প্রশ্নঃ দিনলিপি কী? ➧দিনলিপি লিখন নিয়ম: স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীরা তোমাদের ‘দিনলিপি’ লেখার সহজ উপায় হল একটি ‘ডায়েরি’ জোগাড় করে তাতে লেখা। ...
প্রশ্নঃ দিনলিপি কী?
➧দিনলিপি লিখন নিয়ম: স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীরা তোমাদের ‘দিনলিপি’ লেখার সহজ উপায় হল একটি ‘ডায়েরি’ জোগাড় করে তাতে লেখা। দিনলিপিতে সাল-তারিখ যথাযথ উল্লেখ করে প্রতিদিনের ঘটনাবলি পরপর সাজিয়ে লিখতে হয়। তবে এটি খুব সুচিন্তিত মতামত ও নিষ্ঠার সঙ্গে লিখতে হয় এবং দিনের যে-কোনো নির্দিষ্ট সময় স্থির করে নিতে হয়। একে অনেক দিনপঞ্জি’ হিসেবেও চিহ্নিত করেন। প্রতিদিনের এক-একটি ঘটনা ও কাহিনি প্রতিদিনই লিখতে হয়। লিখতে হয় সহজ সরল ভাষায় প্রতিদিনের প্রতিটি অভিজ্ঞতার কথা।
ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি দিনলিপি
❒ আরো পড়ুনঃ
🖊 হাতেকলমে প্রশ্নের উত্তর
আমার জন্মদিন
তারিখ : ০১/০১/২০২২
আজ আমার জন্মদিন। আজ আমি বারো বছরে পা দিলাম। যখন আমার ৬ বছর বয়স হল তখন একটু একটু মনে পড়ে, আমি খুব সুন্দর একখানা জামা পরেছিলাম। তখন ভাই টিংকুর বয়স বোধহয় মাস ছয়েক। খুশিতে আমি ভাইকে দু-এক মিনিট কোলে নিয়েছিলাম। আর তার পরেই ঘটে গেল বিভ্রাট। ভাই আমার জামাটা ভিজিয়ে দিল। আমি ভাইকে তখনিই মায়ের কোলে দিয়ে খুব কেঁদেছিলাম। '‘জন্মদিন’ এলে আমাদের সকলের মন আনন্দে হিল্লোলিত হয়ে ওঠে। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি আমার জন্ম হয়েছিল। আমার সাত বছর বয়সে পা দিয়ে যে জন্মদিনটা পালিত হয়েছিল তা আমার খুব মনে আছে। আট বছর বয়সে পা দিয়ে জন্মদিন আর তার পরের জন্মদিনগুলো তো ভীষণ স্পষ্টই মনে আছে। সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি এই দিনটির জন্য। বাবা-মা আমাকে খুব ভালোবাসেন। তাঁদের আশীর্বাদ ও স্নেহের ছায়ায় আজ বারো বছরে পা রাখলাম।
বাড়িতে আজ আমার জন্মদিনের উৎসব। জন্মদিন পালিত হল আমাদের বাড়িতেই। আমার অনেক বন্ধু ও বান্ধবী সকলে উপস্থিত ছিল। স্কুলের বন্ধুবান্ধবীরাও এসেছিল। তাদের সকলের সামনে আমি সন্ধ্যার সময় এক উজ্জ্বল আলোকে ফুঁ দিয়ে বারোটি মোমবাতি নিভিয়ে আমি কলকাতার বিখ্যাত ‘মনজিনিস’ কোম্পানির বড়ো একটি চকলেট কেক কাটলাম। তারপর একে-একে মা-বাবা সকলকে কেক খাইয়ে দিলেন। চলল সারাদিনের ক্লান্তিময় জীবনের এক আনন্দ উচ্ছ্বাস। বেলুন-টুপি-চকোলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে চলল গান শোনানোর পালা। অবশেষে সবাইকে বসিয়ে খাওয়ানোর অনুষ্ঠান পর্ব। রাত এখন সাড়ে দশটা। সকলেই চলে গেল কয়েক মিনিট আগে। সাড়ে নটা নাগাদ অমল কাকু এক ডজন কলমের সুন্দর একটা বাক্সের রঙিন প্যাকেট আমার হাতে উপহার দিয়ে আমার গালটা একটু টিপে দিয়ে হেসে বললেন, “খোঁখি, তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে না। হামি তুমার শ্বশুরকে মারবে”। তাঁর এইকথা শুনে উৎসবে হাজির সকলে হো-হো করে হেসে উঠলেন। রাত সাড়ে দশটায় সকলে হাসিমুখে বিদায় নিল ভাবছি, আবার একটি বছর আমাকে অপেক্ষা করতে হবে এমন এক আনন্দের দিনের জন্য।
