Page Nav

HIDE

Grid

GRID_STYLE

Top Ad

Breaking News:

latest

বি.এ সেকেন্ড সেমিস্টার ইতিহাস নোটস History of India: 6th Century BC - Post-Maurya

বি.এ সেকেন্ড সেমিস্টার ইতিহাস নোটস History of India: 6th Century BC - Post-Maurya History of India: 6th Century BC - Post-Maurya Semester =...

B.A-2nd-Semester-History-Notes-Pdf-Download

বি.এ সেকেন্ড সেমিস্টার ইতিহাস নোটস History of India: 6th Century BC - Post-Maurya


History of India: 6th Century BC - Post-Maurya
Semester = II
Code = HISG-DC-2/GE-2
All Question Mark -12

   ❍  আরো পড়ুন  ❍ 
বি.এ 2nd সেমিস্টার ইতিহাস নোটস সূচিপত্র 

➢ ৫০০ শব্দের মধ্যে প্রশ্ন গুলির উত্তর দাও :
Q1.ইন্দো ব্যাকট্রিয়ান কারা? তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত শাসকের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
অথবা, ইন্দো ব্যাকট্রিয়ান কারা? শাসক হিসাবে মিনান্দারের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
Q2. মৌর্য যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করো।
Q3. সূত্র উল্লেখ সহ মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি আলোচনা করো।
Q4. বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের অবদান মূল্যায়ন করো। পৃষ্যভূতিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কি রূপ ছিল?
অথবা, বাংলাদেশের প্রথম সার্বভৌম শাসক হিসেবে শশাঙ্কের অবদানের মূল্যায়ন কর।
Q5. মৌর্যদের উৎপত্তি সম্পর্কে কি জান? বিজেতা ও শাসক হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মূল্যায়ন করো।
অথবা, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কিভাবে তাঁর সাম্রাজ্য সংগঠিত করেন?

❍  ১২ নম্বরের রচনাধর্মী উত্তর সমাধানঃ 
Q1.ইন্দো ব্যাকট্রিয়ান কারা? তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত শাসকের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
অথবা, ইন্দো ব্যাকট্রিয়ান কারা? শাসক হিসাবে মিনান্দারের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
ভূমিকা : মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙনের কালে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে বৈদেশিক জাতিগুলি ভারতে ঢুকে পড়ে। এই সময় ব্যাকট্রিয় অঞ্চলে হিন্দুকুশ পর্বতাঞ্চলে বসবাসকারী গ্রীকদের একটি শাখা খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে ভারতে প্রবেশ করে এবং তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ভারতীয়দের কাছে এরা ‘যবন' নামে পরিচিত। 'যবন' কথাটির অর্থ ম্লেচ্ছ। অর্থাৎ ভারতীয়রা এদেরকে ম্লেচ্ছ হিসেবে বিবেচনা করত। যাই হোক ব্যাকট্রিয় অঞ্চল থেকে গ্রীক বা ভারতে চলে আসায় ভারত ইতিহাসে এরা ব্যাকট্রিয় গ্রীক বা ইন্দো গ্রীক নামে পরিচিত হয়।

❍ স্বাধীন ব্যাকট্রিয় সাম্রাজের উদ্ভব : আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের অধিপতি হয়েছিলেন সেলুকাস। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্য সেলুকাসের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সেলুকাসের দুর্বল বংশধরদের পক্ষে সাম্রাজ্যে পক্ষে ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে ব্যাকট্রিয় পশ্চিয়া প্রভৃতি অঞ্চলগুলি স্বাধীন হয়ে যায়। সেলুকাসের বংশধর অ্যান্টিওকাস ব্যাকট্রিয়া পুনরুদ্ধার করতে এলে জনৈক ইউথিণ্ডিমাস বাধা দেন। তাঁর পুত্র ডিমিট্রয়সের সঙ্গে চুক্তি করে অ্যান্টিওকাস ব্যাকট্রিয়দের স্বাধীনতা মেনে নেন।

❍ ব্যাকট্রিয় গ্রীকদের ভারত অভিযান : আনুমানিক ২০৬ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে ব্যাকট্রিয় রাজ ইউথেডিমাস ভারত অভিযান করে গান্ধারের শাসক রাজা সুভগ সেনকে পরাস্ত করে কাবুল উপত্যকা অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর পুত্র ডিমিট্রিয়স আরো অগ্রসর হয়ে আফগানিস্তান, পাঞ্জাব ও সিন্ধুনদের নিম্ন উপত্যকা অঞ্চল দখল করেন ও এলাকায় গ্রীক মুদ্রা প্রচলন করেন। ডিমিট্রিয়স যখন ভারত অভিযানে ব্যস্ত সে সময় গ্রীক সেনাপতি ইউক্রেটাইডিস খ্রীষ্ট পূর্ব ১৭১ অব্দে ব্যাকট্রিয় সিংহাসন দখল করেন। ডিমিস্ট্রিয়স ভারতেই তাঁর সাম্রাজ্যে মনোনিবেশ করেন। তিনি বর্তমান শিয়ালকোর্ট বা শকল কে রাজধানী করে সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে বাকী জীবন রাজত্ব করেন। সমসাময়িক সাহিত্যে তাঁকে 'ভারতীয়দের নরপতি' অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ১৬৫ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর ইউক্রেটাইডিস সমগ্র সাম্রাজ্যটি দখল করে নেন। কিন্তু অল্পকাল পরেই ইউক্রেটাইডিসের মৃত্যু হলে পার্থিয়ানরা সমগ্র ব্যাকট্রিয় সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। ডিমিট্রিয়সের বংশধরগণ ভারতেই ইন্দো-গ্রীক হিসেবে রাজত্ব করতে থাকেন।

