১. আধুনিক ভারতের পরিবেশ ইতিহাস রচনায় কয়েকটি সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মূল্যায়ন। ❐ ভূমিকা : জনস্বাস্থ্য হল সমাজ, সংগঠন, সরকারি ...
১. আধুনিক ভারতের পরিবেশ ইতিহাস রচনায় কয়েকটি সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ অবদানের মূল্যায়ন।
❐ ভূমিকা : জনস্বাস্থ্য হল সমাজ, সংগঠন, সরকারি এবং বেরকারি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মিলিত চেষ্টা, তথ্যাভিজ্ঞ পছন্দের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ, জীবনকাল বৃদ্ধি, মানব স্বাস্থ্য উন্নয়নের বিজ্ঞান ও কলা। জনগণের স্বাস্থ্য ও তাঁর ঝুঁকির দিকগুলি বিশ্লেষণ করা জনস্বাস্থ্যের মূল বিষয়। ব্রিটিশ ভারতে জনস্বাস্থ্য নীতি প্রবর্তনের পিছনে যে প্রদান উপাদানগুলি কাজ করেছিল তা হল―
- প্রথমত : ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক আমলের গোড়ার দিকে এবং পরবর্তীকালে রোগব্যাধি, মহামারি ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নানারকম ধরণা, চিন্তাভাবনা রীতিনীতির উদ্ভব, প্রবর্তন বিস্তার ঘটেছিল সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলিকে কেন্দ্র করে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তথা কোম্পানির শাসন বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা সৃষ্টির অন্যতম উপাদান ছিল রোগব্যাধি ও মহামারির আক্রমনে সৈন্যবাহিনীর শারীরিক অপুটতা। তাই নিজ স্বার্থে কোম্পানি জনস্বাস্থ্য নীতি প্রবর্তনে আগ্রহী হয়।
- দ্বিতীয়ত : ইউরোপীয়দের পক্ষে ভারতীয় উপমহাদেরে আবহাওার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়ানো সম্ভব ছিল না। তাই অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যকর আবহাওয়াযুক্ত অঞ্চল চিহ্নিত করা খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পার্বত্য এলাকা ও অনান্য স্বাস্থ্যকর অঞ্চলের বিষয় লেখা শাসন বিভাগীয় প্রতিবেদরে অঙ্গ হয়ে উঠেছিল।
- তৃতীয়ত : 1859 খ্রিঃ নিযুক্ত Royal Commission যার নিয়োগ করা হয়েছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য এবং যেটি সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিধিনিয়ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যতেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল।
- চতুর্থত : SirJoseph Fayrer চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিলেন বলা যায়। ভারতবর্ষের ব্যধির পরিবেশের বৈশিষ্ট্য এবং উষ্ণ অঞ্চলের অসুখগুলির বিশেষ ব্যবহারের উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন-তার নির্দেশিকা জনস্বাস্থ নীতি প্রবর্তনে সাহায্য করেছিল।
- পঞ্চমত : উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দেখা গিয়েছিল যে উষ্ণ অঞ্চলের আবহাওয়ার সঙ্গে ইউরোপীয়দের খাপ খাওয়ানোর সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছুটা ইতিবাচক যে মনোভাব ছিল ইউরোপীয়দের উচ্চ মৃত্যুহারের ধারাবাহিকতার ফলে তা ধীরে ধীরে ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার সম্ভাবনার বিষয়ে নিরাপত্তাজনক মনোভাবে পরিণত হয়েছিল। একই সঙ্গে ভারতীয়দের চিকিৎসাশাস্ত্র ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ থেকে মূল্যবান কোন শিক্ষাগ্রহণ যে সম্ভব নয় এই ধারণা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল—তাই একটি সুনির্দিষ্ট জনস্বাস্থ্য নীতির প্রয়োজন ছিল।
◉ জনস্বাস্থ্যনীতির মূল বৈশিষ্ট্য: ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে জনস্বাস্থ্য নীতির খুব সামান্য সূত্রপাত হয়েছিল বলা চলে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ডিসপেনসারি ও হাসপাতাল স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলি বসন্তরোগ ও অন্যান্য ব্যধির প্রতিষেধক টিকা প্রদানের কেন্দ্রস্থল ছিল। 1880 খ্রিস্টাব্দের compulsory Vaccination Act প্রাদেশিক সরকারগুলিকে কিছু শহর ও ক্যান্টেনমেন্ট এলাকাতে 6 মাসের চেয়ে বড়ো শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক টিকাপ্রদান চালু করেছিল। তবে অনেক স্থানে এই আইন প্রবর্তন করা যায়নি। স্বাস্থ্যবিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে সরকারের ভূমিকা প্রধানত সীমিত ছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্যচর্চা বিষয়ক বইপত্র বিতরনের মধ্য দিয়ে। I.M.cuningham এর Sanitary Primer বইটি বহু ভারতীয় ভাষায় অনুদিত হয়েছিল এবং ভারতীয় বিদ্যালয়গুলির নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক ছিল।
উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে কিছুটা শিল্পায়ন আরম্ভ হলে শিল্পাঞ্চলগুলিকে কেন্দ্র করে জনবসতি বাড়তে তাকে এবং রেললাইন, সড়ক, জলাধার, বাঁধ নির্মাণের ফলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভীষণ অবনতি ঘটতে থাকে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কাজকর্মের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে চলে যায়। 1920 খ্রিঃ জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য একটি পর্ণাঙ্গ জনস্বাস্থ্য বিভাগ খোলা হয়েছিল। তবে পশ্চিমি চিকিৎসাবিজ্ঞান শহরের দরিদ্র ও গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
২. বিধবা বিবাহ আন্দোলনের বিস্তৃত বর্ণনা দিন।
❐ ভূমিকা : বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার মূলক কর্মসূচির মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হল হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ সম্বন্ধে আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত আন্দোলন। বিদ্যাসাগরের আগে ঊনবিংশ শতকে অনেকেই বিধবা বিবাহ বিবাহকে সমর্থন করেন ও তা প্রচলিত করার চেষ্টা করেন। এঁদের মধ্যে কালীকৃষ্ণ মিত্র, নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যয় প্রমুখের নাম করা যায়। কিন্তু এঁদের চেষ্টা সফল হয়নি। ব্রহ্মসমাজ বিধবা বিবাহের সমর্থনে জনমত তৈরি করে। ইংরাজী শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই বিধবা বিবাহ সমর্থন করেন। ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি ’ ও ‘ক্যালকাটা প্রেস ক্লাব’ বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে প্রচার চালায়।
◉ বিদ্যাসাগরের ভূমিকা : রামমোহন যেমন প্রাচীন শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে দেখান সতীদাহ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয় ঠিক তেমনি বিদ্যাসাগর পারশর সংহিতা, অগ্নিপুরান, নারদস্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থ ও মুনি ঋষিদের শ্লোক উল্লেখপূর্বক প্রমান করার চেষ্টা করেন বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। পরাশর সংহিতায় বলা হয়েছে— “স্বামী নষ্ট, মৃত, দীর্ঘদিন বিদেশবাসী, ক্লীব এবং পতিত হলে এই পাঁচপ্রকার বিপদে স্ত্রী অন্যপতি গ্রহণ করতে পারবে।” বিধবা বিবাহের সমর্থনে প্রথমে তত্ত্ববোধনী পত্রিকায় পরপর কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন এবং ১৮৫৫ খ্রিঃ "বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করলে হিন্দু সমাজরূপ বিস্তীর্ণ স্থির হ্রদ সহসা মহা আন্দোলিত সমুদ্রের ন্যায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তর্ক-বিতর্কের ভয়ঙ্কর তরঙ্গ তুলতে থাকে।
◉ বিধবা বিবাহ আইন : ১৮৫৫ খ্রিঃ বিদ্যাসাগর ৯৮৭. জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের
কাছে পেশ করেন। অক্ষয় কুমার দত্ত, জয়কৃষ্ণ মুখার্জী প্রমুখ তৎকালীন বাংলার বহু জ্ঞানী গুণী মানুষজন এতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বধীন রক্ষণশীল গোষ্ঠী ৩৬,৭৬৩ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সহ পাল্টা আবেদনপত্র পাঠান। হিন্দু রক্ষণশীল নেতাদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বিধবা বিবাহ আইন সিদ্ধ হয়। ১৮৫৬ খ্রিঃ XV (১৫নং) রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহ বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়। এই বিবাহজাত সন্তান পিতার সম্পত্তিতে বৈধ উত্তরাধিকারী হতেপারবে বলে বলা হয়।
◉ বিধবা বিবাহ দানের চেষ্টা : বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে ১৮৫৫ খ্রিঃ ৭ই ডিসেম্বর প্রথম বিধবা বিবাহ করেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং তাঁর পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সাথে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। ১৮৫৬-১৮৫৭ খ্রিঃ মোট ৬০টি বিধবা বিবাহের ব্যবস্থা করার জন্য ৮২ হাজার টাকা ব্যয় করে বিদ্যাসাগর ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু সাধারণভাবে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৮৫৬ খ্রিঃ আইন একটি কাগজী আইনে পরিণত হয় বিধবা বিবাহ শুধুমাত্র শিক্ষিত উচ্চবংশীদের নধোই নয়, ক্রমশ অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের কাছেও বিরল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। লোকাচারের সংস্কার সাধন করা প্রকৃতপক্ষে দুঃসাধ্য ছিল।
◉ বিধবা বিবাহ আন্দোলনের প্রসার : বিদ্যাসাগরের পুনর্বিবাহ আন্দোলন ১৮৬০ সাল থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং সংস্কারবাদী ও তাদের বিরোধীদের মধ্যে বিতর্ক ক্রমশ তীক্ষ্ণতর এবং তিক্ত হয়ে উঠে। ১৮৬৬ খ্রিঃ বিষ্ণুশাস্ত্রী পন্ডিত বিধবা বিবাহকে উৎসাহিত করার জন্য একটি সমিতি গঠন করেন, পক্ষান্তরে বিরোধীরা একটি প্রতিদ্বন্দ্বি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে তবে পন্ডিতা রমাবাঈ, বীরযালিঙ্গস পান্ডুলা (Veerasalingam Pantulu), বিষ্ণুশাস্ত্রী প্রমুখের উদ্যোগে বিধবা বিবাহের সমর্থনে আন্দোলন শুরু হয়। তবে পুনর্বিবাহের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত
উপসংহার : বিধবা বিবাহের অবসান হয় খুবই নৈরাশ্যজনকভাবে ঊনবিংশ শতকের শেষ লগ্নে মাত্র ৩৮ জন বিধবা রমনীর বিবাহ হয় এবং সেই দম্পতিগণ প্রবল সামাজিক চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। “বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রথম সৎকর্ম। ইহা অপেক্ষা অধিক কোন সৎকর্ম করিতে পারিব, তাহার কোন সম্ভাবনা নাই।” ইতিহাসবিদ বিনয় ঘোষ এর মতে, উনিশ শতকে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন।
৩. ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে ভারতবর্ষে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের কয়েকজন অগ্রগণ্য মহিলা সংগঠকের সম্পর্কে
❐ ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কার আন্দোলন প্রধানতঃ যে বিশেষ বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছিল, তা হল নারীজাতির অবস্থার উন্নয়ন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশক থেকে নারীমানসে রাজনৈতিক ধারণা অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছিল। এই শতাব্দী নারী ও পুরুষের সংস্কার সম্পর্কিত উৎসাহ, নারী রাজনৈতিকরণ এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীকে সম্ভব করে তুলেছিল। মিশনারীবৃন্দ, মানবতাবাদীগণ ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা সংস্কারবর্গ ও বিভিন্ন সভা-সমিতির মাধ্যমে সভ্যতা ও শিক্ষার বিকাশ ভারতীয় নারীকে একটি সম্মানজনক শ্রদ্ধার আসন লাভ করতে সাহায্য করেছিল, যা পরবর্তীকালে নারীর রাজনৈতিক মুক্তির অধিকার তথা ‘ভোট দান ও সংসদে অংশগ্রহণের অধিকারে পর্যবসিত হয়েছিল।
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম নারীর জন্য একটি রাজনৈতিক মঞ্চ তুলে ধরেছিল। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী এবং জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি ছিলেন মহিলাদের মধ্যে প্রথম যিনি কংগ্রেস মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দেন এবং সম্ভবতঃ এটি ছিল এক নবযুগের সূচনা। তখন থেকে মহিলারা দেশের রাজনৈতিক কাজকর্ম তথা নারী আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন বিংশ শতাব্দীর সূচনায় তা খুব একটা সংগঠিত না হলেও পরবর্তীকালে তা ভোটাধিকার আন্দোলনের দাবীতে পর্যবসিত হয়ে যায়।
১৯১৭ খ্রিঃ একটি নারী প্রতিনিধি দল ভারত সচিব মন্টেগুর সঙ্গে দেখা করে ‘নারীর ভোটাধিকারের দাবী জানান। এই দলে ছিলেন ১৮ জন ভারতীয় ও ইউরোপীয় মহিলা এবং নেতৃত্ব দেন সরজিনী নাইডু। তাদের দাবী ছিল নতুন সংবিধানে পুরুষদের মতো নারীদেরও ভোটাধিকার দান করতে হবে। মহিলাদের সামাজিক সমস্যাকে দূরীভূত করার জন্যই তারা নারীর ভোটাধিকারের উপর জোর দিয়েছিলেন। মাদ্রাজের Women's Indian Association, বোম্বাই Women Graduaes Union, ভারত স্ত্রীমন্ডল, ১৯১৭ খ্রিঃ ডিসেম্বরে জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে, প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিগুলিতে, ইন্ডিয়ান হোমরুল লীগ, মুসলিম লীগ সর্বত্রই নারীর ভোটাধিকারের দাবীতে প্রস্তাব পাশ করা হয়েছিল। এইভাবে ভারতে নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল।
মন্টেগু বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দিলেও ১৯১৯ খ্রিঃ মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার নারীদের ভোটাধিকার নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, লর্ড সভা ও কমন সভার যৌথ কমিটি নারীর ভোটাধিকারকে সমর্থন করেননি। সংস্কার আইনে শুধু বলা হয়েছিল প্রাদেশিক আইন সভাগুলিতে বিষটি নির্ধারিত হবে। এরপর ১৯১৯ খ্রিঃ সরোজিনী নাইডু, অ্যানি বেসান্তের নেতৃত্বে নারীদের একটি প্রতিনিধি দল জয়েন্ট পালমেন্টারী কমিটির সামনে তাদের অধিকার নিয়ে বক্তব্য পেশের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান।
১৯২৭খিঃ সাইমন কমিশনের কাছে নারীর সমানাধিকার ও প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার দাবী করে। মহিলাদের একটি গোষ্ঠী সাইমন কমিশনে মহিলাদের স্বার্থরক্ষার জন্য যুক্তি প্রদর্শন করেছিল। প্রথম গোলটেবিল বৈঠক সরকার রাধাভাই সুজারায়ণ ও বেগম শাহ নওয়াজের তোলা মহিলা উন্নয়ন বিষয়টির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন। ১৯৩০ খ্রিঃ সরোজিনী নাইডু বলেন নারীর জন্য বিশেষ নিয়মের প্রয়োজন নেই। তিনি নারী ভোটারদের অনুপাত বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব দেন। সরোজিনী নাইডুর নেতৃত্বে মহিলাদের একটি প্রতিনিধি দল দ্বিতীয় গোল বৈঠকে সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের দাবী জানায়। আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালে নারীর রাজনৈতিক বিষয়টি আরও জোরদার হয়ে ওঠে।