{tocify} $title={Table of Contents}
সরস্বতী পূজা
তারিখ : ১৫/০২/২০২২
প্রতি বছরের মতো এ বছরও সরস্বতী পূজা গত পরশু হয়ে গেল। বাগ্দেবীর পূজার দু-দিন আগে থেকে আমরা সকলে মিলে স্কুলে পুজোর প্যান্ডেল করলাম। তিনদিন আগে পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়গুলিতে নিমন্ত্রণ পত্র দিতে গিয়েছিলাম। সরস্বতী হল বিদ্যার আরাধ্যা দেবী। পুজোর দিন সকালে নতুন জামাকাপড় পরে সরস্বতী দেবীর চরণে আমরা সকলে মিলেঅঞ্জলিদিতে এলাম। ঠাকুরমশাই আরতিকরার পর আমাদের কে হাতে ফুল দিয়ে মন্ত্রআবৃত্তিকরতেবসলেন, 'সরস্বতী! বিদ্যে, কমললোচনে’ইত্যাদি। দেবীকে ভক্তিভরে প্রণাম করে দেবীর কাছে বিদ্যা-বুদ্ধি-ধন-শান্তি-সমৃদ্ধির প্রার্থনা করলাম। আমাদের স্কুলের মাঠে এ বছর বড়ো করে মণ্ডপ ও প্যান্ডেল হয়েছিল। ছোটোবড়ো মিলিয়ে অনুমান চার-পাঁচশো জন হবে। শালপাতার ঠোঙায় সকলকেই মায়ের প্রসাদ দেওয়া হয়েছে হাতে হাতে। সন্ধ্যা সাতটায় দেবীর আরতির পর উপস্থিত প্রায় পাঁচ-ছশো মানুষ পেট ভরে খিঁচুড়ি প্রসাদ খেল। এ বছর স্কুলের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে স্কুল কমিটি অনেক টাকা ঢেলে এই অনুষ্ঠান করলেন। পরের দিন বেলা এগারোটায় দধিকর্মা হল। উপস্থিত ছিল জনা পঞ্চাশেক ছাত্রছাত্রী। সন্ধ্যায় বাজনাবাদ্যি সহকারে প্রসেসন করে সন্ধ্যায় দেবীর বিসর্জন দেওয়া হল।
সবেবরাত
তারিখ : ২৭/০৬/২০২২
জাতিতে আমরা মুসলমান। আজকের দিনটিতে আমাদের পবিত্র সবেবরাত। এইদিন আমাদের মুসলমান ভাইসব নিয়ম-নিষ্ঠার সহকারে মহান পবিত্র এই রাতটি পালন করলেন। সমগ্র বিশ্বের কয়েক কোটি ইসলাম ধর্মাবলম্বা মানুষ তাঁদের প্রয়াত পরিজনদের সমাধি ক্ষেত্রে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে পালন করলেন সৌভাগ্যের এই রাত। এই রাতটি সারাবছর ধরে আমরা আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করে থাকি। প্রত্যেক মুসলিম পরিবার তাঁদের পরলোকগত আত্মীয়দের স্মৃতিরক্ষার্থে এই শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে থাকেন প্রতিবছর এই দিনে সবেররাত-এর রাতে। সমস্ত দরিদ্র-ধনী-মানি-গুণী-পরিজন পবিত্রতার সঙ্গে এই সবেবরাত অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। আমি লক্ষ করেছি, যে-কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান মানেই সেই ধর্মের প্রত্যেক মানুষ তাতে যোগদান করেন। আমাদের ইদ, মহরম, সবেবরাত ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সম্মিলিত ধর্মীয় ভাব জেগে ওঠার মূলে রয়েছে পবিত্র কোরান শরিফ। ইরাক, ইরান, আরব, মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি নামকরা দেশ এবং বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য ছোটো-বড়ো দেশগুলির প্রত্যেকটি মুসলিম নরনারীর কাছে এই রাত এক মহৎ ও পবিত্র উৎসবের রাত। কোনো ধর্মকে অশ্রদ্ধা না করে সমস্ত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করাই সকল ধর্মের সকল জাতির মানুষের কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।