❍ মিনান্দারের শাসনকাল : ভারতে ‘ইন্দো-গ্রীক’ শাসকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিনান্দার। মনে করা হয় তিনি ছিলেন ডিমিট্রিয়সের বংশধর। তিনি আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ১১৫ থেকে ৯০ অব্দ অবধি শাসন করেন। তবে শাসন ক্ষেত্র প্রায় সমগ্র উত্তর পশ্চিম ভারতে বিস্তৃত ছিল এবং তাঁর রাজধানী ছিল শকল বা শিয়ালকোট, মথুরা পর্যন্ত অঞ্চলে তাঁর মুদ্রা পাওয়া গেছে বলে ঐতিহাসিকরা সেই অঞ্চল পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান করেন। তিনি সম্ভবত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বৌদ্ধ পণ্ডিত নাগসেন রচিত ‘মিলিন্দপন্‌হো’ বা ‘মিলিন্দ প্রশ্ন’ নামক বৌদ্ধগ্রন্থ মিলিন্দকে অনেক ঐতিহাসিক মিনান্দার বলে মনে করেন। নাগসেনের কাছে মিন্দারের প্রশ্ন ও নাগসেনের প্রশ্ন ও উত্তর-ই গ্রন্থের মূল বিষয়। তিনি ছিলেন সফল যোদ্ধা ও সুশাসক। গ্রীক ঐতিহাসিক প্লুটার্ক মিনান্দারকে ন্যায় পরায়ণ ও পরাক্রমশালী সুশাসক হিসাবে বর্ণনা করেন।

❍ উপসংহার : 'ইন্দো-গ্রীক’ শাসনের অবসান : উত্তর পশ্চিম ভারতে গ্রীকরা প্রায় দুশো বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু একদিকে ইউথিডিমন ও ইউক্রেটাইডিসের বংশধরদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং মিনান্দারের পর কোন শক্তিশালী শাসকের আবির্ভাব না হওয়ায় এই দুই ঘটনার ফলে ইন্দো-গ্রীক সাম্রাজ্য বেশিদিন টিকে থাকতে পারে নি। সার্বিকভাবে গ্রীকরা দুর্বল হয়ে পড়ে। শক, পার্থিয়ান বা পহ্লব, ইউ-চি বা কুষাণদের আক্রমণের ফলে গ্রীকদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে থাকে। হারমিওস নামক জনৈক গ্রীক রাজ পহ্লবদের কাছে পরাস্ত হলে ভারতে ব্যাকট্রিয় গ্রীক বা ‘ইন্দো-গ্রীক’ শাসনের অবসান হয়, তবে দীর্ঘকাল ভারতে রাজত্ব করে গ্রীকরা ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সভ্যতায় যে প্রভাব ফেলেছিল তার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না।

Q2. মৌর্য যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা আলোচনা করো।
ভূমিকা : মৌর্য যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের উপাদান গুলি হলো মেগাস্থিনিসের ‘ইণ্ডিকা’ গ্রন্থ, কৌটিল্য রচিত 'অর্থ শাস্ত্র, কিছু ধর্মশাস্ত্র, বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’, মৌর্য যুগের শিলালিপি। এছাড়াও বিশাখ দত্ত রচিত ‘মুদ্রারাক্ষস’ থেকে ও মৌর্য যুগের সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচয় মেলে।

❍ সামাজিক অবস্থা বর্ণ প্রথা : মৌর্যযুগ হিন্দু সমাজে বর্ণ প্রথা ও চতুরাশ্রম প্রথা স্পষ্ট রূপ ধারণ করে। গ্রীক সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ ও বর্ণ বৃত্তি ত্যাগ করা নিষিদ্ধ ছিল। 'অর্থশাস্ত্রে' ও বর্ণ প্রথার অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে তবে কৌটিল্য উল্লেখ করেছেন এই প্রথা অতটা দৃঢ় ছিল না।

❍ মেগাস্থিনিসের বিবরণ : মেগাস্থিনিসের বিবরণ অনুযায়ী ভারতীয় সমাজ সাতটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। দার্শনিক, কৃষক, সেনা, পশুপালক, শিল্পী, পরিদর্শক ও আমাত্য এই বিভাগ গুলি তিনি নির্ধারণ করেছিলেন কর্মের ভিত্তিতে। ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী চার বর্ণের অবস্থানের সাথে মেগাস্থিনিসের বর্ণনার অমিল খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজের উপর তলার লোকেরা শুদ্রদের তুলনায় বেশী সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। অশোকের শিলালিপি ও গ্রীক বিবরণে গৃহী ও ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসীদের কথা থেকে মনে করা যায় সে যুগে চতুরাশ্রম প্রথা প্রচলিত ছিল।

