প্রকৃত দেশপ্রেম আমার জীবনের লক্ষ্য ছাত্রজীবনে খেলাধুলা রক্তদান জীবনদান বাংলা ভাষা 5+ Best Bangla Rochona Somogro...
প্রকৃত দেশপ্রেম |
---|
আমার জীবনের লক্ষ্য |
ছাত্রজীবনে খেলাধুলা |
রক্তদান জীবনদান |
বাংলা ভাষা |
5+ Best Bangla Rochona Somogro
প্রকৃত দেশপ্রেম
দেশপ্রীতি বা দেশপ্রেম হল দেশকে ভালোবেসে দেশের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। এই বিশাল বিশ্বের যে ভূখণ্ডে মানুষ জন্ম নেয়, যে দেশের আলো-বাতাস-ধূলিকণায় তার নিশ্বাসপ্রশ্বাস, যে দেশের অন্নজলে তার শ্রী ও পুষ্টি, যে দেশের ধর্ম-ভাষা-পালাপার্বণে তার মুক্তি; সেই দেশই হল তার স্বদেশ। সেই দেশের মানুষই হল তার স্বজন। মাতৃসমা সেই দেশের প্রতি আন্তরিক প্রীতিই হল তার দেশপ্রেম। যার বলে সে বলতে পারে—‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি।' সামাজিক মানুষের গভীর মমত্ববোধই হল দেশপ্রেমের উৎস, স্বজাতিপ্রীতির বন্ধন। দেশ ও জাতির জীবনে যখন সুখ আর ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য তখন মানুষের স্বদেশপ্রেম থাকে গভীর ঘুমের ঘোরে মগ্ন। দুঃখ নির্যাতনের আঘাতে আঘাতেই হয় সেই সুপ্তিমগ্নতার আবরণ উন্মোচন। যখন রক্তচক্ষু বিদেশি শাসকের নির্যাতন চরমে পৌঁছোয়, তখনই আসে মানুষের স্বদেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষালগ্ন।সুতরাং বলা যায় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয়তাবোধ হল স্বদেশপ্রেমের প্রধান উৎস। গভীর আত্মসম্মান বোধ থেকেই জন্ম নেয় অগ্নিশুদ্ধ দেশপ্রেমের মহামন্ত্র। ‘আমরা যতই স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হইব, ততই আমরা আনন্দের অনুভূতি পাইব।' নেতাজি সুভাষচন্দ্ৰ কথিত এই আনন্দের অনুভূতিই হল দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেম মানুষের এক ধরনের পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। এই ভাবাবেগের সোনার কাঠির স্পর্শেই মানুষের কর্মে, চিন্তায়, জীবনযাত্রায়, শিল্প-সাহিত্যে আসে নবজাগরণ। অবশ্য কেবল দেশে জন্মগ্রহণ করলেই দেশ আপন হয় না। তার জন্য মাতৃসমা জন্মভূমিকে নিজের সঙ্গে অভেদ জ্ঞান করে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে হবে, বলতে হবে—জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।' দেশের মাটি মায়ের মতোই আমাদের লালনপালন করে।
মহাকবি শেকস্পিয়র তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘জুলিয়াস সিজার’-এ ব্রুটাসের মুখ দিয়ে বলেছেন—“Who is here so vile that will not love his country?”—এখানে কে এমন নরাধম আছেন, যিনি নিজের দেশকে ভালোবাসেন না? ইংরেজ কবি বায়রন বলেছেন—“He who loves not his country, can love nothing?’—যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না, সে আর কোনো কিছুকে ভালোবাসতে পারে না। জন্মদাত্রী মায়ের মতো জন্মভূমি দেশমাতৃকার সঙ্গে প্রতিটি মানুষের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির যোগ রয়েছে। দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, ভালো মন্দের সঙ্গে আমাদের ভালোমন্দ নির্ভর করে। সে-কারণে একজন দেশপ্রেমিক দেশের কল্যাণে দেশের মর্যাদারক্ষার জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেন না। তখনই তা হয়ে ওঠে প্রকৃত দেশপ্রেম।