জিশুখ্রিস্টের জন্মদিবস
তারিখ : ২৫/১২/২০২২
জিশুখ্রিস্টের জন্মদিবস মানেই বড়োদিন। সুতরাং বড়োদিনের উৎসব মানেই কেক আর কেক। এবং প্রত্যেক গির্জায় আলোর রোশনাই। আজ ২৫ ডিসেম্বর ২০২২। এই তারিখটি সমগ্র খ্রিস্টান জগতের কাছে একটি মহা পবিত্রতার দিন। এইদিনে মা মেরির কোল আলো করে আবির্ভূত হলেন মানুষদের মুক্তিদাতা যিশুখ্রিস্ট। এই বড়োদিন ঘৃণা, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে সবচেয়ে বড়ো উৎসব। রক্তস্নাত পৃথিবীর মানুষের মন থেকে দ্বেষ, ঈর্ষা,হানাহানির বিষ মুছে দিতে প্রেম, শান্তি, মৈত্রীর বাণী শুনিয়েছিলেন যিশুখ্রিস্ট। তাই তাঁর জন্মদিনে ‘বড়োদিন’ রূপে পালিত হয় মহৎ ভাব। দিনটি ‘X-mas’ Day হিসেবেও চিরস্মরণীয়। ২৪ ডিসেম্বর-এর আগের দিন সন্ধ্যায় গির্জায় গির্জায় ছেয়ে যায় আলোক সজ্জায়। খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বাইবেল পাঠ করা হয়। প্রার্থনাসভা অতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়। নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে পান ও নৈশভোজনের উৎসবে সকলে মেতে ওঠেন। গির্জাগুলিতে কেক বিতরণ করা হয়। জিশুখ্রিস্ট মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোকে পৌঁছে দেবার জন্য যে পবিত্র মানবধর্ম ও প্রেমধর্ম প্রচার করেন সেইসব মহৎ বাণীগুলি স্মরণ করা হয়। অহিংসা, ভ্রাতৃভাব আর ভালোবাসার দ্বারা মানুষের হৃদয়কে জয় করাই ছিল জিশুর অমৃতময় বাণী। তাই তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে নানা জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে অতি প্রিয় উৎসবের দিন। উৎসবপ্রিয় বাঙালিও বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো বড়ো দিনটিও মহা উৎসাহে এখন পালন করে। আমি আমার মায়ের হাত ধরে নিউমার্কেটে আলোর সজ্জা দেখে এলাম।
বুদ্ধ জয়ন্তী
তারিখ : ১৬/০৫/২০২২
বুদ্ধ জন্মজয়ন্তী সমগ্র বিশ্বে এক অতি পবিত্রতার দিনরূপে চিহ্নিত আজ ২৮ বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার আগে এই দিন ভগবান বুদ্ধদেব বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তু নগরে আবির্ভূত হন। তাঁর জন্মলগ্নে সমস্ত জগত্ময় এক উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল। সমগ্র নগরবাসী সেদিন বুদ্ধদেবের মতো শিশুসন্তান দেখার জন্য দলে দলে বাড়িতে এসেছিলেন। কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদনের পুত্র গৌতম জন্মগ্রহণ করেন মাতা মায়াদেবীর