উপসংহার : ১৯৩৫ খ্রিঃ ভারত শাসন আইনে আরো বেশি সংখ্যক মহিলাকে ভোটাধিকারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ফলে ১৯৩৭ খ্রিঃ নির্বাচনের পর বেশ কিছু মহিলা আইন প্রণেতা বিভিন্ন প্রাদেশিক আইন সভায় নির্বাচিত হন (৫৬ জন মহিলা)। আসন সংরক্ষণের বিষয়টি তাদের খুশি করতে পারেনি তারা সার্বজনীন ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৪৭ খ্রিঃ স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তাদের এই আশা পূর্ণ হয়নি।
৪. সমাজ ও শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনে প্রার্থনা সমাজের ভূমিকা লেখো।
❐ ভূমিকা : ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজসংস্কার আন্দোলন বাংলার পাশাপাশি ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও বিস্তৃত হয়েছিল। পাশ্চাত্যের দর্শন এবং যুক্তিবাদের প্রভাবে ভারতীয় সমাজের কুসংস্কারগুলি দূর করার প্রয়াস শুরু হয়। এক্ষেত্রে যে সকল মনীষী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ। ১৮৬৭ খ্রিঃ মহারাষ্ট্রে তিনি প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ―
◉ সমাজসংস্কার আন্দোলনে প্রার্থনা সমাজের অবদান : হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা এবং পুরোহিততন্ত্রের অবসান ঘটানোর জন্য প্রার্থনা সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রার্থনা সমাজের পক্ষ থেকে সমাজ ও শিক্ষাসংস্কারে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে গৃহীত উদ্যোগগুলি হল—
১) প্রার্থনা সমাজের সদস্যরা ছিলেন একেশ্বরবাদের সমর্থক। তবে এই প্রতিষ্ঠানটি ধর্ম অপেক্ষা সমাজসংস্কারেই অধিক গুরুত্ব প্রদান করে। রানাডের মতে, ঐতিহ্য এবং বাস্তবকে স্বীকার না করে যুক্তির ওপর ভিত্তি করে সংস্কারের কাজ করা সম্ভব নয়।
২) প্রার্থনা সমাজ সামাজিক অস্পৃশ্যতা, পদাপ্রথা, জাতিভেদ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদির বিরোধিতা করে। শুধু তাই নয়, এই সকল কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচারর চালিয়েও সমাজকে সচেতন করারও উদ্যোগ নেয়।
৩) অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ এবং নারী স্বাধীনতাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সমাজের গৃহীত পদক্ষেপগুলি উল্লেখের দাবি রাখে। ১৮৬১ খ্রিঃ রানাডের উদ্যোগে ‘বিধবাবিবাহ সমিতি’ গঠিত হয়।
৪) সামাজিক উন্ননের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সমাজের সদস্যরা শিশু ও দুঃস্থদের কল্যাণ, অনাথ আশ্রম, চিকিৎসালয় নির্মাণের কর্মসূচি গ্রহণ করেন৷
৫) ১৮৮৭ খ্রিঃ সামাজিক সমস্যা ও তার প্রতিকারের উপায় নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে রানাডে “ভারতীয় জাতীয় সমাজ সম্মেলন এর আহ্বান জানান।
◉ শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনে প্রার্থনা সমাজের অবদান : শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রেও প্রার্থনা সমাজ তথা রানাডের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য প্রার্থনা সমাজের গৃহীত উদ্যোগগুলি ছিল নিম্নরূপ—
১) ১৮৮৪ খ্রিঃ রানাডের উদ্যোগে দাক্ষিণাত্য শিক্ষা সমাজ বা ডেকান এডুকেশন সোসাইটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সরকারি সাহায্য না দিয়ে পুনার ‘ফারগুসন কলেজ’-এবং সাংলির ‘উইলিংডন কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে প্রার্থনা সমাজের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
২) রানাডে লর্ড মেকলের ফিলট্রেশন নীতির বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন শিক্ষাকে সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
৩) পঠনপাঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে রানাডের উদ্যোগে মারাঠি ভাষায় ইতিহাস, বিজ্ঞান, জীবনীমূলক গ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়। শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে তিনি শিক্ষিত যুবসম্প্রদায় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
8) প্রার্থনা সমাজের উদ্যোগে মহারাষ্ট্রে বেশকিছু নৈশ বিদ্যালয় এবং গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে সমাজের বহুমানুষ উপকৃত হয়।
উপসংহার : যুগধর্মের ভিত্তিতে বলা যায় যে, রানাডে সমাজসংস্কার এবং শিক্ষাসংস্কারের ক্ষেত্রে আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নারীদের মধ্যে সচেতনতার বিস্তার ও নারীশিক্ষার উন্নতিতেও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু প্রার্থনা সমাজের উদ্দ্যোগে শিক্ষা সকল শ্রেণির জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। তবে এ কথা সত্য যে, মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ ও অন্ধ্রের কিছু অঞ্চলে এই প্রতিষ্ঠানটি অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
৫. উনিশ শতকে বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার যে সব বই ও পত্রিকা প্রকাশিত হতো তার বিবরণ দাও?