আমাদের এই ভারতবর্ষে অনেক মহান দেশপ্রেমিক মাতৃভূমির বেদিতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। লক্ষ্মীবাঈ, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশ, নেতাজির আত্মোৎসর্গে গড়ে উঠেছে স্বাধীন ভারতের মুক্তিসৌধ। বৃহত্তর কল্যাণ চেতনার আলোকে তাদের অন্তলোকে প্রজ্বলিত করেছেন দেশপ্রেমের নিষ্কলুষ অনির্বাণ দীপশিখা। মৃত্যুর গর্জন তাই তাঁদের কাছে সংগীত—ফাঁসির মঞ্চে তাই তারা পরিবেশন করেন জীবনের জয়গান। বস্তুত রাজনীতিবিদের প্রথম ও প্রধান শর্তই হল দেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমের পবিত্র বেদিমূলেই রাজনীতির পাঠ। পরাধীন ভারতবর্ষে নানা রাজনৈতিক দলগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পরাধীনতার বন্ধন থেকে দেশজননীর শৃঙ্খলামোচন করা । কিন্তু দেশপ্রেম যখন এইসব রাজনৈতিক নেতারা অন্ধ ও উগ্ররূপে প্রকাশ করে, তখন তা জাতির জীবনে এক অনপনেয় কলঙ্ক হয়ে ওঠে।
যথার্থ দেশপ্রেমের সঙ্গে বিশ্বপ্রেমের কোনো অমিল নেই, নেই কোনো বিরোধ। এই বাণীকে জাতির জীবনে গ্রহণ করলেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধ থেকে আমাদের মুক্তি। স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম এক অখণ্ড উপলব্ধিরই অভিন্ন সত্তা ৷ দেশপ্রেম আমাদের মনের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, সেই অনলে অন্তরের সমস্ত পাপবোধকে আহুতি দানেই আমাদের জীবন পরিশুদ্ধ হয়। এক মহৎ চেতনার বিভায় মানবজন্ম হয় ভাস্বর। আত্মস্বার্থ বলি দিয়ে দেশের সেদিনই স্বার্থকে যেদিন নিজের স্বার্থ বলে মনে করতে পারা যাবে, দেশের যথার্থ অগ্রগতি সম্ভব। দেশকে ভালোবেসে স্বামী বিবেকানন্দ সেদিন বলেন, 'ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ, আমার কল্যাণ’—ভারতবাসী যেদিন বিবেকানন্দের এই বাণীর মর্ম উপলব্ধি করবে সেদিনই জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব হবে।
আমার জীবনের লক্ষ্য
‘কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার, ....আমি শুধু বোকাই হব, এটাই আমার অ্যাম্বিশন।' জীবনমুখী গানের গায়ক যখন গেয়ে ওঠেন এই গান; তখন বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না মহৎ পেশা ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এসে বেশিরভাগ মানুষের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রচুর অর্থ উপার্জন। সেই অর্থে ‘মুনাফাবাজ’ না হয়ে ‘বোকা’ বা সাধারণ মানুষ হয়ে থাকাটাই তার লক্ষ্য। তবে এ কথা ঠিক ছাত্রজীবনে একটা লক্ষ্য রেখে এগোনো উচিত, কারণ লক্ষ্যহীন জীবন হাল ছাড়া নৌকার মতো। লক্ষ্য যদি স্থির না থাকে তবে সাফল্যে পৌঁছোনোর নিশানা নির্ভুল হয় না। নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাবে কান্ডারি ছাড়া নৌকোর মতো ঘুরে বেড়ানো অর্থহীন। দৃঢ় সংকল্পই হবে সেই জীবন পথের নাবিক। তবে জীবনের সাধনাকে সফল করে তুলতে হলে সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট পথরেখা প্রয়োজন। সেই পথরেখা ধরেই একজন মানুষ তার নির্দিষ্ট অভীষ্টে পৌঁছোতে পারবে।
রবীন্দ্র নাটকের একটি গান হঠাৎই আমার মর্মে আঘাত করে যায়— ‘আমরা চাষ করি আনন্দে মাঠে মাঠে বেলা কাটে, সকাল হতে সন্ধে।' এই গান কেবল খেলার অঙ্গ না হয়ে জীবিকা হলে কেমন হয়? উদ্ভিদের প্রতি শৈশব থেকেই রয়েছে আমার আন্তরিক প্রীতি। রবীন্দ্রনাথের ‘বলাই’ গল্পে কিশোর বলাইয়ের মতো আমারও রয়েছে উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার প্রতি অদম্য কৌতূহল। ভাবলাম একজন সুদক্ষ কৃষিবিজ্ঞানী হলে কেমন হয়! যার খেতে থাকবে নানা প্রকার ফসল, বাগানে ফলবে নানা জাতের ফুল ও ফল। কেবল আবেগ, শখ বা ভালোলাগার কারণে নয়; এর পশ্চাতে রয়েছে আমার নিজস্ব ভাবনা, দর্শন ও যুক্তি। কৃষিপ্রধান এই দেশে চাষযোগ্য জমির সংখ্যা বাড়ছে না, অথচ লোকসংখ্যা বেড়ে চলেছে
