী পাঠান ১৯৩৪ খ্রি. নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই প্রায় এক লক্ষ চিনা কমিউনিস্ট তাদের পরিবার পরিজন-সহকিয়াং-সি ত্যাগ করে উত্তর চিনে পীত নদীর বাঁকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ শেনসি প্রদেশ অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ এই পদযাত্রায় কমিউনিস্টরা ৬০০০ মাইল পথ অতিক্রম করেছিল। তারা এসময় সাধারণ মানুষের আন্তরিক সহানুভূতি ও সাহায্য লাভ করে।
(৩) সিয়াং-ফু ঘটনা : মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা উত্তর চিনের শেনসি প্রদেশে একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার রাজধানী ছিল সিয়াং-ফু। কমিউনিস্টদের দমনের জন্য প্রজাতন্ত্রী চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই-শেক সেখানে একদল সেনা পাঠান (১৯৩৫ খ্রি.)। ওইসব চিনা সৈন্য কমিউনিস্টদের দমনের পরিবর্তে সমর্থন করতে শুরু করে। এই সংবাদে বিচলিত চিয়াং নিজে সিয়াং-ফুতে উপস্থিত হন। তখন তাঁরই এক সেনাপতি চ্যাং-শিউ-সিয়াং হঠাৎ চিয়াংকে বন্দি করে (১২ ডিসেম্বর,১৯৩৬ খ্রি.) এক অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখে। প্রায় দু-সপ্তাহ বন্দি থাকার পর সোভিয়েত হস্তক্ষেপে এবং চৌ-এন-লাই-এর মধ্যস্থতায় চিয়াং ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান।
(৪) কমিউনিস্ট শক্তিবৃদ্ধি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত জাপান ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আত্মসমর্পণ করে। এরপর কুয়োমিনতাং ও চিনা কমিউনিস্টদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবার চরমে ওঠে। কিন্তু নানা কারণে কুয়োমিনতাং দলের সামরিক শক্তি তখন ক্রমহ্রাসমান। পক্ষান্তরে কমিউনিস্টরা ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে চিনের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন লাভ করে।
(৫) কমিউনিস্ট দ্বারা প্রজাতন্ত্র গঠন : ক্রমবর্ধমান ও সামরিক শক্তির সহায়তায় মাও-এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা একের পর এক চিনের বিভিন্ন ভূখণ্ড দখল করতে থাকে। শেষপর্যন্ত চিয়াং সরকারকে যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে কমিউনিস্টরা পিকিং দখল করে। মূল ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদ হয়ে চিয়াং-কাই-শেক ফরমোজা (তাইওয়ান) দ্বীপে আশ্রয় নেন। সেখানে কুয়োমিনতাংরা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে। আর চিনের মূল ভূখণ্ডে মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জনগণের প্রজাতন্ত্র’ যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চিন' নামে খ্যাত। মাও-সে-তুঙ হন এর প্রথম সভাপতি বা চেয়ারম্যান এবং প্রধানমন্ত্রী হন চৌ-এন-লাই।
❏ বিশ্বরাজনীতিতে চিনের প্রভাব :
(১) সাম্যবাদী শিবিরের শক্তিবৃদ্ধি : বিশ্বের দ্বিমেরুকরণ রাজনীতিতে চিনের উত্থান সাম্যবাদী শিবিরে প্রথম শক্তিবৃদ্ধি ঘটায়। চিন ও বিশ্বের অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়ার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবির গঠন করে।
(২) সাম্যবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ : রাশিয়ার সঙ্গে চিনের মৈত্রী বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলে। রাশিয়া ওই আন্দোলনকে জোরদার করতে নানাভাবে চিনের শিল্পায়ন, সমরসজ্জা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাহায্য করতে থাকে। শুধু তাই নয়, ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাশিয়া চিনকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সহযোগী নেতৃত্বের আসনেও বসায়।