❐ ভূমিকা : উনিশ শতকে মানুষকে বিজ্ঞান সচেতন করার উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক বাংলা বই অনুবাদ ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ সম্পর্কে প্রথমেই উইলিয়াম কেরী ও শ্রীরামপুর মিশনারিদের কথা বলা যায়। বিনয়কুমার রায় মনে করেন, ফেলিক্স কেরীর লেখা, ‘বিদ্যাহরাবলী’ হল বাংলা ভাষায় লেখা বিজ্ঞানের বই।
◉ কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি : ১৮১৮ খ্রিঃ ডেভিড হেয়ার কলকাতায় স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্যছিল পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় গ্রন্থগুলি বাংলা ভাষায় অনুবাদ ও ছাত্রদের মধ্যে সুলভমূল্যে বিতরণ করা।
◉ Society For Translating European Science : ১৮১৮ খ্রিঃ উইলসনের সভাপতিত্বে দেশীয় ভাষায় বিজ্ঞান অনুবাদের জন্য এই সমিতি গঠন করা হয়। এই সমিতির উদ্যোগে প্রকাশিত বিজ্ঞান সেবধি’ পত্রিকায় ভারতের ভূগোল, উদস্থিতিবিদ্যা যন্ত্রবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই সমিতি মনে করত বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান কিছু ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের প্রত্যেকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।
◉ পদার্থবিদ্যার উপর প্রকাশিত গ্রন্থ : পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার দত্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘পদার্থবিদ্যা’ বইটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল এছাড়া পদাথ্যবিদার ওপর যে সব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-(১) প্রভাতচন্দ্ৰ সেনের ‘পদার্থত্ত্ব কৌমুদী' (২) ঈশান চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জড় বিজ্ঞান'। (৩) মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ‘পদার্থ দর্শনের প্রবেশিকা’ (৪) যোগেশচন্দ্র রায়ের ‘সরল পদার্থ বিজ্ঞান'। (৫) রজনীকান্ত গুপ্তের ‘পদার্থবিদ্যা প্রবেশ’। (৫) অমৃত কৃষ্ণ বসুর ‘সরল ভৌতিক তত্ত্ব’ এবং ১৮৮১ খ্রিঃ প্রকাশিত শ্যামাপ্রসন্ন রায়ের ‘দৃষ্টিবিজ্ঞান’ বইটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
◉ জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ : ১৮১৯ খ্রিঃ শ্রীরামপুর থেকে ‘জ্যোতিষ ও গোলাধ্যায়’ বইখানি প্রকাশিত হয়।
তাছাড়া গোপীমোহন ঘোষের ‘জ্যোতিবিবরন’। অম্বিকাচরন ব্যানার্জীর ‘গননা পুস্তক'। এছাড়া রসিকমোহন চ্যাটার্জীর ‘বিভূতিবিদ্যা’ এই সময় মূল সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
◉ প্রাণীতত্ত্বের গ্রন্থ : প্রাণীতত্ত্ব সম্পর্কে প্রথম উল্লেখযোগ্য বই হল যমনের ‘পশ্বাবলী’। ১৮১৯ খ্রিঃ মধুসূদন মুখোপাধ্যায়
অনুবাদ গ্রন্থ ‘জীবনরহস্য’ ছিল খুবই জনপ্রিয়। এই সময় সাতকড়ি দত্ত প্রকাশ করেন ‘প্রাণীবৃতান্ত’। জ্ঞানেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরীর ‘জীবতত্ত্ব’, পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটিতে ‘মনীতত্ত্ব’, ‘গোতত্ত্ব’, ‘সারমেয় তত্ত্ব’, ‘অশ্বতত্ত্ব’ এই পাঁচটি বিষয় আলোচিত হয়।
◉ শারীর তত্ত্বের গ্রন্থ : শারীর বিদ্যা বিষয়ে বইগুলির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়, ফেলিক্স কেরির ব্যবচ্ছেদ বিদ্যা।
এছাড়া রাজকৃষ্ণ রায়চৌধুরির ‘নরদেহ নির্ণয়’ রাধানাথ বসাকের ‘শরীর তত্ত্বসার’। ডঃ মহেন্দ্রনাথ ঘোষের ‘ফিজিওয়োলজি' গ্রন্থটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
◉ গণিতের গ্রন্থ : শ্রীরামপুর মিশনারীরা প্রথম পাঠশালার জন্য গণিতের বই প্রকাশ করেন তারপর প্রকাশিত উমাচরনের
‘গণিতসার’। প্রসন্নকুমার আধিকারিক পাটিগণিত প্রকাশিত হয়। এছাড়া যদুনাথ ভট্টাচার্যের ‘বীজগণিত’ নবীনচন্দ্র দত্তের ‘ব্যবহারিক জ্যামিতি গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
◉ পত্রিকা : বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ খ্রিঃ শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত ‘দিগদর্শন’ পত্রিকার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকায় পদার্থবিদ্যা বিষয়ক অনেক প্রবন্ধ ছাপা হয়। এছাড়া বিজ্ঞানদর্পন ও বিজ্ঞানসার পত্রিকার নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার : উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অপেক্ষা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ অনেক বেশি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়ার্ধের লেখা গ্রন্থগুলির ভাষা ছিল অনেক সহজ ও প্রাঞ্জল। তবে চিকিৎসার গ্রন্থ ছাড়া বিজ্ঞানের অন্যান্য বইয়ের মান খুব উঁচু ছিল না।
৬. ঔপনিবেশিক বাংলায় ডাকাতির সামাজিক উৎস কি ছিল ?