ক্রমশ। এর ফলস্বরূপ উন্নত কৃষিব্যবস্থা গড়ে না তুলতে পারলে দেশে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্যসংকট দেখা দেবে। উন্নত বীজ, সার, জলসেচ প্রভৃতির যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে এই অবস্থার সামাল দিতে হবে।
একথা ঠিক আগের তুলনায় অনেক বেশি জমিতে উচ্চ ফলনশীল বীজ, উন্নত সার প্রভৃতির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। কিন্তু যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে না বাড়াতে পারলে শুধু এই দেশ নয়, বিশ্বজুড়ে দেখা দেবে খাদ্যাভাব। ভবিষ্যতের সেই কঠিন অবস্থার কথা ভেবেই আমার এই সিদ্ধান্ত। এই লক্ষ্য বেছে নেওয়ার পশ্চাতে দ্বিতীয় আর-একটি কারণ রয়েছে। বর্তমানে কৃষির উৎপাদন ও উৎপাদিত ফসল, ফলমূল প্রভৃতির মান বৃদ্ধির জন্য যেসব রাসায়নিকের সাহায্য নেওয়া শুরু হয়েছে; তা মানবশরীরে নানা ব্যাধির সৃষ্টি করবে। যেমন - কাঁচা টম্যাটো, কাঁচা কলার উপর এমন রাসায়নিক স্প্রে করা হচ্ছে; যাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টম্যাটো লাল, কলা হলুদ বর্ণ ধারণ করছে। তরমুজের ভিতরে গাঢ় লাল রঙের পশ্চাতেও রয়েছে রাসায়নিকের জারিজুরি। মানবশরীরে এর ক্ষতিকারক দিকগুলি নিয়ে যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে আহ্বান জানাব, তেমনি পাশাপাশি স্বাস্থ্যপ্রদভাবে ফল, শস্য কীভাবে মজুত রাখা যায়; সেই দিকেও গবেষণা চালাব।
কোনো লক্ষ্যপূরণ নির্দিষ্ট সাধনাপথ ব্যতীত সফল হয় না। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে স্নাতক হব, তারপর আমি আমার কর্মজগতে নেমে পড়ব। আমাদের যে জমি রয়েছে তা পার্শ্ববর্তী কৃষকের বিনিময় প্রথার মাধ্যমে একই স্থানে আনব। একই ভূখণ্ডের মধ্যে এলে আমার কৃষিকাজে সুবিধা হবে। জমির একদিকে রাখব বিভিন্ন বীজ ও শস্যের গবেষণার জন্য পরীক্ষামূলক চাষ, অন্যদিকে চলবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষিকাজ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন কৃষিবিজ্ঞানী ও উন্নত কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব এবং আমার চিন্তা ও গবেষণার ফল তাদের সঙ্গে আদানপ্রদান করব। আধুনিক কৃষির সমস্ত উপকরণ যথা ট্রাক্টর, জলসেচের জন্য নলকূপ, কৃষি খামার, বীজ ও সার সংরক্ষণ করে রাখার স্থান ইত্যাদির জোগান দেব।
জানি জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছোনোর পথে আসবে নানা বাধা, কিন্তু সেইসব প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে লক্ষ্য সিদ্ধির জন্য আমি আমার অধ্যবসায় চালিয়ে যাব। প্রথমেই বৃহৎ কোনো লক্ষ্যমাত্রা না রেখে ছোটো ছোটো লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে কাজ চালিয়ে যাব এবং সফলতা আসার পর পরবর্তী অপেক্ষাকৃত বৃহৎ লক্ষ্যে এগিয়ে যাব। এইভাবে আমি আমার নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে আমার অভীষ্টে পৌঁছে যাব। সফলতা আসার পর পার্শ্ববর্তী কৃষকদের আধুনিক কৃষিকর্মে উৎসাহিত করব। সকলের প্রচেষ্টায় ভারতের দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের কারিগর হয়ে ওঠার চেষ্টা করব। তাই কবিগুরুর আপ্তবাক্য - ‘ফিরে চল মাটির টানে’ স্মরণে রেখে মানহীনা মাটির কাছে ফিরে গিয়ে ভারতবর্ষের প্রধান সমস্যা খাদ্যাভাব দূরীকরণে নিজেকে একজন অংশীদার করে তুলব।