❍ সামাজিক সংঘাত : মৌর্যযুগে ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদির ফলে বৈশ্য ও শুদ্রদের মধ্যে বৃত্তিগত পার্থক্য কমতে থাকে এবং তারা বিত্তশালী হয়ে ওঠায় সামাজিক মর্যদা দাবী করতে থাকে। কিন্তু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা তাতে ঘোর আপত্তি জানালে দেখা দেয় সামাজিক সংঘাত। অশোকের ব্যবহার সমতা নীতির ফলে ও এই সংঘাতের পরিণামে মৌর্যযুগে কিছু উপবর্ণের সৃষ্টি হয়। অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ সামাজিক সংহতি রক্ষায় সচেষ্ট হয়।

❍ সমাজে নারীর স্থান : নারীর অবস্থা সম্পর্কে মৌর্য যুগের উপাদান গুলিতে বিস্তৃত কিছু জানা যায় না। সে যুগে নারী স্বাধীনতা প্রায় ছিলই না। পুরুষের বহুবিবাহ, অবরোধ প্রথা, সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। ধর্ম শাস্ত্র কারগণ নারীর মর্যদা স্বীকার করলেও তাদের স্বাধীনতা স্বীকার করেননি। তবে বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুণীগণ অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত। বিধবাদের কঠোর অনুশাসনের মধ্যে থাকতে হতো। প্রাসাদের অভ্যন্তরে রাজার নারী দেহরক্ষী ছিল। স্ত্রীরা স্বামীর সহিত ধর্মানুষ্ঠানে স্বাধীনভাবে অংশ গ্রহণ করত। 'স্ত্রী অধ্যক্ষ মহামাত্র' নামে নারী প্রশাসকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সাব্বিকভাবে নারী স্বাধীনতা ছিলনা।

❍ দাস প্রথা: যদিও মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন মৌর্য যুগে দাস প্রথা ছিল না, তবে তা ঠিক নয়। আসলে গ্রীক দেশের ন্যায় দাস ভারতে দাসদের প্রতি কঠোর ব্যবহার করা হতো না। সেই কারণে মেগাস্থিনিস দাসদের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারেন নি। ধর্মশাস্ত্র ও ‘অর্থশাস্ত্র’-তে দাস প্রথার অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। দাসদের কিছু সামাজিক অধিকার স্বীকৃত ছিল, কোন কোন ক্ষেত্রে তারা মুক্তিও লাভ করতে পারত।

❍ জনসাধারণের অবস্থা : এই যুগে ভারতীয়দের সৎ, শান্ত ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের কথা জানা যায় গ্রীক সূত্র থেকে। শহরের জীবন ছিল বিলাসপূর্ণ। চাল, গম, বার্লি, মদ ছিল প্রধান আহার্য বস্তু। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন শ্রেণীর অবস্থাও খুব ভালো ছিল। জিনিষ পত্র সহজলভ্য ছিল। দেশে চুরি ডাকাতি প্রায় ছিলই না। ব্যাৎসায়নের ‘কামসুত্রে’ নাগরিক জীবনের সুন্দর বর্ণনা আছে।

❍ অর্থনৈতিক জীবন কৃষি : মৌর্য যুগে ভারতীয় অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। সাধারণ লোকের জীবিকা ছিল কৃষিকাজ ও রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। মেগাস্থিনিসের মতে রাজাই ছিলেন সকল জমির মালিক। কিন্তু ডঃ ইউ. এন. ঘোষাল 'অর্থশাস্ত্র থেকে উল্লেখ করেছেন রাজার খাসজমি ও রাজস্ব প্রদানকারী প্রজাদের অধিনস্ত জমি এই দুই ভাগে মৌর্য যুগে কৃষি জমি বিভক্ত ছিল। উৎপন্ন ফসলের থেকে ভাগ বা কর রাজাকে দিতে হতো। এছাড়া রাজা অতিরিক্ত ‘বলি’ আদায় করতেন। পশুপালন ছিল মৌর্য অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

❍ শিল্প ও শিল্পী নিগম : মৌর্য যুগের রাজনৈতিক ঐক্য শিল্প স্থাপনার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রস্তুর শিল্প, লৌহ ও অন্যান্য ধাতুশিল্প, চর্মশিল্প, কাষ্ঠশিল্প, বয়নশিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতি শিল্পের বিকাশ ঘটে। মৌর্য যুগে বহু দক্ষ শিল্পীর অবস্থান ছিল। শিল্প জীবিরা নিজেদের মধ্যে গীল্ড বা নিগম গড়ে তুলতেন। প্রাক্ মৌর্য যুগেই এরকম ১৮টি গীল্ডের অস্তিত্ব ছিল। মৌর্য যুগে এগুলি আরো শক্তিশালী হয়। স্থানীয় অঞ্চলে নিগমগুলি এক চেটিয়া অধিকার ভোগ করত। এগুলি পণ্যের দাম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করত। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দাস ও স্বাধীন শিল্পীদের নিয়োগ করত নিগমগুলি। বণিকদের ঋণদান পর্যন্ত করত নিগম গুলি। নিগমের সদস্যদের তার নিয়মাবলী মেনে চলা বাধ্যতামূলক ছিল।