গর্ভে। কিন্তু তাঁর জন্মদান করেই মাতা মায়াদেবী পরলোকে চলে যান। শিশুটিকে মানুষ করেন তাঁর বিমাতা তথা মাসি গৌতমী। তাই তাঁর নাম গৌতম। ১৬ বছর বয়সে গৌতমের বিবাহ হয় গোপা নামে এক কিশোরীর সঙ্গে। তাঁদের রাহুল নামে একটি পুত্র সন্তানও ভূমিষ্ঠ হয়। কিন্তু রাজপুত্র গৌতম মানুষের দুঃখকষ্ট দেখে তার মুক্তির উপায়ে খুঁজতে ২৮ বছর বয়সে রাজবাড়ি ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তিনি গৌতম বুদ্ধ নামে খ্যাতিলাভ করেন। তাঁর দিব্যজ্ঞান দুঃখী, আর্ত, পীড়িত, বিভ্রান্ত মানুষদেরকে দেখায় সুস্থভাবে বেঁচে থাকার দিশা। তাই তাঁর জন্মদিনকে উপলক্ষ্য করে প্রতিবছর বুদ্ধ-জন্মজয়ন্তী মহা উৎসাহে পালিত হয়। বুদ্ধদেবের অমৃতবাণী বৌদ্ধ উপাসনাগুলিতে পাঠ করা হয়। ওইদিন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষেরা বুদ্ধদেবের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে গরিব অসহায় মানুষদের অকাতরে দান করেন। উচ্ছ্বাস ও আনন্দ সহকারে এইভাবে বুদ্ধজয়ন্তী সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিত হয়।
মহাবীর জয়ন্তী
তারিখ : ০৬/১১/২০২২
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে অর্থাৎ বুদ্ধদেবের জন্মেরও কয়েক বছর আগে এক ক্ষত্রিয় রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন মহাবীর। তিনি ২৯ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে যান। মহাবীর ছিলেন জৈন ধর্মের প্রবর্তক। বুদ্ধদেবের মতো মহাবীরের জন্ম জয়ন্তী পালন করেন জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা। মহাবীরের একনিষ্ঠ মনোভাব ও বাণী সমকালীন কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর ত্যাগ ও নিষ্ঠা আজও জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা রীতিমতো পালন করে চলেছেন। সেই যুগে ছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভয়ংকর কঠোরতা। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় অ-ব্রাহ্মণদের অত্যন্ত হীন চক্ষে দেখত। তাঁদের মতে, ব্রাক্ষ্মণ ছাড়া সমাজের অন্য শ্রেণির মানুষদের ছিল না ধর্মের ওপর কোনো অধিকার। ধর্মচর্চা বা দেবতার পূজা একমাত্র ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য শ্রেণির মানুষ করতে পারত না। তা ছাড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মে ছিল যাগযজ্ঞ, মন্ত্রপাঠ এবং নানাবিধ কুসংস্কার। তাই সমাজের সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে ধর্মের অধিকার দান করতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিবাদী ধর্মরূপে মহাবীর জৈন সৃষ্টি করলেন জৈনধর্ম। দলে দলে অসংখ্য মানুষ এই ধর্মের প্রতি তীব্র অনুরাগী হয়ে উঠল। মহাবীরের পর গুরু পরম্পরা রূপে মোট ২৪ জন জৈন গুরু জৈন ধর্মানুরাগী মানুষদের ধর্মশিক্ষা দান করেন। ২৪তম জৈনগুরুর নাম পার্শ্বনাথ। তাঁর মৃত্যুর