ছাত্রজীবনে খেলাধুলা
প্রাচীনকাল থেকেই খেলাধুলার প্রচলন আছে। শরীর ও মনের সুস্থতার অন্যতম উৎস খেলাধুলা। খেলাধুলার মাধ্যমে শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালনের পাশাপাশি বিশুদ্ধ আনন্দও লাভ করা যায়। তাই খেলাধুলায় শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি ঘটে। নেতৃত্বশক্তি পারস্পরিক সৌহার্দ্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের মতো গুণের বিকাশ ঘটায়। একটি প্রবাদ আছে,—“All work and no play makes Jack a dull boy”। তাই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে ছাত্রজীবন থেকে খেলাধুলাকে বাদ দেওয়া যেমন অপ্রয়োজনীয়, তেমনই অবাঞ্ছিত একটি ধারণা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“যে শক্তি কর্মের উদ্যোগে আপনাকে সর্বদা প্রবাহিত করিতেছে সেই শক্তিই খেলার চাঞ্চল্যে আপনাকে তরঙ্গায়িত করিতেছে। শক্তির এই প্রাচুর্য্যকে বিজ্ঞের মতো অবজ্ঞা করতে পারি না। ইহাই মানুষের ঐশ্বর্যকে নব নব সৃষ্টির মধ্যে বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম দেহ, সুস্থ মানসিকতার জন্য খেলাধূলার প্রয়োজন।”
শিক্ষা ও খেলাধুলা এ দুয়ের মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত খেলার অভ্যাস দেহ ও মনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। শাস্ত্রে আছে—“ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ”—অর্থাৎ ছাত্রজীবনে অধ্যয়নই তপস্যা। আর সেই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করতে হলে দরকার সুস্থ শরীর, নির্মল মন। শুধুমাত্র পড়াশোনাই যথেষ্ট নয় তাতে একঘেয়েমি আসে।ছাত্র-জীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা সাফল্যের চাবিকাঠি, অন্যতম সহায়ক। তাই পৃথিবীর সবদেশেই বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থায় খেলাধুলাকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভারতের স্কুলগুলিতে দৌড়ঝাপ, ড্রিল, ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, হা-ডু-ডু, সাঁতার, যোগব্যায়াম, খো-খো প্রভৃতি খেলা অবশ্যকরণীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য; শুধু স্কুল নয়, অনেক উন্নত দেশে কলকারখানায় কাজ শুরু করার আগে ব্যায়ামচর্চা করা হয়ে থাকে। এর দ্বারা কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ছাত্রজীবনে চরিত্রগঠনের ক্ষেত্রে খেলাধুলা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা, পারস্পরিক বন্ধুত্ব, সহযোগিতা, দায়িত্ববোধ, নীতিবোধ, সততা ও নিয়মানুবর্তিতার মতো সদ্গুণগুলির বিকাশ ঘটে খেলাধুলার মাধ্যমে; যা বাস্তবজীবনে অপরিহার্য মানবীয় গুণ হিসেবে পরিচিত। এর দ্বারা ব্যক্তিজীবন ও সমাজ সমৃদ্ধ হয়। ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট' ভবিষ্যতে জীবনের উত্থানপতনগুলির সঙ্গে মানিয়ে চলার শিক্ষা দেয়। খেলাধুলার মাধ্যমে ক্ষুদ্র, একা, অসহায় অবস্থা কাটানো যায়। দলবদ্ধভাবে পরিকল্পনা রূপায়ণ, জাতীয়তাবোধ, নেতৃত্বদান, হারজিতের খেলায় শেষ পরিণতিতে বিচলিত না হওয়া, ভীরুতা ও দুর্বলতা দূর করে। খেলাধুলায় দেশের সাফল্য আমাদের গর্বিত করে। বর্তমান কর্মব্যস্ততার যুগে আমাদের শারীরিক পরিশ্রমের থেকে মানসিক পরিশ্রম বেশি হয়। এই দুটির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে না পারলে অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি রোগ দেখা দেবে; যা ছাত্রজীবনে অভিশাপস্বরূপ। তাই খেলাধুলার একান্ত প্রয়োজন রয়েছে।