❍ ব্যবসা বাণিজ্য ও ধনতন্ত্রদের বিকাশ :  শিল্পের বিকাশ মৌর্য যুগে অন্তর্দেশীয় ও বহিঃ বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করে। গঙ্গা নদীকে গুরুত্ব পূর্ণ বাণিজ্য পথ হিসেবে গ্রহণ করা হতো। স্থলপথে শ্রাবস্তী থেকে পৈথান, শ্রাবস্তী থেকে রাজগৃহ, রাজগৃহ থেকে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত বাণিজ্য পথ বিস্তৃত ছিল। পাটলিপুত্র, ভারুজ তাম্রলিপ্ত ছিল উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য কেন্দ্র। পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরেই মৌর্য যুগেও ভারতের বহিঃবাণিজ্য সমৃদ্ধ হয়েছিল। মিশর, চীন, গ্রীস, সিংহল, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নানা দেশের সঙ্গে মৌর্য যুগে স্থলপথে ও জলপথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বোর্ড ছিল। মূল্যবাণ পাথর, মণিমুক্তা রেশমবস্ত্র প্রভৃতি বিদেশে রপ্তানী হতো। চীনের রেশম, সোনা, শুকনো খাবার, ঘোড়া প্রভৃতি আমদানী হতো। মৌর্যযুগে কৃষি ও শিল্পের বিকাশের ফলে মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়।‘গৃহপতি’ ও ‘শ্রেষ্ঠী’ নামে দুটি ধনী শ্রেণীর বিকাশ ঘটে। মৌর্যযুগ থেকে ধনতন্ত্রের সূচনা ঘটে।

Q3. সূত্র উল্লেখ সহ মৌর্য শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি আলোচনা করো।
ভূমিকা : মৌর্য বংশ প্রাচীন ভারতে একটি বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল এবং শাসন তান্ত্রিক ক্ষেত্রে এই যুগে একটি নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। মৌর্য শাসনব্যবস্থার ইতিহাসের প্রধান সূত্র হলো চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় গ্রীক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিসের ‘ইণ্ডিকা’ কৌটিল্য রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’ বিশাখা দত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’, বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘দিব্যবদান', জাস্টিন ট্যাবো, প্লিনির রচনা ও অশোকের বিভিন্ন শিলালিপি এবং প্রথম রুদ্র দমনের গিরনার শিলালিপি।

❍ রাজার ক্ষমতা, মর্যাদা ও আদর্শ : মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি একাধারে প্রশাসক, নীতিনির্ধারক, আইন প্রণেতা, বিচারক ও প্রধান সেনাপতি ছিলেন। রাজ ক্ষমতা বংশানুক্রমিক ছিল। তবে রাজা সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও কখনোই স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না দৈব অধিকার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁরা শুধুমাত্র দেবতাদের প্রিয় বলে নিজেদের অভিহিত করতেন। মৌর্য রাজতন্ত্র ছিল প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচারী। মেগাস্থিনিসের বর্ণনানুযায়ী রাজা নিজে দরবারে উপস্থিত থেকে রাজকার্য পরিচালনা করতেন।

❍ কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা : কৌটিল্য বলেছেন “শকটং চক্ৰমেকং ন বৰ্ততে”— অর্থাৎ এক চাকার শকট চলতে পারে না। রাজশক্তি পরিচালনার জন্য কৌটিল্য প্রধান রাজকর্মচারী রূপে ‘অষ্টাদশ তীর্থের’ নাম উল্লেখ করেন। প্রধান সেনাপতি, মন্ত্রী প্রভৃতি ছিলেন এর মধ্যে প্রধান। দায়িত্বশীল কর্মচারীদের মেগাস্থিনিস ‘সচিব’ ও ‘আমাত্য' বলে উল্লেখ করেছেন ও 'অর্থশাস্ত্রে’ এদের ‘মন্ত্রীন’ ও ‘আমাত্য' বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

❍ পরিষদ ও তার পরবর্তী প্রশাসনিক পর্যায় : 'অর্থশাস্ত্র' এবং অশোকের শিলালিপিতে রাজার সাহায্যকারী রূপে মন্ত্রী পরিষদের কথা বলা হয়েছে। জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে শিক্ষা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হতেন। মন্ত্রীরা অত্যন্ত উচ্চ হারে বেতন লাভ করতেন। গুরুতর সমস্যা আলোচনার জন্য মন্ত্রী পরিষদ আহ্বান করা হতো। পরবর্তী স্তরে ছিল অধ্যক্ষ। এরা সম্ভবত বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিল। উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারীগণকে ‘আমাত্য' বলে উল্লেখ করা হতো।