❐ ভূমিকা : ভারতীয় গ্রামজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল ডাকাতির মত এক বিশেষ ধরনের অপরাধ। ডাকাতি কথাটি এসেছে হিন্দি ডাকনা থেকে। যার অর্থ লুটপাট। এটি দলবদ্ধভাবে দস্যুবৃত্তির প্রক্রিয়াকেও বোঝায়। হিন্দিতে ডাকাইত বলতে বোঝায় সশস্ত্র দলের দস্যুবৃত্তি। ডাকাইত কথাটি এসেছে ডাকনা থেকে যা দস্যুতার সমার্থক হিসাবে ব্যবহৃত হত।
◉ মন্বন্তরের প্রভাব : বাংলায় ১৭৭০-এর দুর্ভিক্ষ বা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটা বড় আঘাত ছিল। এরপরেই গ্রামাঞ্চলে ডাকাতি বা হিংসাত্মক ঘটনা নাটকীয় মাত্রায় বেড়ে যায়। এমনকি নীরিহ চাষিরাও এই পরিস্থিতিতে ডাকাতির পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছিল। কর্ণওয়ালিশ প্রশাসনিক সংস্কার এবং ঔপনিবেশিক পুলিশ বাহিনী গঠন করা সত্ত্বেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।
◉ জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতা : সমসাময়িক সরকারি দলিল থেকে জানা যায় বেশিরভাগ ডাকাতই ছিল স্থানীয় জমিদার ও
নীলকরদের বেতনভুক্ত লাঠিয়াল। যাদের কাজ ছিল জমিদারদের সুরক্ষা দেওয়া। ছোট তালুকদার ও জমিদাররাই ছিল এদের পৃষ্ঠপোষক।
◉ লাঠিয়ালদের কর্মচ্যুতি : সুন্দরবনের নদী নালায় বাখরগঞ্জ জেলার জলপথে যারা ডাকাতি করত তারা সকলেই ছিল লাঠিয়াল। অধিকাংশ লাঠিয়াল কাজ না পেয়ে ডাকাতিতে ভিড়েছিল। বিভিন্ন ডাকাত দলের সর্দাররা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে জমিদারদের সন্তুষ্ট রাখতে চাইত। লুঠপাটের পর তারা জমিদারদের মহলেই আশ্রয় নিত।
◉ গ্রামীণ আধিপত্য বজায় রাখা : জমিদাররা রায়তদের উচ্ছেদ করতে বা রায়তদের ওপর আধিপত্য কায়েম রাখতে ডাকাতদের সাহায্য নিত। রানাঘাটের পাল চৌধুরি পরিবার,হুগুলির গোকুলকৃষ্ণ ঘোষ, বগুড়ার বিশ্বনাথ সর্দার, বর্ধমানের যুগেশ্বর সর্দার ডাকাতদের আশ্রয়দাতা তো ছিলই উপরন্তু ডাকাতিতেও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।
◉ প্রশাসনিক প্রতিবেদন : প্রশাসনিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে কলকাতা ও তার আশেপাশে অঞ্চলের জমিদাররা পয়সা দিয়ে লেঠেল রাখে, হাট-বাজারে যেসব লোকজন আসত তাদের থেকে জমিদারদের প্রাপ্য উশুল করতে এইসব মাইনে করা লেঠেলদের কাজে লাগানো হতো। এই লেঠেলবাহিনীর প্রায়শই লেঠেল বাহিনী বানিয়ে ডাকাতি করত। টাকির জমিদারদের কাছে আশ্রয় পেয়েছিল নেপাল ডোম, গোপাল ডোম, শিকারি সর্দারের মত দুধর্ষ ডাকাত।
৭. বাংলা থিয়েটারের অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফির অবদান কি ছিল?