(৩) রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক : চিনে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাশিয়ার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। চিনের লাল বিপ্লব সাম্যবাদী বিশ্ব গড়ে তোলার পথে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সোপান। কমিউনিস্ট রাষ্ট্ররূপে চিনের আত্মপ্রকাশের পর রাশিয়াই প্রথম তাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। বন্ধুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ উভয় দেশের মধ্যে প্রায় ৩০ বছরের জন্য মৈত্রী চুক্তি (১৯৫০-১৯৭৯ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়। এর সুফলরূপে রাশিয়ার কাছ থেকে চিন সহজ শর্তে ৩০ কোটি ডলার ঋণ পায়। এ ছাড়াও রাশিয়া পোর্ট আর্থার বন্দর ও মাঞ্চুরিয়ার রেলপথের অধিকার চিনের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে চিন-সোভিয়েত বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে চিন-সোভিয়েত মৈত্রী ছিন্ন হয়ে যায়। সে সময়কার সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভের নির্দেশে চিন থেকে রাশিয়ার সব প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক পরামর্শদাতাদের ফিরিয়ে আনা হয়। আসলে এই দ্বন্দ্বের মূলে ছিল ক্রুশ্চেভের স্টালিন-বিরোধী নীতি, যা চিন মেনে নিতে পারেনি এবং মাও-সে-তুঙের স্বাধীন মনোভাব। পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট চিন ন্যাটোকে সমর্থন করলে বেজিং ও মস্কোর দ্বন্দ্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়।
(৪) আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক : চিনের সঙ্গে প্রথমদিকে আমেরিকার সম্পর্ক ছিল বৈরিতার। চিনে সাম্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার পর মার্কিন-চিন সংঘাত শুরু হয়। চিনের কমিউনিস্ট বিরোধী চিয়াংকাই-শেককে সমর্থন করা, রাষ্ট্রসংঘে সাম্যবাদী চিনের বিরোধিতা করা বা কোরিয়া যুদ্ধের সময় চিনের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ ও পরমাণু বোমা নিক্ষেপের হুমকি দেওয়া ইত্যাদির ফলে মার্কিন-চিন সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কমিউনিস্ট চিনও মার্কিন বিদেশনীতির বিরোধিতা করা শুরু করে। কাগজে বাঘ বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমালোচনা করে।
(৫) গুরুত্বপূর্ণ এশীয় শক্তি : এতদিন কমিউনিস্ট ভাবধারা ও তার আধিপত্য রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল। এবার কমিউনিস্ট চিনের উত্থানের পর তা এশীয় ভূখণ্ডেও ছড়িয়ে পড়ল। অচিরেই চিন এশিয়ার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
উপসংহার : চিনের গণবিপ্লবের সাফল্য শুধুমাত্র চিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তা সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই বিপ্লবের সাফল্য এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নিষ্পেষিত মানুষের মধ্যে এক মুক্তির বাতাস নিয়ে আসে। এই শক্তি তাদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হতে অনুপ্রেরণা জোগায় এবং বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসে।
___________
7. কোরিয়া সংকট কী? এই সংকটের ফলাফল ও গুরুত্ব লেখো।
❏ কোরিয়া সংকট : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে বেশকিছু সংকট পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়ার ওপর জাপানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত কোরিয়া জাপানের অধীনেই ছিল। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে কায়রো সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন ও ব্রিটেন কোরিয়াকে জাপানের কবলমুক্ত করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কথা চিন্তা করে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত পোট্সডাম সম্মেলনে সোভিয়েত রাশিয়া এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয় এবং ১৯৪৫-এর আগস্ট মাসে কোরিয়ার উত্তরাংশ অর্থাৎ ৩৮° অক্ষরেখার উত্তরাংশ সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে এবং দক্ষিণাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এইভাবে ৩৮° অক্ষরেখা ধরে কোরিয়ার ওপর সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে মনে করা হয়েছিল যে, কোরিয়ার এই বিভাজন সাময়িক, কিন্তু অচিরেই দেখা গেল যে জার্মানির ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, কোরিয়ার ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। দু-পক্ষই নিজ নিজ অধিকৃত এলাকায় নিজ মতাদর্শ অনুযায়ী সরকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় এবং এইভাবে কোরিয়া ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে জড়িয়ে পড়ে।