❍ প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা : মৌর্য সাম্রাজ্যকে প্রধানত চারটি শাসনবিভাগে ভাগ করা হয়েছিল যথা প্রাচ্য, উত্তরাপথ, অবতী ও দক্ষিণাপথ। প্রদেশ গুলিকে ‘বিষয়’ বা ‘আহরে' (জেলা) বিভক্ত করা হয়। সাধারণত রাজপুত্র বা রাজ আত্মীয়গণ প্রদেশের শাসক নিযুক্ত হতেন। প্রদেশের বিভিন্ন বিভাগের শাসক ছিলেন প্রাদেশিক, রাজুক, মহামাত্র। এদেরকে সাহায্য করতেন যুত, প্রতিবেদক, লিপিকার প্রভৃতি পদমর্যদার কর্মচারীগণ। প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তরে ছিল গ্রাম। প্রাদেশিক বিভিন্ন কর্মচারী নগদ বেতন পেত, তাদের বংশানুক্রমিক পদাধিকার ছিল না।

❍ পৌর শাসন : মেগাস্থিনিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে এ্যাগ্রোনমই নামে পাটলীপুত্র রাজধানীর পৌর শাসনের দায়িত্ব ছিল ৩০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি পরিষদের উপরে। এর সদস্যগণ ৫ জন করে ছয়টি ভাগে বিভক্ত হয়ে শিল্পের নিয়ন্ত্রণ, বিদেশী আগন্তকের তত্ত্বাবধান, জন্ম মৃত্যুর হিসাব রক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, শিল্প জাত দ্রব্যের বৃদ্ধির তত্ত্বাবধান, বিক্রিত সামগ্রীর উপর শুল্ক আরোপ প্রভৃতি দেখাশোনা করত। তক্ষশীলা, উজ্জয়িনী প্রভৃতি নগরে ও সম্ভবত এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।

❍ সামরিক সংগঠন : সামরিক ব্যবস্থাতেও সময় পরিষদ ছিল ও এর সদস্য ছিল ৩০ জন। এরাও ৫ জন করে ছয়টি শাখায় বিভক্ত হয়ে পদাতিক, অশ্বারোহী, রথ, হক্তিবাহিনী, রসদ ও নৌবাহিনীর তত্বাবধান করতেন।

❍ রাজস্ব ও বিচার ব্যবস্থা : মৌর্য যুগে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ ছিল  /  থেকে / ভাগ। কোন কোন ক্ষেত্রে ‘বলি’ নামে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা হতো। ব্রাহ্মণ, শ্রমণ, সেনা বাহিনীর অস্ত্র নির্মাতাদের ভূমি রাজস্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতো। বিচার ব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক, অধ্যক্ষ, মহামাত্রগণ তাকে সাহায্য করতেন। বিচার কার্যের বিশেষ দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন ‘ব্যবহারিক মহামাত্র। বিচার কার্যে প্রচলিত অনুশাসন অনুসরণ করা হতো।

❍ অশোকের সংযোজন : মৌর্য শাসন ব্যবস্থার এই মৌলিক কাঠামোর অশোক কিছু সংযোজন করেন। জনহিতকর কার্যের জন্য ‘ব্রজভূমিক' নামে কর্মচারী নিয়োগ করেন। তিনি ‘দণ্ড সমতা’ ও ‘ব্যবহার সমতা’ নীতি প্রয়োগ করেন। প্রজাদের মধ্যে নৈতিকতা বিস্তারের জন্য তিনি ‘ধর্ম মহামাত্র’ ধর্মযুত, ‘স্ত্রী ধর্মমহামাত্র’ নিয়োগ করেন। ডঃ কে. এন. মুন্সীর মতে অশোকই প্রথম কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

Q4. বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের অবদান মূল্যায়ন করো। পৃষ্যভূতিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কি রূপ ছিল?
অথবা, বাংলাদেশের প্রথম সার্বভৌম শাসক হিসেবে শশাঙ্কের অবদানের মূল্যায়ন কর।
ভূমিকা :  প্রাচীন বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে ষষ্ঠ শতকের প্রথমভাগে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের যুগে বাংলাদেশে একাধিক স্বাধীন জনপদের উন্মেষ ঘটে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গৌড়, বঙ্গ, সমতট, রাঢ়, তাম্রলিপ্ত, পুণ্ড্র ও বরেন্দ্রী ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে কালক্রমে গৌড় রাজ্যটি একসময় সার্বভৌম রাজ্যে পরিণত হয়। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্য যখন ক্ষয়িষ্ণু এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির আক্রমণে প্রায় বিধস্ত সে সময় উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে 'গুপ্ত' উপাধিধারী রাজাগণ স্বাধীনভাবে  রাজত্ব শুরু করেন। বাংলাদেশের এই অঞ্চলটি গৌড় নামে পরিচিত। কিন্তু উত্তর ভারতে মৌখরী রাজবংশ ও দাক্ষিণাত্যের চালুক্য রাজের আক্রমণে এই অঞ্চলের গুপ্ত রাজাগণ যখন পরাজিত প্রায় সে সময় শশাঙ্ক নামে একজন গৌড়ে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