❐ ভূমিকা : ১৮৯৩ খ্রিঃ অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফির নতুন গড়ে ওঠা মিনার্ভা থিয়েটারে যোগদান করেন। তখন গিরিশিচন্দ্র ঘোষ মিনার্ভা থিয়েটারে ম্যাকবেথ প্রযোজনার প্রস্তুতি মগ্ন, অর্ধেন্দু শেখর চারটি বিভিন্ন ভূমিকায় নির্বাচিত হলেন যথা ‘উইচ’, ওল্ডম্যান, পোর্টার এবং ফিজিসিয়ান এই ছোট পাটগুলিতে তিনি অসাধারণ ভালো অভিনয় করেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।
◉ নাট্য শিক্ষক হিসাবে খ্যাতিলাভ : বেশ কয়েকটি প্রযোজনায় অংশগ্রহণ করার পর অর্ধেন্দুশেখর মিনার্ভা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে অমরেনড থিয়েটার লিজে নিয়ে চালানোর চেষ্টা করলেও তা দেউলিয়া হয়ে যায়। কিন্তু যে দেড়বছর তিনি থিয়েটার পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন তার মধ্যে নাট্যশিক্ষক হিসাবে অভিনেতাদের ওপর অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করলেন। তিনি নিজের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি ভুলে গিয়ে – সময় অসময় ভুলে গিয়ে, নতুন শিক্ষার্থীদের অভিনয় শিক্ষা দিতেন এবং তাদের অভিনয় শিল্পের আশ্চর্য কলাকৌশল সম্পর্কে আগ্রহী করে তুললেন।
◉ পক্ষপাতিত্বহীন শিক্ষাদান : অর্ধেন্দু শেখরের পক্ষপাতিত্ব না করে শিক্ষাদানের অভ্যাস তাকে তার সহকর্মীদের কাছে আদরনীয় করে তুলেছিল। তাঁর স্বার্থহীন কাজ, তাঁর বুদ্ধির দীপ্তি, রসিকতার ঔজ্জ্বল্য, জাগতিক সুখ সুবিধার প্রতি নিষ্পৃহতা—এই সবই তাকে বাংলা থিয়েটারে কিংবদন্তী করে রেখেছে।
◉ অভিনয় দক্ষতা : কেবলমাত্র হাস্যরসাত্মক অভিনয়ে নয়, তৎকালিন থিয়েটারের রীতি অনুযায়ী ভাঁড়ামির অভিব্যক্তিতে তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। এছাড়া ‘রাজা বসন্ত রায়’ নাটকে প্রতাপাদিত্য, ‘প্রফুল্ল’ নাটকে যোগশের মত গম্ভীর চরিত্রেও তাঁর অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে।
◉ অ্যামেয়ার থিয়েটারের বিকাশ : মিনার্ভা থিয়েটার ছাড়ার পর তিনি অ্যামেচার থিয়েটার দলে নাট্য শিক্ষাদানের কাজ করেন। ছোট ছোট দলগুলিত আলোচনা অভিনয়ে অংশগ্রহণ এবং তাদের অভিনয়ের মান বৃদ্ধির জন্য প্রচুর সময় ব্যয় করতেন। তাই এই ছোট ছোট দলগুলি বাংলা দর্শকদের থিয়েটার দেখার অভ্যাস গড়ে দিয়েছিল।
উপসংহার : মদ্যপানের ফলে নিদ্রাহীনতা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি না মানার ফলে অচিরেই তার শরীর ভেঙে পড়ে। তাও প্রফুল্ল নাটক যোগেশ এবং দীনবন্ধু মিত্রের নবীন তপস্বিনীর জলধর মতো প্রধান ভূমিকায় অভিনয় চালিয়ে যান। ১৯০৮ খ্রিঃ মাত্র ৫৯ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন বাংলা থিয়েটার তার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে।
৮. সংস্কৃতায়ন সম্পর্কে শ্রীনিবাসের তত্ত্বের বিশ্লেষণ।
◉ সংস্কৃত্যায়ন তত্ত্ব কী : নিম্নমবগীয়দের উঁচু বর্ণে উত্তরণের প্রয়াস চিরকালই ছিল। কিন্তু রাজানুগ্রহ ছাড়া তা সম্ভব হত না।
অনেক সময় আচার আচরণের পরিবর্তনের মাধ্যমে উপরদিকে সচলতা সম্ভব হত। শ্রীনিবাস একে সংস্কৃত্যায়ন বলে অভিহিত করেন।
◉ শ্রীনিবাসের সংস্কৃতায়নের ব্যাখ্যা : শ্রীনিবাসের মতে সংস্কৃত্যায়নের দ্বারা নিম্নবর্ণের লোক, আদিবাসী বা অন্য কোন
গোষ্ঠীর উঁচুবর্ণ অর্থাৎ দ্বিজদের আচার অনুষ্ঠান, রীতি নীতি, ধর্ম ও জীবনপ্রণালী আয়ত্ত করাকে বোঝায়। সামাজিক স্তরে ধীরগতিতে এরূপ পরিবর্তন সংগঠিত হয়।
১৯৩১ খ্রিঃ ভারতের আদমসুমারিতে জনগণনার সাথে জাতের পরিচয়ও লিপিবদ্ধ করা হতে থাকে। নিম্নবর্গীয় মানুষরা এই সুযোগে গোষ্ঠীগত ভাবে উঁচু জাতে নিজেদের নাম লিপিবদ্ধ করার দিকে ঝুঁকে পড়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা চলে যে তামিলনাড়ুর ভেল্লাগন শুদ্র ছিল। কিন্তু আদমসুমারিতে তাদের বৈশ্য রূপে গণ্য করার জন্য দাবি করা হয়। এই সময় প্রতিটি জাতের মধ্যে নিজেদের মান উঁচুতে স্থাপনের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। এই উদ্দেশ্যে হাজার হাজার দরখাস্ত পেশ করা হয়। নিজেদের দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই সকল দরখাস্তে জাতের নাম, বৃত্তি ও জীবনযাপনের ধরনের উল্লেখ করা হতো। অনেক সময় নিচু জাতের লোকেরা উচু জাতের বংশধর বলে নিজেদের পরিচয় প্রদানের জন্য পৌরাণিক বীর বা মহাপুরষদের বংশধর বলে নিজেদের পরিচয় দিত। যথা কর্ণাটকের বেদেরা নিজেদের বাল্মীকির বংশধর এবং মেষপালকরা কালিদাসের বংশধর বলে নিজেদের পরিচয় দেয়।