খেলাধুলা ছাত্রজীবনে অপরিহার্য বলে শুধু খেলায় মনোযোগী হলে পড়াশোনায় ক্ষতির সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে। পড়া ও খেলা একে অপরের পরিপূরক তাই একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি নয়। অতিরিক্ত খেলাধুলায় শারীরিক ক্লান্তিও যেমন আসে তেমনই পড়াশোনায় আশানুরূপ সাফল্য অর্জন বাধা পায়। ছাত্রজীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। খেলাধুলাকে শিক্ষার অঙ্গ করে পাশাপাশি অনুশীলন আবশ্যিক করে তুলতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের বাইরে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের অঙ্গ হিসেবে খেলাধুলা আজ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে সুস্থ জীবন, সুস্থ সমাজ, সুস্থ দেশ গঠনের লক্ষ্যে। তাহলে কবির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বলতে পারব—“চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু, সাহস বিস্তত বক্ষপট।”
রক্তদান জীবনদান
সমাজে কেউই বাঁচতে পারে না একাকী। প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন হয় অন্যের সহযোগিতা। সেই কারণে আবহমানকাল থেকে সামাজিক অধিকার এবং বক্তব্যের জয়গাথা গীত হয়েছে – মৈত্রী, সহযোগিতা, পরহিত অথবা মানবকল্যাণের মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে। এই আদর্শপথ অর্থাৎ পারস্পরিক কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন শুধু কথার কথা মাত্র নয়, শুধু ভাবাবেগসর্বস্ব উক্তিমাত্র নয় – সাম্প্রতিককালে তারই বাস্তব উদাহরণ হল রক্তদান। এক মানবশরীর থেকে আর এক মানবশরীরে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন ও পদ্ধতি বহু পূর্ব থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনুভূত হয়েছিল।এ বিষয়ে ক্রমানুশীলন ও পরীক্ষানিরীক্ষার পরে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা কয়েকটি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন এবং তার প্রয়োগপদ্ধতিও আবিষ্কার করেছেন। সিদ্ধান্তগুলি হল : প্রথমত, মানবদেহের রক্তই অপর মানবদেহের রক্তে সঞ্চালিত করে কোনো ব্যক্তিকে নিরাময় করা যেতে পারে। দ্বিতীয়, নির্বিচারে এক মানুষের রক্তকে অপর মানুষের দেহে সঞ্চালিত করা চলে না। ভিয়েনার প্রখ্যাত চিকিৎসক ল্যান্ড স্টিনার ঘোষণা করেন যে, মানুষের রক্তকে চারটি গ্রুপে ফেলা যায় A, B, AB এবং O গ্রুপ। চিকিৎসাধীন ব্যক্তির রক্ত যে গ্রুপের, কেবল সেই গ্রুপের সুস্থ মানবরক্তই তার শরীরে সঞ্চালিত করা প্রয়োজন। রক্তদানের আগে Rh গ্রুপও দেখা হয়।