❍ শশাঙ্কের বংশ পরিচয় : শশাঙ্কের বংশ পরিচয় ও তাঁর প্রথম জীবন সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ এখন স্থির সিদ্ধানে আসতে পারেন নি। কেউ বলেন তিনি ছিলেন গুপ্ত বংশসম্ভূত এবং তাঁর অপর নাম নরেন্দ্র গুপ্ত আবার অনেকের মতে তিনি ছিলেন মগধের গুপ্ত বংশীয় রাজা মহাসেন গুপ্তের অধীনে একজন সামন্ত। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি গৌড়ের পূর্ববর্তী রাজা জয়নাগের উত্তরাধিকারী অবশ্য এগুলির কোনটাই ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ নয়। তবে একথা ঠিক তিনি ৬০৬ খ্রী পূর্বে স্বাধীন গৌড়ে রাজ্য তিনি  প্রতিষ্ঠা করেন।

❍ শশাঙ্কের সাম্রাজ্য ঐতিহাসিক উপাদান : শশাঙ্কের রাজত্ব ও তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার সম্পর্কে নানাবিধ উপাদান থেকে তথ্য পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে উড়িষ্যার গঞ্জাম রাজ মাধব বর্মার তাম্রপত্র এবং হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্ম এর তাম্র পত্রের উল্লেখ করা যেতে পারে। এছাড়াও হর্ষের সভাকবি বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত'। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ্-এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকেও শশাঙ্কের রাজত্ব ও সাম্রাজ্য বিস্তার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও 'আর্যমঞ্জুরী মূলকাপ' নামক বৌদ্ধগ্রন্থ ও শশাঙ্কের রাজত্বকালের এক অন্যতম উপাদান।

৬০৬ খ্রীঃ স্বাধীন গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর শশাঙ্ক রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ যা বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার অবস্থিত। বঙ্গদেশের স্বাধীন নৃপতি হিসাবে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের বাইরের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। দক্ষিণে দত্তভূমি উৎকল কোঙ্গজ রাজ্য, পশ্চিমে মগধ, পূর্বে কামরূপ, উত্তরবঙ্গ সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্য ভুক্ত হয়। ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার মন্তব্য করেন শশাঙ্কের পূর্বে আর কোন বাঙালী রাজা এই ধরণের বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হতে পেরেছেন বলে জানা নেই। সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে কনৌজের মৌখরি বংশ ও পুষ্যভৃতি বংশের সঙ্গে সংঘর্ষ শশাঙ্কের রাজত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

❍ বাংলাদেশের ইতিহাসে শশাঙ্কের অবদান : ঐতিহাসিক ডঃ মজুমদার তাঁর 'History of Bengal' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন ‘বাঙালী রাজাগণের মধ্যে শশাঙ্কই প্রথম সার্বভৌম নরপতি’, বাস্তবিকই বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্ক এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। আর্যাবর্তের তথা সর্বভারতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম বাংলাদেশকে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। সামান্য একজন সামন্ত হিসেবে শুরু করে শশাঙ্ক যে ভাবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, বাংলার ইতিহাসে তা একটি বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি শিবের উপাসক হলেও বানভট্ট বা হিউয়েন সাঙ যেভাবে তাঁকে বৌদ্ধধর্ম বিরোধী বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন তা ঐতিহাসিকগণ কোনভাবেই সমর্থন করেন না। তিনি যথেষ্ট ধর্মীয় উদারতার পরিচয় দিতেন বলেও ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের ন্যায় ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেন। যে চতুরতা ও কূটনৈতিক জ্ঞানের সাহায্যে শশাঙ্ক বাংলাদেশের রাজনৈতিক মর্যাদাকে উত্তরভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করেন, তাতে তাঁকে বাংলার প্রথম জাতীয় রাজা বলে অভিহিত করাই যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভিত্তির উপরেই পরবর্তী কালে পাল রাজারা বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনে সমর্থ হন।

❍ পৃষ্যভূতিদের সঙ্গে শশাঙ্কের সম্পর্ক : শশাঙ্কের সাম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে একটা বড় অংশ জুড়ে কনৌজ ও থানেশ্বরের পৃষ্যভৃতিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কাহিনী বিদ্যমান। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা দখল করার পর শশাঙ্ক কনৌজের মৌখুরি বংশের রাজা গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে পৃষ্যভূতি বংশীয় রাজা প্রভাকর বর্দ্ধনের কণ্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করেন। এই দুই বংশের বৈবাহিক মিত্রতা আবার মালবের দেবগুপ্তের পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল। সে কারণে দেবগুপ্ত ও শশাঙ্ক পারস্পরিক মিত্রতায় আবদ্ধ হন। উত্তর ভারতের এক জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের ফলে পৃষ্যভুতিদের সঙ্গে এ ভাবেই শশাংকের শত্রুতার বীজ পোথিত হয়।