উপসংহার : এই ভাবে প্রতিটি জাত নিজেদের উঁচুজাতে তোলার জন্য এখন প্রতিযোগিতা শুরু করে যে, আদমসুমারিতে জাতের নাম লিপিবদ্ধকরা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এবং বাধ্য হয়ে তা বন্ধ করে দিতে হয়। স্বাধীনতার পরবর্তী আদম সুমারিতে শুধুমাত্র তপশিলীভুক্ত জাতের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। অন্য কোন জাতের উল্লেখ এতে করা হয় না।
৯. পরিবেশ ইতিহাস রচনা প্রসঙ্গে রামচন্দ্র গুহর যুক্তিসমূহ আলোচনা করো?
❐ ভূমিকা : সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো ‘পরিবেশের ইতিহাস’ চর্চা। ভারতের পরিবেশ ইতিহাস চর্চা নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের মধ্য অন্যতম হল রামচন্দ্র গুহ। রামচন্দ্র গুহের মতে পরিবেশ ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য : রামচন্দ্র গুহ তাঁর পরিবেশ ইতিহাস চর্চার গবেষণায় তিনটি দিকের কথা উল্লেখ করেছন যথা—
১) পরিবেশের পরিবর্তনশীল রূপের চর্চা বা পর্যালোচনা করা অর্থাৎ মানুষের বিভিন্ন কাব্যকর্ম এবং পরিবেশের প্রতি তার ব্যবহার পরিবেশকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে তা তুলে ধরা।
২) প্রাকৃতিক পরিবেশে কিভাবে মানুষের জীবনযাত্রা ও তার সভ্যতাকে প্রভাবিত করে তা তুলে ধরা।
৩) পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
◉ পরিবেশে ইতিহাস রচনায় প্রসঙ্গে রামচন্দ্র গুহর দৃষ্টিভঙ্গি : পরিবেশের সঙ্গে মানব সমাজ ও তাঁর ইতিহাসের এক গভীর যোগ রয়েছে। পরিবেশের ইতিহাস চর্চা থেকে জানা যায়। একটি জাতির জীবনযাপনের ধরন, সংস্কৃতি ও ধর্মাচার পরিবেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘অশান্ত অরণ্যজীবন’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে ঔপনিবেশিক ভারতে অরণ্যের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ কিভাবে আদিবাসী ও কৃষক সমাজক বিদ্রোহী করে তুলেছিল। তিনি মনে করেন বর্তমান অবৈজ্ঞানিক শিল্পায়ন, নগরায়ণ, কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার বাঁধ নির্মাণ, বৃক্ষচ্ছেদন প্রকৃতির জগতে ভারসাম্য নষ্ট করেছে। বহু কীট পতঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার বদল ঘটছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটে চলেছে।
পরিবেশের ইতিহাস চর্চা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট এবং জনলবায়ু বদলের কার্যকরণ সম্বন্ধগুলি বুঝতে সাহায্য করে। পরিবেশের ইতিহাস আমাদের ‘সভ্যতা ও প্রকৃতিতে সহাবস্থানের অপরিহার্যতার গুরুত্বের দিকটি তুলে ধরে। প্রকৃতিকে নিজের অনুকূলে এবং নিয়ন্ত্রণে রেখেই মানুষ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। কালক্রমে পৃথিবীর সব যুগেই দেখা গেছে প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণও যতেচ্ছাচার নষ্ট করেছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। ফলে সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যা বারে বারে সভ্যতাকে বিনাশের দিকে নিয়ে গেছে। এই প্রসঙ্গে রামচন্দ্র গুহ হরপ্পা সভ্যতার পতনের কথা উল্লেখ করেছেন।

- প্রস্তর যুগ ও প্রাক্ হরপ্পা
- সিন্ধু ও হরপ্পা সভ্যতা
- বৈদিক সভ্যতা
- প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন
- প্রাচীন ভারতে বৈদেশিক অক্রমণ ও ষোড়শ মহাজন পদ
- মৌর্য যুগ
- মৌর্যত্তর যুগ
- গুপ্ত যুগ
- গুপ্তোত্তর যুগ
- দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক
- পাল ও সেন
- সাহিত্য-শিল্প ও স্থাপত্য
No comments
Hi Welcome ....