পর জৈন ধর্মাবলম্বীরা মতপার্থক্যের জন্য দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। একটি সম্প্রদায়ের নাম শ্বেতাম্বর অন্য সম্প্রদায়ের নাম দিগম্বর। শ্বেতাম্বররা সাদা কাপড় পরেন। দিগম্বররা উলঙ্গ অবস্থায় ধর্মের সাধনা করেন। এই ধর্ম একমাত্র ভারতবর্ষের মাটিতেই সীমাবদ্ধ। মহাবীরের জন্মদিন সমগ্র ভারতের অসংখ্য জৈন ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা মহা ধুমধাম সহকারে পালিত হয়।
উল্লেখযোগ্য ঘটনাবিহীন একটি দিন
তারিখ : ৩১/১২/২০২২
রাত এখন পৌনে এগারোটা। আমার ডায়েরির পাতার ওপর কলম খুলে বসে আছি, কী লিখব সেটাই চিন্তা করছি। সকাল থেকে আজ সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। শীতের এই রাতে বাড়ির প্রায় সকলেই দেখছি জেগে আছে—বাবা, মা, দিদি, ঠাকুমা সকলেই। টিভি দেখছে আর গল্পগুজব করছে। আমি বসে আছি টেবিল ল্যাম্পের সামনে। চিন্তা করছি, আজ তো এমন কিছুই উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি যা আমার দিনলিপিতে লিখে রাখা যায়। প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল উঠে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করার পর স্নান সেরে খাওয়া সেরে শীতের সোয়েটার গায়ে দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বাসে চেপে স্কুলে যাওয়ার কোনো ঘটনাই ছিল না। কারণ স্কুল খুলবে ৮ জানুয়ারি। সুতরাং নতুন বই না পাওয়া পর্যন্ত কিংবা আমাদের ষষ্ঠ শ্রেণির প্রথম ক্লাস শুরু হওয়া পর্যন্ত পড়াশোনার কোনো বালাই নেই। সকালে ভরনা মাসি তাঁর ছেলেকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে গেলেন। ঝরনা মাসির ছেলে খোকনের সঙ্গে গল্পগুজব করে কিছুক্ষণ কাটালাম। খোকন আমার সঙ্গে পড়ে। সে জিগ্গেস করল আমি কী করছি। আমি বললাম কিছুই না। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম সে কী করছে। সেও যেন শুকনো হাসি হেসে বলল কিছু না রে! যেন কোনো দিকে কোনো ব্যস্ততা নেই, তাই ভালো লাগছিল না। মায়ের সঙ্গে তোদের বাড়ি চলে এলাম। বাবা বলেছে রাত ঠিক বারোটায় নতুন বছরের তোপধ্বনি পড়বে রোম শহরের প্রধান গির্জায়। সেটা টিভিতে দেখা যাবে। সকাল থেকে এই রাত পর্যন্ত লেখার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা না পেয়ে এখন আমি এই এত রাতেও অপেক্ষা করছি। কারণ খোকন বলে গেছে, রাত বারোটায় টিভিটা নজর করতে। জানি না আরও এক ঘণ্টা জেগে বসে থাকতে পারব কিনা। চেষ্টা করছি বসে থাকার। দেখব কেমন হয় নতুন বছর বরণ রোমরাজ্যে।বাংলা নববর্ষ
তারিখ : ১৫/০৪/২০২২