দেবগুপ্ত ও শশাঙ্ক যৌথভাবে কণৌজ আক্রমণ করলে গ্রহবর্মা নিহত হন ও রাজ্যশ্রীকে কারারুদ্ধ করা হয়। থানেশ্বর রাজ রাজ্যবর্ধন সেসময় ভগ্নিপতিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে অগ্রসর হলে দেবগুপ্ত রাজ্যবর্ধনের হাতে নিহত হন। আবার রাজ্যবর্ধন নিহত হন শশাঙ্কের হাতে। তবে রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের হাতে নিহত হয়েছিলেন একথা ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত ঐতিহাসিক স্বীকার করেন না। শশাঙ্কের সঙ্গে যুদ্ধের পরাজয়ের পূর্বেই রাজ্যবর্ধনের মৃত্যু হয় বলে অনেকে মনে করেন। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা হর্ষবর্ধন থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেন। তিনি ভগিনী রাজ্যশ্রীকে উদ্ধরে সচেষ্ট হন। তিনি কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মার সঙ্গে শশাঙ্ক বিরোধী জোট গড়ে তোলেন। তবে এই যুদ্ধ হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। একমাত্র ‘আর্যমঞ্জুশ্রী মূল কল্প' নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে শশাঙ্ক এই মিলিত জোটের হাতে আক্রান্ত হলে কনৌজ পরিত্যাগ করেন। ঐতিহাসিক প্রামান্য তথ্য অনুযায়ী প্রমাণিত হয়েছে যে শশাঙ্ক ৬৩৭ খ্রীঃ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে গৌড়ে রাজত্ব করেছিলেন এবং তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন।

Q5. মৌর্যদের উৎপত্তি সম্পর্কে কি জান? বিজেতা ও শাসক হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মূল্যায়ন করো।
অথবা, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কিভাবে তাঁর সাম্রাজ্য সংগঠিত করেন?
ভূমিকা : খ্রীষ্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মগধের সিংহাসনের আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে মৌর্য বংশের পত্তন হয়। তবে তাঁর বংশ পরিচয় সম্পর্কে মত পার্থক্য আছে। পুরাণ, বৌদ্ধগ্রন্থাদি, জৈনসূত্রে এ সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়।

❍ পুরাণ ও গ্রীকদের মত : মৌর্য বংশের উৎপত্তি সম্পর্কে বিষ্ণু পুরাণ এবং হিন্দু কিংবদন্তীতে বলা হয়েছে চন্দ্রগুপ্ত নন্দবংশ জাত তাঁকে শূদ্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। নন্দ রাজার দাসী মুরার গর্ভে চন্দ্রগুপ্তের জন্ম। মায়ের নাম অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত রাজবংশের নাম হয় মৌর্যবংশ। গ্রীক লেখক জাস্টিন চন্দ্রগুপ্তকে সাধারণ বংশজাত বলে মন্তব্য করেছেন। ‘মুদ্রারাক্ষস’-এও তাঁকে 'কুলহীন' বলা হয়েছে। কিন্তু এই মত সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। ‘মুদ্রারাক্ষস’ চন্দ্রগুপ্তের সমকালীন রচনা ছিল না। এইচ. সি. রায়চৌধুরী এই দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধিতা করেন।

❍ বৌদ্ধ ও জৈন মত : মৌর্য বংশের উৎপত্তি সম্পর্কে আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বৌদ্ধ ও জৈন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে বেশী নির্ভরযোগ্য মনে করেন। বৌদ্ধ গ্রন্থ 'মহাবংশে’ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হিমালয়ের পাদদেশে পিপ্পলিবন নামক স্থানের 'মোরিয়া' নামক এক প্রজাতান্ত্রিক ক্ষত্রিয়গোষ্ঠীর সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 'মহাবোধি বংশ', 'দিব্যবদান' প্রভৃতি বৌদ্ধ গ্রন্থেও তাঁকে ক্ষত্রিয় কুলোদ্ভব বলা হয়েছে। 'মহাপরিনির্বাণ সূত্র’ও একই কথা বলে। অপর দিকে জৈন গ্রন্থ ‘পরিশিষ্ট পার্বণে বলা হয়েছে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন “ময়ূর পোষক” গ্রামের নায়কের দৌহিত্র। এথেকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বংশের নাম হয় মৌর্যবংশ।

উপরিউক্ত তথ্যের পর্যালোচনায় বলা হয় পুরাণে উল্লেখ আছে নন্দবংশের পতনের পর মগধে শুদ্র বংশ রাজত্ব করেছিল। এতে প্রমাণিত হয় না যে চন্দ্রগুপ্ত বা তাঁর বংশধর সকলেই শূদ্র ছিলেন। 'দিব্যাবদান’-এ বিন্দুসার ও অশোককে ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। বৈরাটি লিপিতে অশোক নিজেকে ক্ষত্রিয় বংশীয় বলে দাবী করেছেন। আধুনিক ঐতিহাসিকরা পুরাণ ও কিংবদন্তী অপেক্ষা বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থকেই বেশী গ্রহণযোগ্য মনে করেন। সবকিছু বিবেচনা করে মৌর্যবংশের উৎপত্তি সম্পর্কে তাঁরা বৌদ্ধ ও জৈন সূত্র নির্দেশিত তথ্যকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