রক্তদানের অর্থ হল, অন্যজনের প্রাণদান। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা রক্তদানের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। উপযুক্ত বয়সে কোন সুস্থ ব্যক্তির শরীর থেকে এককালে ২৫০ সিসি রক্ত টেনে নিলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। যেটুকু রক্ত ঘাটতি হয় তাও সাধারণত সাতদিনের মধ্যে পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু শুধু রক্তদান করলেই হয় না, এই রক্তকে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থাও করা হয়। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে, চিকিৎসাকেন্দ্রে রক্তদান শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই শিবিরগুলিতে সুস্থ মানুষ রক্তদান করেন আবার সেই রক্তকে সংরক্ষিত করা হয়। এই উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট যে বোতল আছে, সেগুলি ৫০ সি সি অ্যাসিড সাইট্রেট ডেক্সট্রেজ সংবলিত। প্রতি সুস্থ মানবদেহ থেকে ২৫০ সি সি রক্ত নিয়ে ওই বোতলে রাখা হয়— একে বলে এক বোতল রক্ত।
রক্তদানের সুবিধাগুলি হল :-
* প্রতি চার মাস অন্তর রক্ত দিলে দেহে নতুন Blood Cell সৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
* দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
* নিয়মিত রক্তদানে হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
* স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে জানা যায় শরীরে রক্তবাহিত মারাত্মক রোগ যেমন –হেপাটাইটিস বি, এইডস, সিফিলিস ইত্যাদির জীবাণু বহন করছে কি না।
* স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানসিক প্রশান্তি আসে।
* রক্তদানের মাধ্যমে একটি জীবন বাঁচানো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেবার অন্তর্ভুক্ত।
সমাজের মানুষ যাতে রক্তদানে অনুপ্রাণিত হন, তার জন্য সরকারি ব্যবস্থায় স্থানে স্থানে আলোচনাচক্র ও স্লাইড প্রদর্শন ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সমাজে যত আহত এবং পীড়িত ব্যক্তির যত পরিমাণ রক্তের প্রয়োজন তার তুলনায় রক্ত সংগ্রহের পরিমাণ স্বল্প। সুতরাং প্রত্যেক সমাজসচেতন ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় রক্তদান অবশ্যকর্তব্য বলে উপলব্ধি করতে হবে। তাই ১৪ জুন ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস’ পালনের মর্যাদা পাবে। সাম্প্রতিককালে রক্তদাতার সংখ্যা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে,
বিশেষ করে মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রক্তদান করছেন অনেক মানুষ। সাধারণভাবে ১৮-৬০ বছর বয়স্ক যে কোনো নারী-পুরুষ রক্ত দিতে পারেন। রক্তদাতার দেহের ওজন হতে হবে অন্তত ৪৫ কিলোগ্রাম।
বিশেষ করে মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রক্তদান করছেন অনেক মানুষ। সাধারণভাবে ১৮-৬০ বছর বয়স্ক যে কোনো নারী-পুরুষ রক্ত দিতে পারেন। রক্তদাতার দেহের ওজন হতে হবে অন্তত ৪৫ কিলোগ্রাম।
রক্তদানের পূর্বে রক্তদাতাকে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে দেখে সিদ্ধান্ত নেন দাতা রক্ত দেওয়ার উপযুক্ত কি না।
সেবাব্রতে বিশ্বাসী মানবমানস ক্ষুধার্তকে অন্নদান এবং তৃষ্ণর্তকে জলদান পরম ধর্ম হিসেবে বিশ্বাস করে। তবে, সমাজ তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিচার করলে বোঝা যায় যিনি আজ রক্তদাতা, ভবিষ্যতে সে-ই হবে রক্তগ্রহীতা। এই দানব্রতে বিশ্বাসী বন্ধ করেছে বহু অকালমৃত্যুকে, বহু মৃত্যুপথযাত্রী সঞ্জীবিত হয়েছে অমৃতধারায় – তাই রক্তদান জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ পুণ্যকর্ম, যা অতুলনীয়। তাই ‘Red Cross' সোসাইটির কথাই স্মরণীয় - "The Blood you donate Gives Someone another
chance at life. One day that someone may be a close relative, a friend, a loved one - or even you."