আমরা বাঙালি। আজ আমাদের বাংলা নববর্ষ। শুরু হল আজ ১৪২৩ বঙ্গাব্দ, ১৫ এপ্রিল, ২০২১। বাংলাদেশে প্রচলিত আছে প্রতি বছর দুটি নববর্ষ। ১ জানুয়ারি দিনটিকেও আমরা সমগ্র বাঙালি জাতি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরস্পরকে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বাঙালির নববর্ষ ১ বৈশাখ। দিনটি ‘শুভ পয়লা বৈশাখ’ নামেই সমগ্র বাংলার ঘরে ঘরে যেন খুব আদরের মাস। এদিনেই ছোটোবড়ো প্রায় প্রত্যেকেই নতুন জামাকাপড় পরে কিংবা পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরে সামনাসামনি দেখা হয়ে যাওয়া মানুষকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে ‘শুভ নববর্ষ’ বলে প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময় করি। নানা স্থানে হয় পরস্পরের মধ্যে মিষ্টান্ন বিনিময়। অর্থাৎ, একে অপরকে মিষ্টি খাইয়ে দেয়। আমি বাবার হাত ধরে বেলা বারোটা নাগাদ হারুকাকুর বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম। সেখানে হারুকাকুর মেয়ে ছিল। কাকিমাও ছিলেন। হারুকাকুর মেয়ে আমার দিদির বয়সি। সে আমার মুখে জোর করে একটা বড়ো সন্দেশ ধরিয়ে দিল। মুখের সামনে গ্লাস ধরে ঠান্ডা জল খাইয়ে দিল। তারপর হাতে ধরিয়ে দিল একটা বড়োসড়ো মিষ্টির প্যাকেট। হাসিখুশি মুখে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে আসার পথে দেখলাম প্রায় প্রতিটি দোকানই ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে। দোকানে দোকানে অনেক লোকের সমাগম। বাবা আমাকে বলল আজ প্রতিটি দোকানে পুরোনো বছরের হিসাবপত্রের খাতা গুছিয়ে রেখে নতুন বছরের জন্য নতুন খাতা লেখা শুরু হয় তাই বাংলায় একে বলে 'হালখাতা'। আজ আমাদের বাঙালির মস্ত আনন্দের দিন। আজ আমরা পুরোনো বছরের সমস্ত দুঃখ-বেদনা ভুলে আগামী ৩৬৫ দিন আনন্দে কাটুক—এই কামনা সকলের জন্য সকলেই করি। সকলের মুখে সারাটা বছর মিষ্টির স্বাদ লেগে থাকুক।একটি বনভোজনের দিন
তারিখ : ০৩/০১/২০২২
বনভোজন নামটা শুনলেই মনে যেন একটা দারুণ রোমাঞ সৃষ্টি হয়। বনে বসে ভোজন। অর্থাৎ, ঘর ছেড়ে দলবদ্ধ হয়ে কোনো বনে গিয়ে রান্না করে একসঙ্গে বসে খাওয়া। দারুণ মজা! যেন এক মুক্তির আনন্দ! মুক্ত আকাশের নীচে রান্না, বনজঙ্গলের মধ্যে সকলের সঙ্গে বসে হইচই করে খুশিমতো খাওয়া। দুদিন আগে আমার জীবনে এই প্রথম দারুণ এক আনন্দের দিন কেটে গেল। পরশু ছিল পয়লা জানুয়ারি ২০২২। কনকনে ঠান্ডা। তা সত্ত্বেও বিপুল উৎসাহে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম সকাল সাড়ে পাঁচটায়। বনমহোৎসবে আমরা মিলিত হতে গেছিলাম ১ জানুয়ারি ২০২২ দক্ষিণ ২৪ পরগনার গাদিয়াড়া পুরোনো রাজবাড়িতে। মোট চারখানা বাসভাড়া করা হয়েছিল। ২০০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে বনভোজন করতে গিয়েছিলেন আমাদের স্কুলের ৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। আমাদের বনভোজন উপকরণ ছিল রাইস, চিলিচিকেন, চাটনি, বেগুনি, পাঁপড়ভাজা, চিকেন, পকোড়া, চা-বিস্কুট, রসগোল্লা, মিষ্টি দই, আইসক্রিম ইত্যাদি। আমাদের সঙ্গে চারজন রান্নার ঠাকুর গিয়েছিলেন। তাঁদের যথেষ্ট সহযোগিতায় আমরা বেলা দশটা নাগাদ টিফিনে গরম গরম কচুরি আর আলুর দম পেয়ে গেলাম। হাতে হাতে শালপাতার ঠোনা নিয়ে বনের মধ্যে যে যার খুশিমতো ঘুরেফিরে খেতে লাগল। এরপর ঘণ্টা তিনেক এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ালাম, বন্ধুরা হাত ধরাধরি করে। সকলে একসঙ্গে ঘাসের ওপর বসে বেলা তিনটেয় লাঞ্চ করলাম । পিঠের ওপর লাগাচ্ছি শীতের রোদ্দুর। লাক্সারি বাসে করে আমরা গিয়েছিলাম আবার ফিরেও এলাম। সকাল ৬.