❍ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা। এক যুগসন্ধিক্ষণে তিনি সিংহাসনে বসেন। একদিকে নন্দ রাজাদের অত্যাচারী শাসন, জনগণের অসন্তোষ, অন্যদিকে আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণজনিত সমস্যা – সে কারণে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দায়িত্ব ছিল বহুবিধ। বিদেশী শত্রুর মোকাবিলা, মগধ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষা করা ও তার সম্প্রসারণ ঘটানো ও বিচ্ছিন্ন ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতের জাতীয় জীবনের সূচনা করেন। তাঁর সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

❍ উপাদান : বহু সূত্র থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জীবনী ও কৃতিত্ব জানা যায়। দেশীয় সাহিত্যের মধ্যে পুরাণ, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’, সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর' প্রভৃতি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জীবনী তথ্য সমৃদ্ধ। মেগাস্থিনিসের 'ইণ্ডিকা’, স্ট্রাবো, ডায়াডোরাস, প্লুটার্ক, জাস্টিন প্রমুখ বিদেশী লেখকদের রচনা থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও সমসাময়িক যুগের ইতিহাস জানা যায়।

❍ বংশ পরিচয় : চন্দ্রগুপ্তের বংশ পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। হিন্দু পুরাণ, কিংবদন্তীতে বলা হয়েছে তাঁর মাতা মুরা ছিলেন শূদ্রাণী এবং সেই নাম থেকেই এই বংশের নাম হয় মৌর্য। জৈন ‘পরিশিষ্ট পার্বণে' চন্দ্রগুপ্তকে ময়ূর পোষকদের দলপতির বংশজাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রীক লেখকদের মতে চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন নীচ কুলোদ্ভব। বৌদ্ধ গ্রন্থাদির সূত্র ধরে আধুনিক ঐতিহাসিকদের বেশীর ভাগ বলতে চেয়েছেন যে চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন গোরক্ষপুর জেলার অন্তর্গত পিপ্পলিবনের 'মোরিয়' নামক ক্ষত্রিয় বংশজাত। ঐতিহাসিকগণ বলেন যে এই ‘মোরিয়' নাম থেকে মৌর্য কথাটি আসে।

❍ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা : যোদ্ধা, সুদক্ষ শাসক ও প্রজাহিতৈষী রাজা হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলে স্বীকৃত হয়েছেন। নন্দরাজাদের অত্যাচার থেকেই কেবল তিনি ভারতবাসীকে রক্ষা করেন নি, ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে বিশাখ দত্ত বলেছেন যে, ম্লেচ্ছ বা গ্রীকদের দ্বারা ধর্ষিতা পৃথিবী বা ভারতভূমিকে চন্দ্রগুপ্ত গ্রীকদের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গ্রীকদের বিতাড়ণ ও সেলুকাসকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে চুড়ান্ত সামরিক সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। সমগ্র উত্তর ভারত তো বটেই, কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে দাক্ষিণাত্যেও তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। তাঁর পূর্বে কেউই এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করতে পারেন নি।

❍ ভারতের জাতীয় ঐক্য : আর্যরা বৈদিক যুগ থেকেই ভারতে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের যে স্বপ্ন দেখতেন, সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ ধারণ করেছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে। উত্তরে পারস্যের সীমান্ত থেকে দক্ষিণে মহীশূর এবং পূর্বে বঙ্গদেশ হতে পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে তিনি ভারতে রাষ্ট্রীয় ঐক্য সম্পন্ন করেন। বিদেশী গ্রীকদের বিতাড়ণ ও সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন এই ঐক্যের পথ প্রশস্ত করেছিল। তাঁর মাধ্যমেই ভারতে গড়ে ওঠে 'রাজচক্রবর্তীর' আদর্শ।

❍ সুশাসক : শুধুমাত্র সার্বভৌম রাজশক্তির আদর্শ স্থাপনই নয়, শাসক হিসেবেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীভূত ও প্রজাকল্যাণ মূলক অর্থাৎ প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা স্থাপন করে তিনি বিশাল সাম্রাজ্যের সংহতি রক্ষা করতে সক্ষম হন। মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা ' গ্রন্থে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা দেখা যায়।

❍ শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক : কেবলমাত্র যোদ্ধা ও সুশাসক নয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শিল্প ও সংস্কৃতিরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। তাঁর নির্মিত রাজপ্রসাদ, উদ্যান তাঁর শিল্পবোধের পরিচায়ক। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদকে তিনি অসাধারণ সুন্দর করে সাজিয়ে ছিলেন। সে যুগের দার্শনিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। 'অর্থশাস্ত্র' ও 'কল্পসূত্রের' রচয়িতারা তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন।

❍ উপসংহার : সাধারণ নামগোত্রহীন অবস্থা থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেছিলেন। গ্রীকদের বিতাড়ণে তিনি যথার্থ সামরিক কুশলতার পরিচয় প্রদান করেন। শাসক হিসেবে যে যোগ্যতার পরিচয় দেন তাতেই গড়ে ওঠে এক অখণ্ড ভারত। তাঁর আমলে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের যে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল তার উপরেই পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সৌধ।


No comments

Hi Welcome ....