বাংলা ভাষা
যে জাতির ভাষা যত সমৃদ্ধ সে দেশ ও জাতির সংস্কৃতি ও প্রাণসত্তা তত বেশি শক্তিশালী ও ঐতিহ্যমণ্ডিত এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। আর এই দিক দিয়ে বলা যায় বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ বলেই বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ও প্রাণসত্তা বিপুল শক্তির আধার। বাংলার মাটি তাই দুর্জয় ঘাঁটি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। অথচ এই বিপুল সম্ভাবনাময় বাংলা ভাষার পরিণতিবর্তমান সর্বগ্রাসী বিশ্বায়নের কবলে। ড. অশোক মিত্র মহাশয় বর্তমান ভুবনায়নের কুফল ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন ‘বাংলা ভাষা হয়তো একদিন ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।' তাঁর সেই আশঙ্কা হয়তো অচিরেই ফলবে এমন কথা না বলারও কারণ নেই। যখন দেখা যায়। ভাষা চর্চার প্রতি চরম অনাহা, বাংলা ভাষামিশ্রিত নতুন ইং-বাং ভাষা চালুর চেষ্টা আবার বাংরেজ সম্প্রদায় হিসেবে এক জাতির উত্থান।
সকলের জানা, ভাষা নদীসদৃশ । বহমানতাই তার বৈশিষ্ট্য। নদীর স্রোতে ভেসে যায় খড়কুটো, আবর্জনা, তেমনি ভাষার স্রোতেও ভেসে যায় নানা আবর্জনারূপ যুগযুগান্তব্যাপী সময়ের ক্লেদাক্ত চিহ্ন। ভাষা রূপান্তরিত হয়, সমৃদ্ধ হয় গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষার সৃষ্টি মোটেই কাকতালীয় নয়। এর মূলে আছে বাংলার প্রাণপ্রাচুর্য ও বঙ্গপ্রকৃতির অপার দাক্ষিণ্য। বাংলা ভাষার সঙ্গে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর নিবিড় যোগসূত্র থাকলেও বাংলা ভাষা তার নিজস্বতা ও প্রাণসত্তা নিয়ে বৃহত্তর নানা উপভাষার সঙ্গে আত্মিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।
বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন রয়েছে চর্যাপদে। রচনাকাল দশম শতাব্দী এর পরই বাংলা ভাষা নানা রূপে সমৃদ্ধ হতে আদি-মধ্য যুগ অতিক্রম করে আধুনিক যুগে পদার্পণ করেছে। বাংলা ভাষার হাত ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণ, বাংলা ভাষায় গদ্য চর্চার সূচনা। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র বাংলা ভাষায় সারস্বত চর্চায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা লাভের পর বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বকবির হাতে বাংলা ভাষা তার প্রাণচাঞ্চল্যকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিল। এই বাংলা
ভাষা বিশ্বের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দিতে প্রতিবেশী দেশে হল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে। ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তে রাঙানো একটি দিন। বাংলা ভাষার অফুরন্ত সম্ভাবনা উপলব্ধি করেই প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশের কয়েকজন যুবক – রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আসামের শিলচরে বাংলা ভাষা মর্যাদা তথা স্বীকৃতির দাবিতে বরাক উপত্যকা রক্তে রঙিন হয়ে উঠেছিল। এই দুই ভাষা আন্দোলন দুই দেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে আলোড়িত করেছে, উজ্জীবিত করেছে। বাংলা ভাষা আন্দোলন বিশ্বের দরবারে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি রাষ্ট্রসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এ বড়ো গৌরবের, আনন্দের। অথচ এই ভাষার প্রতি দিন দিন অবহেলা, অমর্যাদা নিঃসন্দেহে বড়ো বেদনার, যন্ত্রণার। বাংলা ভাষা – বাঙালির মাতৃভাষা। মাতৃভাষাকে অমর্যাদা করা
মানে জন্মদাত্রীকে অবমাননা করা।
এই বোধ জাগ্রত করার প্রয়োজন আছে। তা না হলে ইং-বাং ভাষার বাড়বাড়ন্ত হবে, বাংরেজদের খবরদারি সর্বনাশ বাড়বে। শিকড়ের সংস্কৃতি ধ্বংস হবে। বাঙালি জাতির সমূহ সাধিত হবে। বাঙালির বিবেক আত্মাকে জাগ্রত করার উদ্যোগ সর্বতো ভাবে গ্রহণ করতে হবে। বাংলা ভাষায় সকলে যেন একসুরে গাইতে পারে “মোদের গরব, মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা”।
No comments
Hi Welcome ....