❏ কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল :
(১) যুদ্ধের পশ্চাৎপট : কোরিয়া যুদ্ধের কারণ অনুধাবন করতে হলে আমাদের ওই দেশের অতীত ইতিহাস কিছুটা পর্যালোচনা করা দরকার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দূরপ্রাচ্যের কোরিয়াকে কেন্দ্র করে তিনটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। ওই তিনটি শক্তি হল সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিন ও জাপান। কোরিয়াকে কেন্দ্র করে চিন-জাপান যুদ্ধে চিন পরাজিত হয়ে শিমনোসেকির সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়।
(২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কোরিয়া : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোরিয়া জাপান কর্তৃক অধিকৃত ছিল। তবে 1941 খ্রিস্টাব্দে কায়রো সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোরিয়াকে জাপানি অধিগ্রহণ থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। ফলে স্থির হয় জাপানি সৈন্য 38° অক্ষরেখার উত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে এবং 38° দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করবে।
(৩) দক্ষিণ কোরিয়া : 1948 খ্রিস্টাব্দে জাতিপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সিংম্যান রির নেতৃত্বে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন আজ্ঞাবাহক সরকার গঠিত হয়। ওই বছরের 12 ডিসেম্বর জাতিপুঞ্জ এই সরকারকে সমগ্র কোরিয়ার একমাত্র বৈধ সরকার বলে ঘোষণা করে। এভাবে দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
(৪) উত্তর কোরিয়া : 1948 খ্রিস্টাব্দে কিম-উল-সুংয়ের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়ায় একটি সোভিয়েত অনুগামী কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হয়। ওই সরকারের রাজধানী ছিল 'পানমুনজম। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সরকারকে স্বীকৃতি জানায় এবং সর্বপ্রকার সহযোগিতা করে। এভাবে কোরিয়াকে কেন্দ্র করে দুই শক্তির মধ্যে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়।
(৫) কোরিয়া যুদ্ধ : 1950 খ্রিস্টাব্দে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী 3৪° অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধের সূচনা হয়। জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপস্থিতিতে উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী দেশ বলে চিহ্নিত করে। পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়াকে সর্বপ্রকার সাহায্য করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে আবেদন জানায়। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই কোরিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
❏ কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল : কোরিয়া যুদ্ধ নিষ্ফল হলেও সেটি একেবারে গুরুত্বহীন ছিল না। এই যুদ্ধের গুরুত্বগুলি হল— (১) বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়ার সংযুক্তি সম্ভব তো হয়নি বরং কোরিয়ার বিভাজন সেখানকার মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়। (২) কোরিয়াকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত-চিন মৈত্রী দৃঢ় হয় এবং মার্কিন-চিন সম্পর্কের অবনতি ঘটে। (৩) দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফলে দুই কোরিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। (৪) কোরিয়া যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াই শুধু ইউরোপে নয় এশিয়াতেও বিস্তারলাভ করে। (৫) এই যুদ্ধে চিনের সামরিক সাফল্য ঘটে এবং জাতিপুঞ্জের মর্যাদা হ্রাস পায়।
❏ উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, কোরিয়া যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগ্ন নীতিকে প্রকাশ্যে এনেছিল। এ ছাড়া এই যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অপরদিকে এই যুদ্ধই সর্বপ্রথম ভারতবর্ষকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নির্জোট আন্দোলনের প্রায়োগিক রূপ উপস্থাপিত করার সুযোগ এনে দেয়।