৩০ মিনিটে রওনা হয়েছিলাম আর রাত ৮-টার সময় আবার ফিরে এলাম। এভাবে আমাদের সমস্ত ছাত্রছাত্রীও শিক্ষকদের কাছে বনভোজনের দিনটি খুব আনন্দে অতিবাহিত হয়েছিল।স্কুলের একটি স্মরণীয় ঘটনার দিন
তারিখ : ১২/০১/২০২২
আমাদের বিদ্যালয়ের নাম বরাহনগর রামেশ্বর হাইস্কুল। আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ‘খ’ বিভাগের ছাত্র। এই স্কুলে আমি এসেছি এই দ্বিতীয় বছর হল। গতকাল আমাদের এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রীযুক্তবাবু সরোজাক্ষ নন্দ মহাশয় অবসর গ্রহণ করলেন। এই ঘটনা স্বাভাবিক ছিল। কারণ ষাট বছর পর্যন্ত সরকারি নিয়মে স্কুলে শিক্ষকতা করার পর তাঁকে কর্মজীবন থেকে চিরকালের জন্য অবসর দেওয়া হয়। সরোজাক্ষ বাবুকেও নিয়মমাফিক অবসর দেওয়া হল। কিন্তু তাঁর মতো জ্ঞানীগুণী এবং অত্যন্ত মহৎ মানুষের সঙ্গ আমরা আর পাব না ভেবে অনেক ছাত্রছাত্রী উচ্চস্বরে কেঁদে ফেলল। বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষিকার চোখে সামান্য অশ্রুর রেখা দেখা গেল। সদা হাস্যময় সরোজাক্ষবাবু সকলের প্রতি দুই হাত প্রসারিত করে বললেন, তোমরা ছোটোরা প্রত্যেকে আমার সন্তানের মতো। তোমাদের স্থান আমার হৃদয়ের মধ্যে। তোমরাই আমার গৌরব। তোমরা এই স্কুলের ভবিষ্যৎ। তোমরা সমগ্র দেশের ভবিষ্যৎ। আমি যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়েই সুখে থাকব। তোমরা শিক্ষাদীক্ষায় জ্ঞানে গরিমায় যত উন্নতি করবে ততই আমার শেষ জীবন হবে পরম সুখময়। তবেই আমি মনে করব শিক্ষক হিসেবে আমার জীবন সার্থক। আমি বিশ্বাস করি, আমার সহযোগী যেসব শিক্ষক-শিক্ষিকা এই স্কুলে থেকে গেলেন তাঁদের পরম স্নেহে, তাঁদের যথাযথ শিক্ষাদানে তোমরা অনেক অনেক উন্নতি করবে, জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। স্কুলের গৌরব বৃদ্ধি করবে। প্রাক্তন এই হেড স্যারের সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষিকা তাঁকে প্রণাম করলেন। আমরাও প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী সারিবদ্ধভাবে একে একে তাঁকে প্রণাম করলাম। তিনি আমাদের প্রত্যেকের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। স্যারের গলায় পরানো হয়েছিল মস্ত এক রজনিগন্ধার মালা। আমি প্রণাম করে তাঁর চোখের দিকে পলকের জন্য তাকিয়ে দেখলাম, স্যার নিজেও তাঁর স্কুলের বিদায়বেলায় অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। তাঁর চোখেও জল চিকচিক করছিল।
No comments
Hi Welcome ....