___________
৪. জোটনিরপেক্ষ নীতি কী? এই নীতির প্রবক্তা কে? জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণের পশ্চাতে বিভিন্ন কারণগুলি লেখো।
❏ জোটনিরপেক্ষ নীতি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট ও সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের কোনো একটি জোটে যোগ না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকার নীতিই হল জোটনিরপেক্ষ বা নিজোর্ট নীতি। এই জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি নিজেদের স্বার্থে যে আন্দোলন গড়ে তোলে তার নাম নির্জোট আন্দোলন।
❏ এই নীতির প্রবক্তা হলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং যুগোশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী মার্শাল টিটো।
❏ জোটনিরপেক্ষ নীতির পশ্চাতে বিভিন্ন কারণ :
(১) জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষা : সুপ্রাচীন কাল থেকেই অহিংসা, শান্তি, সহমর্মিতা ও সহনশীলতার আদর্শে ভারত বিশ্বাসী। হিংসা-জর্জরিত পৃথিবীতে বুদ্ধ ও অশোকের শান্তির বাণী ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্ষমতার শীর্ষে উঠেও আকবর ও শিবাজি সহনশীলতার কথা প্রচার করেন। এই সুমহান আদর্শ ও জাতীয় ঐতিহ্য বহন করার উদ্যোগ থেকেই ভারত সরকার জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণে অগ্রসর হয়।
(২) রাজনৈতিক স্বতন্ত্রতা : রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত পুঁজিবাদ বা সাম্যবাদ কোনোটিকেই সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেনি। কারণ ভারত গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজেই ঔপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরোধী ছিলেন। নেহরু বলেছিলেন—বিশ্বের পক্ষে ও আমাদের পক্ষে যা ক্ষতিকর তা আমরা নির্দ্বিধায় নিন্দা করব।
(৩) আর্থসামাজিক উন্নতি: স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরের মুহূর্ত থেকেই ভারত এক গভীরতর আর্থসামাজিক সংকটের মুখে পড়ে। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব, কালোবাজারি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এসব সমস্যার ফলে ভারতীয় অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়লে নেহরু স্বতন্ত্র আর্থিক পরিকল্পনা গ্রহণের দ্বারা আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হন।
(৪) জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ : জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে কোনো দেশেরই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় না। তবে এই স্বার্থ সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু কখনোই উপেক্ষিত হতে পারে না। সাম্যবাদী বা ধনতন্ত্রবাদী কোনো জোটের মধ্যে না গিয়ে নেহরু মিশ্র অর্থনীতি ও স্বাধীন বিদেশনীতি গ্রহণের দ্বারা জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে নেহরু বলেছেন—“স্বাভাবিকভাবেই আমি ভারতের স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখেছি, কারণ এটিই আমার প্রধান কর্তব্য”।
(৫) নিরপেক্ষতা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী ও ধনতন্ত্রবাদী এই দুই পরস্পরবিরোধী শক্তিজোটে বিভক্ত বিশ্ব যখন ঠান্ডা লড়াইয়ে মত্ত, তখন ভারত কোনো জোটেই অংশগ্রহণ না করে নিরপেক্ষনীতি গ্রহণ করে।
(৬) তৃতীয় শক্তিজোটের নেতৃত্ব : যে সমস্ত দেশ ঠান্ডা লড়াইয়ের বাইরে থাকতে চাইছিল, কী আয়তন, কী জনসংখ্যা উভয় ব্যাপারেই ভারতের কাছে তারা ছিল নিতান্তই নগণ্য। সুতরাং নিজের নেতৃত্বে বিশ্বে একটা জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী বা তৃতীয় শক্তিজোট গড়ে তোলার লক্ষ্যেও ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে।
___________
- উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস MCQ সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন ২০২৪ মার্ক - ৮
- উচ্চমাধ্যমিক সংস্কৃত সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক এডুকেশন সাজেশন ২০২৪
No comments
Hi Welcome ....